নানা কারণে শিক্ষকতা পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে তরুণরা

বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের ৩৪তম নন-ক্যাডারে প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাবার পর রফিক ভেবেছিলেন, শিক্ষা ব্যবস্থা আমূল বদলে ফেলবেন তিনি। গাইবান্ধার একটি স্কুলে যোগ দেবার সময় প্রচুর উদ্যম ছিল তাঁর। প্রাথমিক শিক্ষা স্তরে নিজের স্কুলটির অবস্থান উপরে রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন তিনি।
কিন্তু স্বপ্নভঙ্গ হতে বেশি সময় লাগেনি। তাই একসময চাকরিটা ছেড়েই দিলেন রফিক।
কম বেতন, পেশার প্রতি সামাজিক মর্যাদার অভাব আর অন্যসব সুযোগের অনপুস্থিতি তাঁকে এমন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছে। রফিক পরে যোগ দেন বাংলাদেশ ব্যাংকে।
দেশের শিক্ষকতা পেশায় তরুণদের আগ্রহের অবস্থা বোঝার ক্ষেত্রে রফিক একটিমাত্র উদাহরণ। ৩৪তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে যোগ দেওয়া পাঠান মোহাম্মদ সাইদুজ্জামান বললেন, “জাতিগঠনে শিক্ষকদের ভূমিকা মৌলিক। কিন্তু বাংলাদেশে শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা নেই। এজন্য মেধাবী শিক্ষার্থীরা এ পেশা ত্যাগ করছেন।”
পাঠান নিজেও শিক্ষকতা করতেন একসময়।
সরকার ৩৪তম নন-ক্যাডার বিসিএসে ৮৯৮ জন এবং পরে ৩৬তমের মাধ্যমে ৩৫০ জনকে প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন। এটি দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তার পদ। কিন্তু নিয়োগপ্রাপ্তদের কমপক্ষে ষাট শতাংশ পরে চাকরি ছেড়ে দেন।
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আর্থিক অবস্থান ও সামাজিক মর্যাদা উচ্চতর। কিন্তু মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের, এমনকি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ পর্যায়ের শিক্ষকদের অবস্থা তেমন নয়।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের ২০১৭ সালের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ষাট শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করে, সৃজনশীল প্রশ্ন ঠিকঠাক বোঝার জন্য তাদের ব্যক্তিগতভাবে শিক্ষকের কাছে পড়া দরকার।
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিপ্তরের আরেকটি রিপোর্টে দেখা গেছে, পঞ্চাশ শতাংশ শিক্ষক সৃজনশীল প্রশ্নপত্র তৈরি করতে পারেন না।
বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের উপাত্ত থেকে দেখা যায়, ৪০তম বিসিএসে ১৯০৩টি পদের বিপরীতে আবেদন পড়েছে ৪ লাখ ১২ হাজার। কিন্তু তাদের ১ শতাংশেরও কম প্রথম পছন্দের পদ হিসেবে সাধারণ শিক্ষায় আবেদন করেছেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সরকার এ বিষয়ে জানেন। তাই এ খাতে সংস্কার খুব জরুরি।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ আকরাম-আল-হোসেন এ প্রসঙ্গে বললেন, “শিক্ষকদের বেতন-বৈষম্য দূর করতে কাজ করছি আমরা।”
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ সোহরাব হোসেনও জানালেন, শিক্ষকদেরকে সম্মানজনক একটা জায়গায় নেবার চেষ্টা করছেন তারা। শিক্ষক প্রশিক্ষণে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে যাতে প্রশিক্ষিত শিক্ষকরা জাতির জন্য মানসম্পন্ন জনগোষ্ঠী তৈরি করতে পারেন।
