‘মহামারিকালে গণমাধ্যমকর্মীদের ছাটাই ও বেতনভাতা না কমিয়ে বিকল্প উপায় খুঁজুন’

মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে দেশের গণমাধ্যমগুলো থেকে সংবাদকর্মীদের ছাটাই না করে এবং বেতনভাতা না কমিয়ে বিকল্প উপায়ে সমস্যার সমাধানের জন্য মালিকদের অনুরোধ করেছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতার শিক্ষক ও গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকরা।
সোমবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এ দাবি জানান তারা।
বিবৃতিতে তারা বলেন, ''করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে আমরা শারীরিক দূরত্বের কৌশল নিয়েছি। কিন্তু বিপদে সুরক্ষা পেতে আমাদের সামাজিক মানসিক নৈকট্য ও পেশাগত বন্ধন এখন অতীব জরুরি। এমন এক বাস্তবতায় আমরা দেশের গণমাধ্যমের বর্তমান সংকট সম্পর্কে এমন কিছু খবর পাচ্ছি যা আমাদেরকে উদ্বিগ্ন করে তুলছে। আমরা জানতে পেরেছি, কোভিড-১৯ মোকাবেলার জন্য মার্চ মাসের শেষে সাধারণ ছুটি ঘোষিত হবার এক মাসের মাথায় অনেক সংবাদপত্র ও টেলিভিশন চ্যানেলের মালিক/কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতিষ্ঠানের সাংবাদিক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের ঈদের বোনাস না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সুপ্রতিষ্ঠিত ও লাভজনক এবং বাজারনেতা হিসেবে পরিচিত গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘকাল ধরে দেওয়া বোনাসের পরিমাণ চারভাগের তিনভাগ ছেঁটে ফেলা হয়। আমরা উদ্বেগের সাথে লক্ষ করছি যে, কোনো কোনো গণমাধ্যম বেতন কমানোসহ বিনা বেতনে সাংবাদিকদের বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো এমনকি বিপুল সংখ্যক সংবাদকর্মীকে চাকরি থেকে ছাঁটাইয়ের পরিকল্পনা করছে।"
তারা বলেন, "আমরা সচেতন আছি যে, করোনা ভাইরাসের কারণে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্থ এবং বহুক্ষেত্রে স্থবির হয়ে পড়েছে। এর বিরূপ প্রভাব গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়েছে, যেমন- বিজ্ঞাপন কমে গেছে, আয় কমেছে। ফলশ্রুতিতে লাভজনক শক্তিশালী গণমাধ্যম যেমন দুশ্চিন্তায় পড়েছে, তাদের চেয়ে অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রতিষ্ঠানগুলোর বিপদ আরও বেশি। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে অনেক গণমাধ্যমের বিজ্ঞাপনের টাকা বকেয়া রয়েছে, যা আদায়ও দুষ্কর হয়ে পড়েছে। সংবাদপত্রের বিক্রিতেও পড়েছে ভাটা। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি বেশ কঠিন হয়ে উঠেছে গণমাধ্যমের জন্য।"
"সকল প্রতিকূল বাস্তবতাকে বিবেচনায় নিয়ে সংবাদপত্র, বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলসহ সকল গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের মালিক ও সম্পাদকের কাছে আমাদের আকুল আবেদন- আপনাদের প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ না করে, কোন সংবাদকর্মী ছাঁটাই না করে, কারও বেতন ভাতা না কমিয়ে কীভাবে এই মহাসংকটে সবাইকে সাথে রেখে প্রতিষ্ঠান চালানো সম্ভব সেই উপায় ও কৌশল আপনারা সম্মিলিতভাবে বের করুন। নিজেদের ঐক্যবদ্ধ চিন্তাশক্তি, সৃজনশীল উদ্ভাবনী ক্ষমতা ও আর্থিক সক্ষমতাকে কাজে লাগালে, আমাদের বিশ্বাস, কাউকে বাদ না দিয়েও এই কঠিন সময়ে আপনারা জয়ী হবেন।"
বিবৃতিতে বলা হয়, সংবাদকর্মী ছাঁটাই ও চাকরি থেকে অব্যাহতি আর্থিক সংকট মোকাবেলার সাধারণ পন্থা। আধুনিক চিন্তাচেতনা ও প্রযুক্তির এ সময়কালে ছাঁটাইয়ের মত পুরনো কৌশলের আশ্রয় না নিয়েও কী করে সকল সংবাদকর্মীর জীবন-জীবিকাকে নিশ্চিত রেখে প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনা করা যায় সেই ভাবনা এখন জরুরি।
এ বিষয়ে গণমাধ্যম মালিকদের কয়েকটি পরামর্শ দিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, "এই ঘোর সংকটে জরুরি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকরা সরকারের কাছ থেকে সহজতম শর্তে ঋণ সহায়তা চাইতে পারেন, নিজেদের অন্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানে সংকটকালীন সহায়তা তহবিল আনতে পারেন, গণমাধ্যম মালিকদের সংগঠনগুলো সংকট থেকে উত্তরণের জন্য একটি যৌথ তহবিল গঠনের চিন্তা করতে পারেন। এসবের চাইতে আরও উন্নত সৃজনশীল চিন্তা মালিক-সম্পাদকদেরই আছে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।"
সাংবাদিকতা, গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের জীবন সুরক্ষায় সরকারি, বেসরকারি উভয় খাতেরই দায়িত্বশীল ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, "আপনারা মূলধারার গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিজ্ঞাপন কমানোর কোনো চিন্তা থাকলে তা পরিহার করুন। বরং সকলের স্বার্থে সাংবাদিকতার অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে এবং সকল সংকটে সাংবাদিকদের পেশাগত সুরক্ষা নিশ্চিত করতে গণমাধ্যমে আরও বেশি করে বিজ্ঞাপন দেওয়াসহ তাদের আয় বৃদ্ধির ক্ষেত্রে যথাসম্ভব সর্বোচ্চ ভূমিকা রাখুন। মনে রাখবেন, জনকল্যানমুখী সাংবাদিকতা আপনাদের সুরক্ষায়ও বিশাল ভূমিকা রাখে। ফলে সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার সুরক্ষায় ভূমিকা রাখার অর্থ নিজের সুরক্ষাকেই সংহত করা।"
বিবৃতিতে বলা হয়, "এই সময় যিনি চাকরি হারাবেন তার পক্ষে আরেকটি চাকরি বা আয়ের উপায় খুঁজে বের করা বর্তমান বাস্তবতায় অসম্ভব। তখন সেই সংবাদকর্মী শুধু নয়, তাঁর গোটা পরিবারই হবে বিপন্ন। আপনারা সবাই সামান্য ত্যাগ স্বীকার করে হলেও প্রত্যেক সংবাদকর্মী ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের জীবন, জীবিকা এবং সুস্থভাবে বেঁচে থাকার বিষয়টি নিশ্চিত রাখবেন, এটা আমাদের আকুল আবেদন। কারণ, সংবাদকর্মীরা টিকে থাকলেই তথ্যের প্রবাহ নিশ্চিত থাকবে। আর এই সঠিক তথ্য ও সৎ-সাহসী সাংবাদিকতা কত জরুরি তা আমরা সবাই অনুধাবন করতে পারছি।"
বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারী শিক্ষকরা হলেন-
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সাখাওয়াত আলী খান, অধ্যাপক ড. গোলাম রহমান, অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, অধ্যাপক ড. শেখ আবদুস সালাম, অধ্যাপক ড. মফিজুর রহমান, আবদুর রাজ্জাক খান, মোঃ আসাদুজ্জামান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. দুলাল চন্দ্র বিশ্বাস, অধ্যাপক ড. প্রদীপ কুমার পাণ্ডে, মামুন আ. কাইউম, আমেনা বেগম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক উজ্জল মণ্ডল, শেখ আদনান ফাহাদ, সালমা আহমেদ, নিশাত পারভেজ, সুমাইয়া শিফাত, মৃধা মোঃ শিবলী নোমান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. আলী আজগর চৌধুরী মো. শহীদুল হক, শিক্ষক, মো. আবুল কালাম আজাদ, মুহাম্মদ যাকারিয়া, মাধব দীপ, এ কে এম জিয়াউর রহমান, রাজীব নন্দী, রেজাউল করিম, সুদীপ্ত শর্মা, মোঃ আসাদুজ্জামান, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. মিনহাজ উদ্দিন, জাকারিয়া খান, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মাহবুবুল হক ভূঁইয়া, কাজী এম. আনিছুল ইসলাম, মাহমুদুল হাসান, অর্ণব বিশ্বাস, আলি আহসান, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মামুন অর রশিদ, ছোটন দেবনাথ, নিশাত তারান্নুম, সাফায়েত হোসেন, মোঃ মাহদী-আল-মুহতাসিম নিবিড়, মো: উজ্জল তালুকদার, শরীফুল ইসলাম, শামিম হোসেন, ফারজানা তাসনিম পিংকি, মাজিদুল ইসলাম, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তাবিউর রহমান প্রধান, মোঃ সারোয়ার আহমাদ, সহিবুর রহমান, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শরীফা শিরিন, ইমরান হোসেন, মনিরা বেগম, মোঃ ফরহাদ উদ্দীন, ফরহাদ উদ্দিন, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ড. শেখ শফিউল ইসলাম, ড. তৌফিক ইলাহি, গ্রিন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের শিক্ষক ড. মো. অলিউর রহমান, স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের শিক্ষক তপন মাহমুদ, অ্যামেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের শিক্ষক আফরোজা সোমা, বাংলাদেশ ইউনিভাসিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) শিক্ষক প্রিয়াংকা কুণ্ডু এবং মো. আশরাফুল গনি।
বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারী সাংবাদিকরা হলেন-
নাদীম কাদির, সুকান্ত গুপ্ত অলক, জ. ই. মামুন,,অশোক চৌধুরী, প্রণব সাহা, নজরুল ইসলাম মিঠু, মুন্নী সাহা, সাইফুল ইসলাম, আশিষ সৈকত, জুলফিকার আলি মাণিক, প্রভাষ আমিন, ফাহিম আহমেদ, তালাত মামুন, রঞ্জন সেন, দেবাশীষ রায় ও দীপ আজাদ।