১৩৬তম বর্ষপূর্তি: অটোমেশনের আওতায় চট্টগ্রাম বন্দর পরিণত হবে পেপারলেস প্রতিষ্ঠানে

চট্টগ্রাম বন্দরের যাত্রা শুরু হয়েছিলো ১৮৮৭ সালের ২৫ এপ্রিল। ১৩৬ বছরে দেশের এই প্রধান সমুদ্রবন্দরের কার্যক্রম বিশ্বের ১০৬টি দেশের সাথে সংযুক্ত হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরকে আন্তর্জাতিক মানের বন্দরে রূপান্তর করার লক্ষ্যে বিভিন্ন বিভাগকে অটোমেশনের আওতায় আনা হচ্ছে। তৈরী হচ্ছে ৫০টি সফটওয়্যার মডিউল। যার মাধ্যমে বন্দরকে 'পেপারলেস প্রতিষ্ঠানে' পরিণত করা সম্ভব হবে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ১৩৬ তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে সাংবাদিকদের সাথে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় এসব কথা বলেন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান। মঙ্গলবার (২৫ এপ্রিল) দুপুরে শহীদ মো. ফজলুর রহমান মুন্সী অডিটোরিয়ামে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়।
মতবিনিময় সভায় লিখিত বক্তব্যে বন্দর চেয়ারম্যান বলেন, 'বন্দরে জাহাজের গড় অবস্থানকাল বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি নির্দেশক। বর্তমানে কনটেইনারবাহী জাহাজ বহির্নোঙরে আসার এক থেকে দুই দিনের মধ্যে জেটিতে ভিড়ছে, ক্ষেত্রবিশেষে অন-এ্যারাইভাল বার্থিং প্রদান করা হচ্ছে।'
'করোনা অতিমারির বিশ্বের বিভিন্ন বড় বড় বন্দর মারাত্মক কনজেশনের কবলে পড়ে শাটডাউন হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন ধরণের অন্তবর্তীকালীন ব্যবস্থা গ্রহণ করায় বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি স্বাভাবিক ছিল। করোনাকালীন বন্দর সেবা নিরবচ্ছিন্ন রাখতে আমরা বন্দরের ৫৬ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে হারিয়েছি।'
তিনি বলেন, 'চট্টগ্রাম বন্দরের পোর্ট লিমিট ৭ নটিক্যাল মাইল থেকে ৬২ নটিক্যাল মাইলে উন্নীত করা হয়েছে। রপ্তানি কনটেইনার স্ক্যান করতে ২টি আধুনিক স্ক্যানার সংগ্রহের কার্যক্রম চলমান রয়েছে, যা ২০২৩ সালের জুন নাগাদ স্থাপন সম্ভব হবে। হামিদচরে লাইটারেজ জেটি তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। বন্দরের পাইলটদের দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ভবিষ্যতে ২১০ মিটার লম্বা ও সাড়ে ১০ মিটার জাহাজ ভিড়ানো যাবে।'
তিনি বলেন, 'ট্রানজিট ট্রান্সশিপমেন্টের জন্য চট্টগ্রাম বন্দর সক্ষম। ইতিমধ্যে ভারতের ট্রান্সশিপমেন্টের কয়েকটি ট্রায়াল রান সফল হয়েছে। কর্ণফুলির ক্যাপিটাল ড্রেজিং সম্পন্ন করেছি আমরা। বন্দরের বার্থিং ডিজিটালি হয়ে থাকে। এটা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।'
বন্দর চেয়ারম্যান বলেন, বে-টার্মিনাল এবং কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলায় "মাতারবাড়ী পোর্ট ডেভেলপমেন্ট" শীর্ষক প্রকল্পসমূহের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হলে চট্টগ্রাম বন্দরের বর্তমান সক্ষমতা বেড়ে যাবে প্রায় তিন থেকে চারগুণ। চলতি বছরে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দরের টার্মিনালের নির্মাণ কাজ শুরু হবে।
পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনালটি আন্তর্জাতিক বে-সরকারি অপারেটর দ্বারা পরিচালনার জন্য সরকারী সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে পিপিপি কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ট্রানজেকশন এডভাইজার হিসাবে আইএফসি-কে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আইএফসি কর্তৃক ট্রানজ্যাকশন স্ট্রাকচার রিপোর্ট (টিএসআর) দাখিল করার পর এ বিষয়ে পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ কর্তৃক কন্টেইনারজাত পণ্যের স্টাফিং, আন-স্টাফিং ও ক্লিয়ারিং সহজীকরণের নিমিত্তে টিওএস (টার্মিনাল অপারেটিং সিস্টেম) এবং বার্থিং ও আনবার্থিং সংক্রান্ত দাপ্তরিক কার্যাবলী অনলাইনে সম্পাদনের লক্ষ্যে ডিজিটাল বার্থিং ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছে।
বন্দর চেয়ারম্যান বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরে ১৯৭৭ সালে ৬টি কন্টেইনার দিয়ে কন্টেইনার পরিবহন শুরু হয়। বর্তমানে প্রতিবছর চট্টগ্রাম বন্দর ৩০ লাখের বেশি কন্টেইনার পরিবহন করে।
বন্দরের টাকায় নির্মিত পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল, নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল বিদেশি অপারেটরদের দ্বারা পরিচালনার সিদ্ধান্তের বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'এটি রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের আলোকে হচ্ছে। সেবার মান প্রতিযোগিতামূলক করতে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। এতে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। এর ফলে বন্দরের সেবা কার্যক্রমে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হবে।'
বন্দর চেয়ারম্যান বলেন, ইতিপূর্বে চট্টগ্রাম বন্দর হতে আরএমজির রপ্তানি চালান সিঙ্গাপুর, কলম্বো, পোর্ট কেলাং, তানজুং পেলাপাস বন্দরের মাধ্যমে ইউরোপের বিভিন্ন চূড়ান্ত গন্তব্যে পৌঁছতে ২৮-৩০ দিন সময়ের প্রয়োজন হতো। খরচ হতো প্রায় ২০ হাজার মার্কিন ডলার। তৈরি পোশাক খাতকে সহায়তা প্রদানের জন্য চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের অনুরোধে বিভিন্ন শিপিং কোম্পানি চট্টগ্রাম হতে ইউরোপের বেশ কয়েকটি বন্দরে সরাসরি শিপিং সার্ভিস চালু করেছে।
ট্রান্সশিপমেন্ট বিলম্ব না থাকায় ১২-১৫ দিনের মধ্যে ১০ হাজার হতে ১২ হাজার মার্কিন ডলার খরচে পণ্য ইউরোপের বিভিন্ন চূড়ান্ত গন্তব্যে পৌঁছাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে সময়সাশ্রয় হচ্ছে ১৫-১৬ দিন এবং প্রতি কন্টেইনার পণ্যে অর্থ সাশ্রয় হচ্ছে প্রায় ৮ হাজার মার্কিন ডলার।
তিনি আরো বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ইউএসএ রুটে সরাসরি জাহাজ চলাচলের সুযোগ রয়েছে। সরাসরি জাহাজ চলাচলে রপ্তানি খাত ব্যাপকভাবে লাভবান হওয়ায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ সরাসরি জাহাজ চলাচলের বিষয়টিকে উৎসাহিত করছে। কোন প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম বন্দর হতে ইউএসএ রুটে সরাসরি জাহাজ চলাচল সেবা চালু করতে আগ্রহী হলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তা বিবেচনা করা হবে।
মতবিনিময় সভায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য সহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।