ওদিকে, শিক্ষাবিদ ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সঙ্গে কথা বললে তিনি বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার সমালোচনা করলেন।
তাঁর মতে, “সৃজনশীল প্রশ্নগুলোর টেক্সট বইয়ের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক থাকে না। সৃজনশীল প্রশ্ন বলতে কী বোঝায় সে বিষয়ে শিক্ষক বা শিক্ষার্থী কারও সুস্পষ্ট ধারণা নেই। এর ফলে গাইড বই ও কোচিংগুলোর ওপর নির্ভরশীলতা তৈরি হচ্ছে।”
শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলামও শিক্ষকদের সামাজিক মূল্য ও উচ্চ বেতন নিশ্চিত করার জন্য সরকারি উদ্যোগের কথা বললেন।
“শিক্ষকদের পেশাগত জ্ঞান ও দক্ষতা মানসম্পন্ন শিক্ষার জন্য সবচেয়ে জরুরি। এজন্য তাদের জোরদার প্রশিক্ষণ প্রদান ও নিয়মিত পেশাগত উন্নয়নের ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের দক্ষতা বাড়ানো ও শিক্ষণের ফলাফল প্রয়োগেও সমর্থন জোগানো দরকার,” বললেন এই শিক্ষাবিদ।
শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও তার ফলাফল
দেশজুড়ে প্রায় ১ লাখ ৩৪ হাজার সরকারি ও বেসরকারি স্কুল রয়েছে। সেখানে ৬ লাখ ২৪ হাজার শিক্ষক কাজ করছেন। ৬৫ হাজার সরকারি স্কুলে রয়েছেন ৩ লাখ ৭০ হাজার শিক্ষক।
এই শিক্ষকদের প্রায় ২ লাখ ৩৯ হাজার সার্টিফিকেট-ইন-এডুকেশন প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। আর ১১ হাজার ৩১২ জন নিয়েছেন ডিপ্লোমা-ইন-এডুকেশন সার্টিফিকেট।
বিশ্ব ব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশের স্কুলগুলোতে বিশাল শিক্ষা-বৈষম্য রয়ে গেছে। তৃতীয় শ্রেণি-উত্তীর্ণদের ৩৫ শতাংশ ঠিকভাবে বাংলা পড়তে পারে না। প্রধানত শিক্ষকতা পেশার নিম্নমানের কারণেই শিক্ষার মানের এমন অবনমন ঘটেছে বলে বিশ্ব ব্যাংক তাদের পর্যবেক্ষণে দেখেছে।
বিশ্ব ব্যাংকের রিপোর্টে বলা হয়েছে:
“বাজারের প্রয়োজন অনুযায়ী দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরি করতে চাইলে বাংলাদেশকে যথাযথ ও মানসম্পন্ন শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করতে হবে। সে সঙ্গে গবেষণা বাড়াতে হবে এবং সবার সমান অংশগ্রহণে উচ্চতর শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।”
বাংলাদেশ ব্যুরো অব এডুকেশনাল ইনফরমেশন এন্ড স্ট্যাটিসটিকসের মতে, ২০ হাজার ৪৬৭টি মাধ্যমিক স্কুলের ২ লাখ ৪৪ হাজার শিক্ষক প্রশিক্ষণ পেয়ে থাকেন। তার মানে, এটি মোট সংখ্যার ৬৩ শতাংশ।
ওদিকে, মাদ্রাসা শিক্ষকদের মাত্র ২১ শতাংশ প্রশিক্ষণ পেয়েছেন।
শিক্ষক দিবস ২০১৯
এসব বাস্তবতায় বাংলাদেশ আজ বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালন করছে। এবারের শিক্ষক দিবসের প্রতিপাদ্য: ‘তরুণ শিক্ষক: শিক্ষকতা পেশার ভবিষ্যৎ’। ১৯৯৫ সাল থেকে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। শিক্ষকদের সম্মান জানাতে ও ভবিষ্যত প্রজন্মের চাহিদার বিষয়গুলো মাথায় রেখে দিবসটি পালন করা হয়।
জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের ৪ নম্বরে রয়েছে ২০৩১ সালের মধ্যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় সর্বজনীনতা অর্জন। জাতিসংঘ মনে করছে, এই লক্ষ্যে পৌঁছুতে হলে মানসম্পন্ন শিক্ষকের সংখ্যা বাড়ানো জরুরি।