দুই দশকের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানছে বাংলাদেশ ও ভারতে

সমুদ্র পৃষ্ঠের আবহাওয়া পরিস্থিতির দিকে সার্বক্ষণিক নজর রাখে যুক্তরাষ্ট্রের আবহাওয়া অধিদপ্তর ও নাসা। দেশটি বঙ্গোপসাগরে জন্ম নেওয়া ঘূর্ণিঝড় আম্পানকে পঞ্চম শ্রেণির হ্যারিকেন হিসেবে উল্লেখ করেছে।
তবে এরই মধ্যে কিছুটা শক্তি হারিয়ে আম্পান সুপার সাইক্লোন থেকে এক্সট্রিম সিভিয়ার সাইক্লোনে পরিণত হয়েছে। তারপরও ক্ষয়ক্ষতি সৃষ্টি করার মতো যথেষ্ট শক্তি আম্পানের রয়েছে।
সেই প্রলয়ঙ্করী শক্তি নিয়ে ঝড়টি আজ দিনের মধ্যেই আঘাত হানবে বাংলাদেশের খুলনা ও চট্টগ্রামের মধ্যবর্তী অঞ্চলে। প্রতিবেশী ভারতের দুই পুর্বাঞ্চলীয় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ ও উড়িষ্যাও আম্পানের কবলে পড়বে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর এর আগে আজ বুধবার বিকেল নাগাদ আম্পান ভূমিতে আছড়ে পড়বে বলে পূর্বাভাস দেয়।
গত ২০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী এই ঝড়ের তাণ্ডব থেকে প্রাণ বাঁচাতে ইতোমধ্যেই লাখ লাখ উপকূলীয় অঞ্চলের বাসিন্দাকে নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে নিয়েছে বাংলাদেশ ও ভারত।
আম্পানে প্রাণহানির পাশাপাশি উপকূলীয় এলাকার ঘরবাড়ি, ফসল, গবাদিপশু এবং বনজ সম্পদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে সড়ক ও রেলপথে যোগাযোগ এবং বৈদ্যুতিক সংযোগের লাইন।
উভয় দেশেই স্থানীয় কর্তৃপক্ষের জন্য এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ চলমান করোনাভাইরাস মহামারি। আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করার জটিলতাও মাথায় রাখতে হচ্ছে তাদের।
টানা দুই মাস ধরে লকডাউন চলায় ভারত ও বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অবস্থা এখন শোচনীয়। দিন এনে দিন খেতেন- এমন দিনমজুরেরা এখনো ঘরে ফেরার চেষ্টা করছেন। এরমধ্যেই ধেয়ে এলো আম্পান।
ঝুঁকি শুধু বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য নয়, রয়েছে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্যও। উপকূলীয় জেলা কক্সবাজারের কয়েকটি ক্যাম্পে এখন প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বসবাস করছেন।
বঙ্গোপসাগর থেকে ধেয়ে আসা আম্পান-ভারতের পূর্বাঞ্চল এবং বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে আঘাত হানার সময় বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ১৮৫ কিলোমোটার পর্যন্ত হতে পারে।
ভারতীয় আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, বাতাসের প্রভাবে সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ১০ থেকে ১৬ ফুট পর্যন্ত বা দুই তলা বাড়ির সমান হবে।
ভারত এবং বাংলাদেশের উপকূলে বসবাসরত লাখ লাখ অতি-দরিদ্র মানুষের মাটি ও ছনের তৈরি বাড়ি এমন ঢেউয়ের আঘাতে একেবারে মাটিতে মিশে যেতে পারে। উপকূলজুড়ে সমূলে উৎপাটিত হবে লাখ লাখ গাছ; ভেঙ্গে পড়বে যোগাযোগের লাইন, মোবাইল ফোনের টাওয়ার; তলিয়ে যাবে মহাসড়ক ও রেলপথ।
ঘূর্ণিঝড় ও দ্বিতীয় পক্ষের চাঁদের সময়ের শেষ দিনের প্রভাবে উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী ও চট্টগ্রাম এবং অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলোর নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ১০-১৫ ফুট অধিক উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর।
ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৮৫ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ২০০ কিলোমিটার, যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ২২০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ঝড়ের তীব্রতা এমন যে, ভারতের উড়িষ্যা এবং পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে ফসল এবং ফল বাগানের ব্যাপক ক্ষতি আশঙ্কা করছে স্থানীয় সরকার। গতকালের আবহাওয়া বুলেটিনে জানানো হয়, ওই দুই রাজ্যের সমুদ্রবন্দরে নোঙ্গরে থাকা জাহাজগুলো মুরিংয়ের দড়ি থেকে বিচ্যূত হয়ে যেতে পারে।
ভারতের জন্য আম্পান সার্বিক অবস্থাকে আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। দেশটি এখন সমগ্র এশিয়ার মাঝে করোনাভাইরাসের নতুন 'হটস্পট', এতে এক লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন সে দেশে। প্রাণহানির সংখ্যা ৩ হাজার ১৬৩।
মহাবিপদের পরিক্রমা
ভারতের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তারা একে মহাবিপদের মাঝে নতুন মহাবিপদ হাজির হওয়ার সঙ্গে তুলনা করেছেন।
'লোকজনকে নিরাপদ অঞ্চলে সরিয়ে নেওয়ার জন্য আমাদের হাতে মাত্র ছয় ঘণ্টা সময় রয়েছে, এর মধ্যেই সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করে তাদের সরিয়ে নিতে হবে। আম্পান হাজার হাজার কুড়েঘর আর ফসল মাটিতে মিশিয়ে দেবে'- বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে এমন আশঙ্কার কথা জানান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এসজি রাই।
আম্পানের গতিপথের মুখেই পড়ছে পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতা। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই অবস্থায় কলকাতার শত শত বছর পুরোনো দালানের বাসিন্দাদের প্রাণ সংশয়ের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন।