খুলনা, রংপুর, রাজশাহীতে করোনার উচ্চ সংক্রমণ অব্যাহত

সারাদেশে করোনা সংক্রমিত রোগী ও মৃতের সংখ্যা কমলেও বেড়েছে শনাক্তের হার। সংক্রমণের উচ্চ হার রেকর্ড করা হয়েছে খুলনা-রংপুর-রাজশাহী বিভাগে। সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোতে সংক্রমণের হার বিশ্লেষণে এই তথ্য পাওয়া গেছে।
এদিকে উচ্চ সংক্রমণের জায়গাগুলোতে তৈরি হয়েছে চিকিৎসা সংকট। বিষয়টি নিয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী বলেন, 'রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য আইসিইউ শয্যা রয়েছে মাত্র ১৮ টি অথচ প্রতিদিন আবেদন পড়ে ৭০ থেকে ৮০টি'।
'একারণে যাদের আইসিইউ সুবিধা দিতে পারছি না তাদের জন্য হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা ব্যবহার করতে হচ্ছে। হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা ব্যবহার করে তাদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া কোনো উপায় নেই। তবে বেশিরভাগ রোগী ফুসফুস বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর হাসপাতালে ভর্তি হওয়ায় তাদের বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ছে। উপসর্গ দেখা দেওয়ার পর চিকিৎসা শুরু হলে অনেকে রোগীকেই বাঁচানো সম্ভব হতো,' যোগ করেন তিনি।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যাপক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. চিন্ময় কান্তি দাস বলেন, 'হাসপাতালের বেশিরভাগ রোগীর মৃত্যুর পেছনে একটিই কারণ, ফুসফুসের খারাপ অবস্থার পর হাসপাতালে ভর্তি হওয়া। সঠিক সময়ে করোনা শনাক্তের পর চিকিৎসা নিলে এত রোগী মারা যেত না। কারণ এখন অনেকের ক্ষেত্রেই এমনটা হচ্ছে করোনা আক্রান্ত হওয়ার পর বুঝে উঠতেই পারছে না। অথচ ফুসফুস ততক্ষণে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেছে। এগুলো আসলে জনসাধারণের অসচেতনতা। এজন্য আমরা সবাইকে পরামর্শ দিচ্ছি যেকোনো জ্বর, সর্দি-কাশি হলেও যাতে পরীক্ষা করান। এতে সংক্রমিত হলো কিনা বোঝা যায় এবং সে অনুযায়ী চিকিৎসা নেওয়া সম্ভব হত। এর ফলে মৃত্যুর সংখ্যা অনেক কমানো সম্ভব'।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরামর্শক ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, 'শুধু বর্ডারের মাধ্যমে যারা দেশে প্রবেশ করছে তাদের আইসোলেশন করলে হবেনা। যেহেতু ডেল্টা ধরনের সংক্রমণ দ্রুত বিস্তার করে, এজন্য শনাক্ত রোগীকে সম্পূর্ণ আইসোলেশনে রাখতে হবে'।
অক্সিজেন প্রয়োজন এমন অধিক সংকটাপন্ন রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে জায়গা করে দিতে তুলনামূলক কম সংকটাপন্ন রোগীর হাসপাতালে চিকিৎসার প্রয়োজন নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'রোগীকে নিয়ে হুড়োহুড়ি করা যাবেনা। বরং আলাদা করে চিকিৎসার ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে'।
এসব জেলার একেবারে চলাচল একেবারে সীমিত করা না গেলে ভাইরাসের বিস্তার ত্বরান্বিত হতে পারে। এক্ষেত্রে কঠোর হলে দুই সপ্তাহের মধ্যে সংক্রমণ কমে আসবে বলে মনে করেন তিনি।
শনিবার দেশে ১ হাজার ৬৩৭ জন রোগী শনাক্তের তথ্য জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এই সংখ্যা আগের দিনের চেয়ে ৮ শতাধিক কম। এদিন সারাদেশে পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার ১৪ দশমিক ১২ শতাংশ। ৫১ দিনের মধ্যে যা সর্বোচ্চ। যেখানে শুক্রবার রোগী শনাক্তের হার ছিল ১৩ দশমিক ২৫ শতাংশ।
