উপসাগরীয় দেশগুলোতে প্রবাসী শ্রমিকদের কোভিডে মৃত্যু বেশি: গবেষণা

২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কোভিডে আক্রান্ত হয়ে সিঙ্গাপুরে মাত্র দুজন প্রবাসী বাংলাদেশি মৃত্যুবরণ করলেও একই সময়ে উপসাগরীয় দেশগুলোতে মৃত্যুবরণ করেন এক হাজার ২৫৪ জন প্রবাসী কর্মী।
সম্প্রতি প্রকাশিত 'কোভিড-১৯ ডেথ ডিসপ্যারিটিজ অ্যামং ইন্টারন্যাশনাল মাইগ্র্যান্ট ওয়ার্কার্স অব সাউথ এশিয়ান অরিজিন: আ কমপ্যারেটিভ স্টাডি বিটুইন দ্য গালফ কোঅপারেশন কান্ট্রিজ অ্যান্ড সিঙ্গাপুর'-শীর্ষক গবেষণায় পাওয়া গেছে এই তথ্য। গত ৫ অক্টোবর 'গ্লোবাল হেলথ ইকোনমিক্স অ্যান্ড পলিসি' সাময়িকীতে গবেষণা পত্রটি প্রকাশিত হয়।
গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, গালফ কোঅপারেশন কাউন্সিলের (জিসিসি) দেশগুলোতে দক্ষিণ এশিয়ার ৮০ লাখ প্রবাসী শ্রমিকদের মধ্যে কোভিড আক্রান্ত হয়ে অন্তত দুই হাজার ২২৩ জন মৃত্যুবরণ করেন। অন্যদিকে, সিঙ্গাপুরে এক লাখ ১৯ হাজার প্রবাসী শ্রমিকের মধ্যে কোভিড আক্রান্ত হয়ে মাত্র দুজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
উপমহাসাগরীয় দেশগুলোতে প্রতি দশলাখে দক্ষিণ এশিয়ার প্রবাসী শ্রমিকদের মৃত্যুহার সিঙ্গাপুরের তুলনায় ২৭ গুণ বেশি।
এছাড়া গবেষণার তথ্য অনুসারে, সিঙ্গাপুরে করোনা শনাক্ত হওয়ার ৯৩ শতাংশই ছিলেন প্রবাসী কর্মী। অন্যদিকে, সৌদি আরবে এই হার ছিল ৭৬ শতাংশ।
বাংলাদেশের বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ড. এম সরোয়ার হোসেইন বলেন, "আন্তর্জাতিক প্রবাসী কর্মীদের জীবনযাত্রার মান ভালো না হওয়ায় দুক্ষেত্রেই স্থানীয় বাসিন্দাদের তুলনায় প্রবাসী কর্মীদের কোভিড আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা বেশি।"
জিসিসি অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, বাহরাইন, ওমান এবং কুয়েত, যেখানে প্রায় সাড়ে তিন কোটি প্রবাসী কর্মী কাজ করেন। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) হিসাব অনুসারে বৈশ্বিক অভিবাসী শ্রমিকদের ১০ শতাংশই এই দেশগুলোতে কাজ করতে যান।
আনুষ্ঠানিক নয় এমন একটি হিসাব অনুসারে, উপসাগরীয় দেশগুলোতে প্রায় ৫০ লাখ এবং সিঙ্গাপুরে প্রায় দেড় লাখ বাংলাদেশি কাজ করছেন।
সিঙ্গাপুর এবং জিসিসি অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে কিছু মিল রয়েছে। উভয়ক্ষেত্রেই একই ধারার অর্থনীতির (মাথাপিছু জিডিপি সমান) দেখা মিলে। প্রাপ্তবয়স্ক তরুণ প্রবাসী কর্মী বিশেষত দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর কর্মীদের প্রধান গন্তব্যস্থল হলো সিঙ্গাপুর এবং উপসাগরীয় দেশসমূহ।
চলতি বছরের জুন পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কোভিড আক্রান্ত হয়ে প্রায় দুই হাজার ৭০০ জন বাংলাদেশি মৃত্যুবরণ করেন। এর মধ্যে সৌদি আরবে সর্বোচ্চ ১,২০০ জনের মৃত্যু হয়। বিভিন্ন গণমাধ্যম ও প্রবাসী কমিউনিটির তথ্য এবং দেশের বাইরে বাংলাদেশি মিশনগুলোর প্রদত্ত তথ্য অনুসারে ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
উপসাগরীয় দেশগুলোতে প্রবাসীদের মৃ্ত্যুসংখ্যা এত বেশি কেন
জিসিসি অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর নিয়ম অনুসারে, নিয়মিত প্রবাসী কর্মীদের মৌলিক স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব নিয়োগদাতাদের। কিন্তু, গৃহস্থালী কর্মী এবং অনিয়মিত প্রবাসীরা বর্তমান রেগুলেশন ও নীতিমালা অনুসারে স্বাস্থ্যসেবা সুবিধাদি পান না। অথচ, প্রবাসী কর্মীদের একটি বড় অংশজুড়ে রয়েছেন তারা।
আনুষ্ঠানিক নয় এমন সূত্রানুসারে, সৌদি আরবে প্রায় ২২ লাখ বাংলাদেশি কাজ করছেন।
ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য রাইটস অব বাংলাদেশি ইমিগ্রেন্টস (ডব্লিউএআরবিই) ডেভলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুল হক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "মধ্যপ্রাচ্যে বিশেষত সৌদিতে যখন আমরা বাংলাদেশি কর্মীদের সাক্ষাৎকার নিই, তখন তারা যথাযথ চিকিৎসা না পাওয়ার অভিযোগ করেন। এমনকি নিয়োগদাতাদের অনেকে তাদের খবর রাখারও প্রয়োজন বোধ করেন না।"
"কোভিড-১৯ এর মতো বিপর্যয়ে অনিয়মিত কর্মীরাই মূল ভুক্তভোগীতে পরিণত হন। কেননা, পরিচয় প্রকাশ করে চিকিৎসা গ্রহণের বিষয়টি তারা এড়িয়ে যান," বলেন তিনি।
গবেষণা প্রতিবেদনের বক্তব্য অনুসারে, "জিসিসি দেশগুলোতে আন্তর্জাতিক প্রবাসী কর্মীদের প্রায় ১০ থেকে ১৫ শতাংশই অনিয়মিত। আইনি ব্যবস্থা থেকে বাঁচতে তারা আত্মগোপনের চেষ্টা করেন। ফলে, কোভিড জটিলতায় ভোগা অনিয়মিত প্রবাসী এবং গৃহস্থালী কর্মীদের শেষ মুহূর্তে হাসপাতালে নেওয়া হয়। এই দেরি করার কারণেই সম্ভবত জিসিসি দেশগুলোতে প্রবাসীদের মৃত্যুহার স্বাভাবিক নয়।"
এছাড়া, লকডাউন ও কারফিউ আরোপের ফলে সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা বৃদ্ধির পাশাপাশি কোভিড আক্রান্তদের দেরিতে ব্যবস্থা গ্রহণের সম্ভাবনার কথাও জানায় এই গবেষণা।
তবে, সৌদি আরবের জেদ্দায় নিয়োজিত বাংলাদেশের লেবার কাউন্সেলর মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "সৌদি আরবে বৈধ-অবৈধ সকল শ্রমিকদের বিনামূল্যে কোভিড-১৯ চিকিৎসা প্রদান করা হয়।"
সৌদি আরবে মৃত্যুসংখ্যার বেশি হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, "সম্ভবত অবৈধ প্রবাসীদের অধিকাংশই সরকারি ঘোষণা সত্ত্বেও বিনামূল্যে চিকিৎসা নিতে আসেননি।"
গবেষণা প্রতিবেদন অনুসারে, সিঙ্গাপুরে ইমিগ্রেশন আইন স্বচ্ছ থাকায় নিয়োগ প্রক্রিয়া যথাযথভাবে হয়। আর তাই অনিয়মিত বা অবৈধ অভিবাসী সংক্রান্ত জটিলতা অপেক্ষাকৃত কম।
এছাড়া, সিঙ্গাপুর বহুভাষাভাষী যোগাযোগ কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে কোভিড-১৯ পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছে। একইসঙ্গে সকল প্রবাসী কর্মীদের জন্য সহজে সরাসরি স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের ব্যবস্থাও করে তারা।
বাংলাদেশের ইনডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ড. এম সরোয়ার হোসেইন বলেন, "সিঙ্গাপুরে কর্মরত প্রবাসী শ্রমিকদের মধ্যে প্রায় ৪৭ শতাংশ করোনায় আক্রান্ত হন। কিন্তু তাদের মধ্যে মাত্র ২৫ জনের আইসিইউ দরকার পড়ে। সুপরিকল্পিতভাবে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের কারণেই সম্ভবত দেশটিতে মৃত্যুহার কম।"
অন্যদিকে, উপসাগরীয় দেশগুলোতে নতুনধারার জীবনযাত্রায় (জাঙ্ক ফুড খাওয়া, শারীরিক সক্রিয়তা কম) অন্যান্য শারীরিক জটিলতার প্রবণতা দেখা যায়। এখানে প্রবাসী কর্মীদের মৃত্যুসংখ্যা উচ্চ হওয়ার পেছনে এই কারণগুলোও ভূমিকা রাখতে পারে।
সাম্প্রতিক এক গবেষণার উল্লেখ করে গবেষকরা বলেন, জিসিসি দেশগুলোতে স্থানীয় বাসিন্দাদের তুলনায় প্রবাসী কর্মীদের স্থূলতা, উচ্চ রক্তচাপ এবং হতাশায় ভোগার ঝুঁকি উল্লেখজনকভাবে বেশি।
গত ১৪ সেপ্টেম্বর বিএমসি পাবলিক হেলথে প্রকাশিত 'ডিসিপ্যারিটিজ ইন এক্সসেস ডেথস ফ্রম দ্য কোভিড-১৯ প্যানডেমিক অ্যামং মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কার্স ইন কুয়েত'- শীর্ষক অপর এক গবেষণায় কুয়েতে কোভিড-১৯ আক্রান্ত প্রবাসী শ্রমিকদের মৃত্যুসংখ্যা অস্বাভাবিক হওয়ার বিষয়টি উঠে আসে।
"গবেষণার ফলাফলের সঙ্গে আমাদের এই গবেষণা সামঞ্জস্যপূর্ণ," বলেন ড. সরোয়ার।