দক্ষতায় ঘাটতি, নির্যাতন ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি—যে কারণে কমছে বাংলাদেশি নারী অভিবাসন
সুন্দর ও স্বচ্ছল জীবনের আশায় একরাশ স্বপ্ন নিয়ে সৌদি আরবে পাড়ি দিয়েছিলেন মোকসুদা বেগম। বিধবা হওয়ার পর নারায়ণগঞ্জে দুই সন্তানকে একাই লালন-পালন করছিলেন তিনি। ভেবেছিলেন, বিদেশে গিয়ে কাজ করলে সংসারের টানাপোড়েন কিছুটা হলেও কমবে। দালালও আশ্বাস দিয়েছিল—সৌদিতে গিয়ে কাজ করলে মাসে অন্তত ২২ হাজার টাকা বেতন পাবেন। সেই আশায় নতুন স্বপ্ন বুনেছিলেন মোকসুদা।
তবে বাস্তবতা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। সৌদি আরবে পৌঁছে তিনি কাজ পেলেন গৃহকর্মী হিসেবে—রান্না, ঘর পরিষ্কার থেকে শুরু করে বাড়ির নিত্যকাজের সব দায়িত্বই তার কাঁধে এসে পড়ে।
"তারা আমাকে ভোর ৪টায় ঘুম থেকে উঠতে বাধ্য করত। নাশতা বানানো থেকে শুরু করে রাত পর্যন্ত একটানা কাজ করতে হতো। এরমধ্যে বিশ্রামের কোনো সুযোগ ছিল না। ঘুমও হতো খুব কম," বললেন মোকসুদা।
এই কষ্টটাও হয়তো তিনি মেনে নিতেন, যদি তাকে প্রতিশ্রুত বেতনটা ঠিকমতো হাতে দেওয়া হত। কিন্তু মোকসুদার বেতন চলে যেত সৌদি আরবের এজেন্টের কাছে—যিনি কখনোই সেই টাকা তার হাতে তুলে দেননি।
"ছয় মাস কাজ করে আমি মোটে ২০ হাজার টাকা পেয়েছি। এটা আমার এক মাসের প্রতিশ্রুত বেতনের চেয়েও কম। তার ওপর নানা ধরনের নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে," বলেন মোকসুদা।
তিনি জানান, কর্মস্থলে তার মালিক তাকে মারধর করতেন, চুল ধরে টেনে নিয়ে যেতেন এবং রাগের মাথায় বারবার রান্নাঘর পরিষ্কার করাতেন।
দেশে ফিরে আসা ডালিয়া নামের আরেক নারীও একই অভিজ্ঞতার কথা জানান। মধ্যপ্রাচ্যে তার কর্মজীবন ছিল খুবই স্বল্প সময়ের। সেখানে তিনি হয়রানি, বেতন বিলম্ব এবং কঠোর আচরণসহ বিরূপ কর্মপরিবেশের মুখোমুখি হন। দেশে ফিরে এসেও তাকে সহ্য করতে হয়েছে অবহেলা ও সামাজিক কটূক্তি।
"আমার সঙ্গে এমন আচরণ করা হতো, যেন আমি খুব খারাপ মানুষ," বললেন ডালিয়া। "এমনকি পরিবারের লোকজনও এমন আচরণ করত, যেন আমি সেখানে ভুল কিছু করে এসেছি।"
মোকসুদা ও ডালিয়ার এই অভিজ্ঞতা বৃহত্তর এক বাস্তবতার প্রতিফলন।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে ১ লাখ ৫ হাজার ৪৬৬ জন বাংলাদেশি নারী কাজের জন্য বিদেশে পাড়ি জমান। করোনা মহামারির (২০২০) সময়ে জনশক্তি রপ্তানিতে বড় ধসের পর এটি ছিল উল্লেখযোগ্য পুনরুদ্ধার।
মহামারির আগের বেশ কয়েক বছর ধরেই বছরে এক লাখের বেশি নারী বিদেশে কাজ করতে যেতেন। তবে ২০২২ সালের পর থেকে এই সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে।
২০২৪ সালে নারী অভিবাসন কমে দাঁড়ায় মাত্র ৬০ হাজারের কিছু বেশিতে। সরকারের ওভারসিস এমপ্লয়মেন্ট প্ল্যাটফর্মের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিদেশে গিয়েছেন ৫৬ হাজার ২৯২ জন নারী—যা ২০২২ সালের তুলনায় প্রায় ৪৭ শতাংশ কম।
গত ২২ বছরে প্রায় ১২ লাখ ৫০ হাজার বাংলাদেশি নারী বিদেশে গিয়েছেন। তবে কতজন ফিরে এসেছেন বা তারা সেখানে কী ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন—এর কোনো সরকারি তথ্য নেই।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্যাতন ও শোষণের ঘটনা বাড়তে থাকায় অনেক নারী এখন আর বিদেশে যেতে আগ্রহী নন। তাদের মতে, নারীদের দক্ষতা বাড়ানো, গৃহকর্মীর বাইরে নতুন ধরনের কাজের সুযোগ তৈরি করা এবং নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত করাই এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি।
অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রামের (ওকাপ) নির্বাহী পরিচালক শাকিরুল ইসলাম নারী অভিবাসন কমে যাওয়ার পেছনে কাঠামোগত ইস্যুর কথা উল্লেখ করে বলেন, "বিদেশে যে বাংলাদেশি নারী শ্রমিকদের গৃহকর্মী হিসেবে পাঠানো হয়, তাদের বেশিরভাগেরই দক্ষতা খুব কম। এই কারণে তাদের চাহিদাও ধীরে ধীরে কমছে।"
তিনি আরও উল্লেখ করেন, দক্ষতার ঘাটতি থাকলে নির্যাতনের ঝুঁকিও অনেক বেড়ে যায়।
এই নির্যাতনের ঘটনাগুলো গণমাধ্যমে বারবার প্রকাশিত হওয়ায় সৌদি আরবসহ কয়েকটি দেশ বাংলাদেশি নারী শ্রমিক নিয়োগের সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছে। যদিও এসব দেশ মানবাধিকার ইস্যুতে খুব একটা সক্রিয় নয়, তবুও ঝুঁকি এড়াতে তারা এখন বেশ সতর্ক।
শাকির বলেন, "সৌদি আরবের কথাই ধরুন—তাদের সামনে ২০৩৪ সালের বিশ্বকাপ, ২০৩০ এর এক্সপো। এসব আয়োজনের জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন পেতে মানবাধিকার ইমেজ পরিষ্কার রাখা তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।"
তিনি বলেন, "সুতরাং, দক্ষতা এখানে বড় বিষয়।"
তিনি আরও জানান, বাংলাদেশি নারী শ্রমিকদের পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়েছে কারণ তাদেরকে মূলত গৃহকর্মী হিসেবেই পাঠানো হয়। এতে শিক্ষিত ও দক্ষ নারীদের জন্য কাজের সুযোগ সীমিত হয়ে যাচ্ছে।
উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, "ফিলিপাইনের নারীরা হোটেল, হিসাবরক্ষণসহ বিভিন্ন দক্ষতামূলক কাজে নিয়োজিত। কিন্তু বাংলাদেশ কখনো সেইভাবে কর্মক্ষেত্রকে বৈচিত্র্য করতে পারেনি। বরং খুব দূর-দূরান্তের গ্রামের, কম শিক্ষিত নারীদেরই বেশি পাঠানো হয়েছে বিদেশে। সেখানে নির্যাতনের ঘটনাও অনেক।"
"সময়ের সঙ্গে এমন ধারণা তৈরি হয়েছে যে, বাংলাদেশি নারী মানেই গৃহকর্মী, এবং বিদেশে গেলে তারা নির্যাতনের শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন," যোগ করেন তিনি।
বিদেশে গিয়ে সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ—দুটোরই মুখোমুখি হয়ে অনেক নারীর জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। কারও জন্য তা ছিল কষ্টের, আবার কারও জন্য ছিল আশার আলো।
মুন্সিগঞ্জের রুমা বেগম ২০১৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সৌদি আরবে একজন বৃদ্ধা নারীর দেখাশোনা ও গৃহকর্মীর কাজ করেছেন।
রুমা বলেন, "ওই পরিবার আমার সঙ্গে খুব ভালো আচরণ করেছে। কত মানুষের কাছে নির্যাতন আর অতিরিক্ত কাজের চাপের কথা শুনেছি, কিন্তু আমার ক্ষেত্রে তেমনটা ঘটেনি।"
কোভিড-১৯ মহামারির মধ্যে যখন সৌদি আরবে তার মালিক পরিবার আইসোলেশনে চলে যায়, তখন দুই মাসের ছুটি নিয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসেন রুমা।
কিন্তু কেন আর ফিরলেন না?—এমন প্রশ্নে রুমা বললেন, "বাংলাদেশে আমার বাচ্চা একা ছিল। যে আত্মীয় ওর দেখাশোনা করছিল, সে আর রাখতে রাজি হয়নি। তাই আমার আর ফেরার উপায় ছিল না। তবে এখন আমি স্বাবলম্বী—নিজের টেইলারিং দোকান করার জন্য মেশিনও কিনেছি।"
এখনও সৌদিতে থাকা সেই পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন রুমা।
রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) প্রোগ্রাম ডিরেক্টর মেরিনা সুলতানা বলেন, নারী অভিবাসনের উত্থান–পতনকে সরলভাবে ব্যাখ্যা করা ঠিক হবে না।
