আগামী এক মাসের মধ্যে গুম বিষয়ে একটি আইন করা হবে: আইন উপদেষ্টা

সরকার আগামী এক মাসের মধ্যে গুম বিষয়ে একটি আইন করতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল।
তিনি জানান, 'সরকার গুম বিষয়ে একটি আইন করতে যাচ্ছে। আগামী এক মাসের মধ্যে আইনটি চূড়ান্ত হবে। ওই আইনে স্থায়ী গুম কমিশন গঠন এবং মিসিং পারসন সার্টিফিকেট দেওয়ার বিধান রাখা হবে।'
আজ (১৬ জুন) সকালে ঢাকা সফরত জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এনফোর্সড অর ইনভলান্টারি ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স (ডব্লিউজিইআইডি)-এর প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকের পর আইন উপদেষ্টা সচিবালয়ে তার কার্যালয়ে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন।
গত রোববার জাতিসংঘের গুম কমিটির দুই সদস্যের প্রতিনিধিদল ঢাকায় এসেছেন।
আইন উপদেষ্টা বলেন, জাতিসংঘের এই কমিটি অনেকবার বাংলাদেশে আসতে চেয়েছিল। প্রথম আসতে চেয়েছিল ১২ বছর আগে। এরপরও বারবার আসতে চেয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার তাদের আসার সুযোগ দেয়নি। আমরা যেহেতু বিশ্বাস করি আওয়ামী লীগ সরকারের সময় গুমের ঘটনাগুলো ঘটেছিল, সেজন্যই তারা আসতে দেয়নি।
তিনি বলেন, এখন নতুন সময়, নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। অনেক গুম হয়েছে দেশে। বর্তমান সরকারেরও একটি কমিটমেন্ট যে এসব ঘটনার বিচার করা হবে।
তিনি আরও বলেন, এজন্য বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর পরই আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবসের আগে গুম বিষয়ক আন্তর্জাতিক কনভেনশনের সদস্য রাষ্ট্র হয়েছে বাংলাদেশ। এই সদস্য হওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক চুক্তির পুরো বিষয়গুলোকেই মেনে নিয়েছে। এপর্যন্ত ৭৭ টি দেশ এই কনভেনশনের সদস্য।
আইন উপদেষ্টা বলেন, সরকার গুম বিষয়ক আইন প্রণয়ন করবে। আইনের অধীনে একটি স্থায়ী কমিশন গঠন করা হবে। মিসিং পারসন সার্টিফিকেট দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। এতে যে সমস্ত ব্যক্তি গুম হয়েছেন, যাদের ডেথ সার্টিফিকেট নেই, তাদের পরিবার যাতে ব্যাংক অ্যাকাউন্টসহ অন্যান্য সম্পদ ব্যবহার করতে পারে।
তিনি বলেন, ইউএন প্রতিনিধিদল বর্তমান কমিশনের মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে। আমরা প্রতিনিধি দলকে বলেছি বিষয়টি বিবেচনা করা হবে, এটি সরকারের সিদ্ধান্ত। এছাড়া কমিশন অন সার্চ গঠন করার বিষয়টিও বিবেচনা করা হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে আইন উপদেষ্টা বলেন, আইন করার ব্যাপারে বা কার্যকর করার ক্ষেত্রে জাতিসংঘের কারিগরি সহযোগিতা নেওয়া হবে।
আরেক প্রশ্নের জবাব তিনি বলেন, অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তির আগে আগামী এক মাসের মধ্যে আইনটি পাশ করা হবে।
উপদেষ্টা বলেন, আমাদের সরকারের একটা কমিটমেন্ট ছিল গুমের তদন্ত, গুমের বিচার। জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপ বাংলাদেশে এসেছে, তাদের সঙ্গে মিটিং করেছি। মিটিংয়ে বসার পর তারা আমাদের কিছু কার্যক্রমের প্রশংসা করেছেন। গুম কমিশনের, তদন্ত কমিশনের প্রশংসা করেছে, আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছি সেটার প্রশংসা করেছে। গুমবিষয়ক কমিশনের মেয়াদ বাড়ানোর কথা বলেছেন। আমরা এই জিনিসটা প্রধান উপদেষ্টার কাছে উপস্থাপন করবো।
