শিশুদের বেশি ভোগাচ্ছে ডেঙ্গু, চিকিৎসা দিতে হাসপাতালে হিমশিম

মাত্র সাড়ে তিন মাস বয়সের শিশু মুনতাহাকে নিয়ে গত ১১ দিন ধরে ঢাকা শিশু হাসপাতালে আছেন শিশুটির মা-বাবা। গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহে এ মাসের শুরুর দিকে মুনতাহার জ্বর দেখা দেয়। স্থানীয় ক্লিনিকে গিয়ে ডাক্তারের পরামর্শে ওষুধ সেবনের পরেও কিছুতেই জ্বর না কমায় ডাক্তার ডেঙ্গু টেস্ট করানোর পরামর্শ দেন। রিপোর্টে ডেঙ্গু পজিটিভ আসলে ৬ তারিখ তাকে ঢাকা শিশু হাসপাতালে ভর্তি হয়।
মুনতাহার বাবা আরিফুজ্জামান টিবিএসকে বলেন, "ওর প্লাটিলেট সংখ্যা গতকাল মাত্র নয় হাজারে নেমে এসেছে। ডাক্তারের পরামর্শে প্লাটিলেটও দিতে হয়েছে। ঝিনাইদহে ক্লিনিকে ভর্তি করানোর পর মুনতাহার নিউমোনিয়া ধরা পরে। গায়ে জ্বর ছিলো প্রথম থেকেই। আবার ছোট বাচ্চা হওয়ায় খেতেও পারে না খুব। সর্বশেষ রিপোর্টে শুধু প্লাটিলেট কম এসেছে, বাকি সবই ভালো। এটা নিয়েই ভয়ে আছি।"
শিশু মুনতাহার পাশের বেডেই ১৮ মাসের শিশু আজান আহমেদকে নিয়ে সোমবার থেকে ভর্তি আছেন শিশুটির মা আয়শা আক্তার। শিশুটির প্লাটিলেট এখন একটু বাড়লেও খাওয়া-দাওয়া তেমন করতে না পারায় ডাক্তার বলছে কিডনিতে সমস্যা হতে পারে।
শিশুর মা রাজধানীর মিরপুর ৬০ ফিটের বাসিন্দা আয়শা আক্তার টিবিএসকে বলেন, "আজানের জ্বর ১০৪ থেকে নিচে নামতো না প্রথম দিকে। এখন জ্বর একটু কম থাকলেও ডাক্তার বললো রিস্ক আছে। স্যালাইনের মাধ্যমেই ওর খাবার দেওয়া হয়।"
তিনি আরও বলেন, "বাসার আশপাশে অনেক গাছ রয়েছে। এসব জায়গায় মশা জন্মে। সিটি করপোরেশন থেকে তেমন ফগিং করতে দেখা যায় না। প্রধান সড়কের আশপাশে মাঝে মাঝে ফগিং করতে দেখা গেলেও গলির ভিতরে মশা নিধনের তেমন কোনো ব্যবস্থা চোখে পড়ে না।"
শুধু ঢাকা শিশু হাসপাতালেই নয় রাজধানীর বাকি হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নেওয়া রোগীদের মধ্যে শিশুদের সংখ্যা উদ্বেগ ছড়াচ্ছে। ঢাকা শিশু হাসপাতালে এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ১০ শিশু।
দেশে এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হওয়া ৫৭ জনের মধ্যে একটি বড় অংশই শিশু বলে জানিয়েছে হাসপাতালগুলো।
ঢাকা শিশু হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য মাত্র ১৬ শয্যার ব্যবস্থা থাকলেও শুক্রবার পর্যন্ত ভর্তি আছে মোট ৫৯ শিশু। সাধারণ রোগীর সঙ্গেও রাখতে হচ্ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের। অনেকে আবার টানাচ্ছেন না মশারি।
ডেঙ্গু ও সাধারণ ওয়ার্ডে শিশু রোগীর স্বজনদের সঙ্গে আসা ছোট-বড় শিশু কিংবা অন্য যে কেউ যেকোনো মুহূর্তে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
কর্মরত এক নার্স বলেন, "এখানে সাধারণ রোগীদের মধ্যেও ডেঙ্গু রোগী রাখতে হচ্ছে। অনেক রোগী আবার দিনে মশারি টানাতে চান না। এখানে শয্যার চেয়ে রোগীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় এত চাপ সামলাতে আমাদের হিমশিম খেতে হয়।"
ঢাকা শিশু হাসপাতালের ইমারজেন্সি মেডিকেল অফিসার আফরোজা ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছরের শিশু ডেঙ্গু রোগীরা আরও বেশি সংকটজনক অবস্থায় আসছে। প্লাটিলেট খুব দ্রুত কমে যাওয়ায় বাচ্চারা শকে চলে যাচ্ছে। ফলে শিশুদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য মূল্যায়ন করতে খুব কম সময় পাওয়া যাচ্ছে। লোকবল কম ফলে রোগীদের চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।"
রাজধানীর হাসপাতালগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক রোগী ভর্তি আছে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে। এখানে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত ভর্তি আছেন ১৫৮ জন ডেঙ্গু রোগী। রোগীর ২য় সর্বোচ্চ সংখ্যক ভর্তি আছে ঢাকা শিশু হাসপাতালে।
ঢাকা শিশু হাসপাতালে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত মোট ৬১৮ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। এ পর্যন্ত চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ১০ জন। সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছে ৫৫০ শিশু।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে, শুক্রবার সকাল আটটা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১৬৩ জন রোগী দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। যাদের মধ্যে এ মাসের ১৭ দিনেই ভর্তি হয়েছেন চার হাজার ৮৭২ জন। এ বছর আক্রান্ত মোট ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ২২৮ জনে। চিকিৎসা শেষে এ বছর হাসপাতালের ছাড়পত্র নিয়ে বাসায় ফিরেছেন ১৩ হাজার ৯৮০ জন।
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে এ বছর মোট ৫৭ জন মৃত্যুবরণ করেছেন। এ মাসের ১৭ দিনে মারা গেছেন ১১ জন।
বর্তমানে ঢাকার ৪১টি হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, এ হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিচ্ছেন এক হাজার ১৯১ জন এবং রাজধানীর বাইরের জেলাগুলোতে চিকিৎসা নিচ্ছেন ২০৩ জন ডেঙ্গু রোগী।
ঢাকা সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের সভাপতি ড. মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, "এখন ঢাকার ডেঙ্গুর রোগী সংখ্যা কমলেও ঢাকার বাইরে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। অনেকেই ঢাকার বাইরে আক্রান্ত হয়ে ঢাকায় চিকিৎসা নিতে আসছেন, তবে এ সংখ্যা খুব বেশি না। ঢাকায় রোগী কমলে এর ওপর সিটি করপোরেশনের বিন্দুমাত্র হাত নেই। তা স্বাভাবিকভাবেই কমবে।"
ঢাকায় এখন পর্যন্ত প্রায় তিন লাখের বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে উল্লেখ করে এ কীটতত্ত্ববীদ বলেন, "ঢাকায় আক্রান্ত ডেঙ্গু রোগী অধিকাংশই বাসায় ট্রিটমেন্ট নিয়েছেন। আর সিটি কর্পোরেশনের দুর্বল ব্যবস্থাপনায় এ সংখ্যা বেড়েছে। ঢাকায় এ বছর আরও তিন লাখের মতো লোক ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হবেন।"