এর মধ্যে শনাক্তের হার বেশি লক্ষ্য করা গেছে খুলনা বিভাগে ৩০ দশমিক ৬৪, রংপুর বিভাগে ২৫ এবং রাজশাহী বিভাগে ১৮ দশমিক ২২ শতাংশ। যেখানে ঢাকা বিভাগে সংক্রমণের হার ৮ দশমিক ৬৩ শতাংশ।
যোগাযোগ করা হলে খুলনা বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. রাশেদা সুলতানা টিবিএসকে বলেন, 'আমরা পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য সম্ভাব্য সব ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। বিভাগের উচ্চ সংক্রমণের স্থানে চলাচল সীমিত করা হয়েছে'।
জনসাধারণ সরকারের দেয়া বিধিনিষেধ মেনে চললে পরিস্থিতি উন্নতির দিকে যাবে বলে মনে করেন তিনি।
দেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে করোনাভাইরাসের ডেল্টা ধরনের দাপটের মধ্যে এক সপ্তাহ ব্যবধানে রোগী শনাক্তের সংখ্যা বেশ বেড়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বুলেটিনে বলা হয়েছে, আগের (৩০ মে-৫ জুন) থেকে গত (৬ জুন-১২ জুন) সপ্তাহে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ২৭ দশমিক ২০ শতাংশ বেড়েছে। যেখানে নমুনা পরীক্ষা বেড়েছে ২.৪৩ শতাংশ। এই সময়ে মৃত্যু বেড়েছে ৭ দশমিক ১৪ শতাংশ।
রংপুর বিভাগীয় উপ-পরিচালক (পরিচালকের চলতি দায়িত্বে নিয়োজিত) ডা. আবু মো.জাকারিয়া ইসলাম বলেন, 'আমাদের এখানে রোগী সংখ্যা খুব বেশি না হলেও শনাক্তের হার স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি। পরিস্থিতি যাতে আরো অবনতির দিকে না যায়, সেজন্য স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে সার্বক্ষণিক নজরদারি করা হচ্ছে'।
এদিকে নতুন ১ হাজার ৬৩৭ জনকে নিয়ে দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ লাখ ২৪ হাজার ৪৮৬ জনে। সরকারি হিসাবে আক্রান্তদের মধ্যে একদিনে আরও ২ হাজার ১০৮ জন সুস্থ হয়ে উঠেছেন; এ পর্যন্ত সুস্থ মোট হয়েছেন ৭ লাখ ৬৪ হাজার ২৪ জন।
গত শনিবার ৩৯ জন কোভিড-১৯ রোগীর মৃত্যুর খবর দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, আগের দিন সংখ্যাটি ছিল ৪৩। এখন মোট মৃত্যের সংখ্যা ১৩ হাজার ৭১ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় সবচেয়ে বেশি ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে খুলনা বিভাগে। এছাড়া ঢাকা বিভাগে ১০ জন, রাজশাহীতে ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর বাইরে চট্টগ্রামে ৬ জন, বরিশালে ২ জন, রংপুরে ২ জন ও সিলেটে একজনের মৃত্যু হয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী, কোনো দেশে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে কি না, তা বোঝার একটি নির্দেশক হলো রোগী শনাক্তের হার। কোনো দেশে টানা দুই সপ্তাহের বেশি সময় পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে থাকলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে বলে ধরা যায়।
সেখানে বাংলাদেশের কোন বিভাগে এই মুহূর্তে শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে নেই। সর্বনিম্ন সংক্রমণের হার বরিশাল বিভাগে ৭ দশমিক ৪০ শতাংশ। সেই হিসেবে ১০ শতাংশের নিচে সংক্রমণ রেকর্ড হয়েছে ঢাকা, বরিশাল ও ময়মনসিংহ বিভাগে।