গুমবিষয়ক আইন করলে পরবর্তী সরকার আইনটি বাতিল করবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি বা যে সরকারই আসুক; তারা সবাই গুমের শিকার। তারা সবাই সোচ্চার ছিলেন। বিএনপি-জামায়াত সবচেয়ে বেশি শিকার ছিলেন।
ট্রুথ কমিশনের বিষয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত সম্প্রতি প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকা সফর এবং ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন গঠন হচ্ছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা দক্ষিণ আফ্রিকায় হয়েছিল এবং সারা পৃথিবীতে সাড়া ফেলেছিল। এই কমিশন শ্রীলঙ্কা এবং নেপালেও হয়েছে। কিন্তু অতটা সাকসেসফুল হয়নি।
আইন উপদেষ্টা বলেন, ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশনের চারটি অংশ থাকে। একটা হচ্ছে ট্রুথ সিকিং, আসলে কী হয়েছিল সেটা বের করা। সেটার কাজ অলরেডি শুরু হয়েছে। জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি যে রিপোর্টটা করলো সেটি এর একটা পার্ট।
তিনি বলেন, আমাদের ট্রাইব্যুনালে যে বিচার হচ্ছে, তদন্ত হচ্ছে, সেটা ট্রুথ সিকিংয়ের একটা পার্ট। আমাদের মোস্তফা সরয়ার ফারুকী সাবেক গণভবনে যে জুলাই জাদুঘর করছেন, সেটা ট্রুথ সিকিং এর একটা পার্ট।
তিনি আরও বলেন, তারপর একটা পার্ট হচ্ছে -মেমোরিয়ালাইজেশন, স্মৃতিটাকে ধরে রাখা। সেটা ফারুকীর জাদুঘরের মাধ্যমে নিশ্চয়ই করা হবে। আর তৃতীয় হচ্ছে অ্যামনেস্টি; এটা একটু কঠিন। এটা হচ্ছে যারা ছোট ছোট অপরাধে যুক্ত ছিলেন উদ্দেশ্যমূলকভাবে কোনো অপরাধে যুক্ত ছিলেন না, তাদের ক্ষেত্রে কোন স্কোপ আছে কি না সেটা দেখা। সব দেশেই এটা করা হয়।
আসিফ নজরুল বলেন, চতুর্থ ধাপ হচ্ছে, রিকনসিলিয়েশন। যারা চরম দোষী আছে তাদের উপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার মাধ্যমে আমাদের একটা জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তোলা। আরেকটি হচ্ছে যারা ক্ষতিগ্রস্ত, তাদের যথেষ্ট পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দেওয়া। ক্ষতিপূরণ শুধু টাকার অঙ্কে না। হয়তো ধরেন জুলাই অবস্থানে যাদের অঙ্গহানি হয়েছে তাদের চাকরির ব্যবস্থা করা।
তিনি বলেন, আমরা দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে গিয়েছিলাম। সেখানে অনেক মিটিং করেছিলাম। আমাদের দ্বিতীয় ধাপে চিন্তা আছে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে রিজওনাল কনফারেন্স করব। শ্রীলঙ্কা, নেপাল, দক্ষিণ আফ্রিকার যারা আছে তাদেরকে আনব। আমাদের বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল, সিভিল সোসাইটি, মানবাধিকার গ্রুপ আছে, ছাত্ররা আছে-সবার মতামত নিয়ে কী করা যায়, সেটা নিয়ে চিন্তা করব।
আইন উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে জাতিসংঘের গুম সম্পর্কিত কার্যনির্বাহী দলের সদস্য গ্রাজিনা বারানোউস্কা ও আনা লোরেনা ডেলগাদিলো পেরেজ উপস্থিত ছিলেন।