তার মতে, সংখ্যা কমেছে ঠিকই, কিন্তু এর পেছনে একটিমাত্র কারণ দেখানো কঠিন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নারী শ্রমিক পাঠানোর প্রক্রিয়া—বিশেষ করে গৃহকর্মী হিসেবে—আগের চেয়ে বেশি নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, এখন নারীদের বাধ্যতামূলকভাবে এক মাসের প্রশিক্ষণ নিয়ে বিদেশে যেতে হয়।
"অর্থাৎ, এখন আরও সতর্কভাবে কর্মী নিয়োগ করা হচ্ছে। এটিও নারী অভিবাসন কমে যাওয়ার একটি কারণ," যোগ করেন মেরিনা।
তবে একই সঙ্গে তিনি মনে করেন, এর পেছনে আরও কিছু সামাজিক কারণও রয়েছে।
নারীদের বিদেশযাত্রা এখনো সামাজিকভাবে অনেক ক্ষেত্রে নেতিবাচকভাবে দেখা হয়—বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যে গৃহকর্মী হিসেবে যাওয়ার ক্ষেত্রে। অতীতের নির্যাতন ও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার খবর মানুষের মনে আরও বেশি নেতিবাচকতা ও ভয় তৈরি করেছে। ফলে পরিবারের মানুষ অনেক সময় নারীদের বিদেশে যেতে একেবারেই নিরুৎসাহিত করেন।
মেরিনা বলেন, "পুরুষ ও নারী উভয়েই বিদেশ থেকে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে। কিন্তু সমাজ শুধু নারীকেই দোষারোপ করে, লজ্জা দেয়।"
তার মতে, নারী অভিবাসন কমে যাওয়াকে কেবল সংখ্যার দৃষ্টিতে দেখলে ভুল হবে। এটি নারীদের উপার্জন, ক্ষমতায়ন ও চলাচলের স্বাধীনতা হারানোর ক্ষেত্রেও ঝুঁকি তৈরি করছে। তাই শুধু 'কেন সংখ্যা কমছে' এই প্রশ্ন নয়—বরং 'নারীদের জন্য নিরাপদ ও ন্যায্য অভিবাসন ব্যবস্থা কেন আরও শক্তিশালী করা হচ্ছে না'—এই প্রশ্নটিও এখানে গুরুত্বপূর্ণ।
ফরিদপুর, মুন্সিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদীর মতো জেলায় এখন পরিবারগুলোর দৃষ্টিভঙ্গিতেও পরিবর্তন এসেছে, বিশেষ করে, কে বিদেশে যাবে—সেই সিদ্ধান্তে।
শাকির বলেন, "আগে অনেক পরিবার থেকেই নারী সদস্যদের বিদেশে পাঠানো হতো, কারণ নারীদের অভিবাসন খরচ তুলনামূলক কম। কিন্তু নির্যাতনের ঘটনা ও সামাজিক কলঙ্ক বাড়ায় এখন পরিবারের লোকজন পুরুষ সদস্যদেরই বিদেশে পাঠাতে বেশি আগ্রহী।"
বিএমইটির অতিরিক্ত মহাপরিচালক (যুগ্মসচিব) মো. আশরাফ হোসাইন নারী অভিবাসন কমে যাওয়ার পেছনে বাস্তব কিছু কারণের কথা তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, "শুধু এভাবে খবর দেবেন না যে নারী কর্মীর সংখ্যা কমেছে। তারা কাজ পাচ্ছেন কি না—এটাই বড় বিষয়। শুধু সৌদি আরবেই আট থেকে দশ লাখ মানুষ কাজ ছাড়া, বেকার ঘুরছে। রিক্রুটিং এজেন্সি এমনকি অনেক সময় আত্মীয়স্বজনও ফ্রি ভিসা এনে শ্রমিকদের 'ডাম্প' করে বিপদে ফেলে দেন।"
তিনি আরও বলেন, "গন্তব্য দেশে যদি চাহিদা না থাকে, তাহলে নারী শ্রমিকেরাও যাবে না। আর ইন্দোনেশিয়া বা ফিলিপাইনের মতো দেশ যদি শ্রমিক সরবরাহে এগিয়ে আসে, তাহলে বাংলাদেশ থেকে নারী কর্মী যাওয়া স্বাভাবিকভাবেই কমবে।"
তিনি টিবিএসকে বিএমইটির অতিরিক্ত মহাপরিচালক মোহাম্মদ আব্দুল হাইয়ের সঙ্গে কথা বলার জন্য পরামর্শ দেন। তবে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও ফোনে তাকে পাওয়া যায়নি।
এদিকে শাকিরুল ইসলাম বলেন, "নারীদের জন্য কর্মক্ষেত্রে বৈচিত্র্য আনতে হবে। গৃহকর্মীর বাইরেও আরও অনেক সেক্টর আছে যেখানে বাংলাদেশি নারীরা ভালো করতে পারেন। বৈচিত্র্য আনতে না পারলে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও ঝুঁকি দুটোই থেকে যাবে।"
