কোভিড হলে ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে: নতুন একাধিক গবেষণা

কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়েছেন এমন ব্যক্তিদের মধ্যে আগামী দিনে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কোভিড হয়নি এমন ব্যক্তিদের তুলনায় ৪০ শতাংশ বেশি। সম্প্রতি ল্যানসেট জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণা থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
গতকাল ল্যানসেট ডায়াবেটিস অ্যান্ড এন্ডোক্রিনোলজি জার্নালে গবেষণাটি প্রকাশিত হয়। গবেষণায় বলা হয়েছে, যাদের কোভিড পরবর্তী সময়ে ডায়াবেটিস হয়েছে এরমধ্যে ১ শতাংশ মানুষ কোভিডে আক্রান্ত না হলে ডায়াবেটিসের জটিলতা দেখা দিত না। এর ফলে বিশ্বজুড়ে আরও লাখ লাখ মানুষের নতুন করে ডায়াবেটিস ধরা পড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, এসব রোগীদের বেশিরভাগই টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। কিছু গবেষক এও বলছেন, কোভিড-১৯ জটিলতার কারণে নতুন ধরনের ডায়াবেটিসও দেখা দিতে পারে।
কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হওয়ার প্রভাবে দীর্ঘ মেয়াদে ডায়াবেটিস ছাড়াও হৃদরোগ ও কিডনি জটিলতার মতো কার্ডিওমেটাবলিক অসুস্থতার ঝুঁকি বাড়ে, এমন প্রমাণ মিলেছে গবেষণাটিতে। সাধারণত কগনিটিভ সমস্যা, ক্লান্তি ও শ্বাসকষ্টকে কোভিডের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব মনে করা হয়।
তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, লং কোভিডের বিভিন্ন ধরনের উপসর্গ থাকতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, এখন পর্যন্ত ৪৬৪ মিলিয়নের বেশি মানুষ কোভিড আক্রান্ত হয়েছে। এতো বিশাল সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হওয়ায়, এদের মধ্যে শতকরা হিসেবে খুব অল্প হারে মানুষের মধ্যে এমন জটিলতা দেখা দিলেও সে সংখ্যা অনেক বেশি হবে।
মানুষের সার্বিক শারীরিক অবস্থার সাপেক্ষে কাদের লং কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার প্রভাব বেশি সে সম্পর্কিত ক্লুও মিলছে নতুন নতুন গবেষণাগুলোতে।
ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল এপিডেমিওলজিস্ট ও গবেষণাটির প্রধান গবেষক জিয়াদ আল-আলি বলেন, "এটি যে শুধু শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা, ব্রেইন ফগ বা শুধু ক্লান্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ না, এ ব্যাপারে আমরা দিন দিন আরও জানতে পারছি। হৃদযন্ত্রের সমস্যা দেখা দিতে পারে, ডায়াবেটিস আর কিডনির জটিলতা তো আছেই"।
এসব বড় বড় ঝুঁকি নিয়েই কয়েকটি গবেষণা পরিচালনা করেছেন আল-আলি ও তার দল। তাদের এক গবেষণায় দেখা গেছে, কোভিডে ভুগেছেন এমন মানুষের স্ট্রোক ও হার্ট এটাকসহ হৃদযন্ত্রের জটিলতা দেখা দেওয়ার ঝুঁকি বেশি। আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, কোভিড-১৯ সংক্রমণের ছয় মাস পরই কিডনি জটিলতায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
তবে কোভিড-১৯ ও কার্ডিওমেটাবলিক জটিলতার মধ্যে শুধু সংযোগ খুঁজে পেয়েছেন গবেষকরা, কোনো কারণ বলা হয়নি। কিছু চিকিৎসক বলছেন, ওজন বেড়ে যাওয়া বা মহামারির সময় শারীরিক কাজ কমে যাওয়ার প্রভাবে টাইপ-২ ডায়াবেটিস ও হৃদযন্ত্রের জটিলতার ঝুঁকি বাড়তে পারে। তবে শুধু কোভিড আক্রান্তদের মধ্যেই কেন এ ঝুঁকি বেড়ে যা তা ব্যাখ্যা করা যায় না লাফস্টাইল পরিবর্তন প্রেক্ষাপটেও।
ডায়াবেটিসের ঝুঁকি সম্পর্কিত নতুন গবেষণায় গবেষক দল ১৮১,০০০ কোভিড রোগীর স্বাস্থ্য রেকর্ডের সঙ্গে কোভিড হয়নি এমন ৮০ লাখ মানুষের তথ্যের সঙ্গে মিলিয়ে বিশ্লেষণ করেছে।
তরুণ, স্বাস্থ্যবান, আদর্শ ওজন ও উচ্চ ব্লাড সুগারের পূর্ববর্তী কোনো রেকর্ড নেই এমন মানুষের মধ্যেও নতুন করে ডায়াবেটিস ধরা পড়ছে বলে জানান গবেষকরা।
কোভিড-১৯ সংক্রমণ কেন ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায় তার স্পষ্ট কারণ জানা যায়নি। একটি কারণ হতে পারে, ভাইরাস হয়তো অগ্নাশয়ের ইনসুলিন নিঃসরণের ক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে। এই হরমোনই ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণ করে। আরেকটি ধারণা হলো, কোভিড-১৯ এর কারণে যে শক্তিশালী ইম্যিউন রেসপন্স দেখা যায়, তার ফলে লো-গ্রেড ইনফ্লামেশন হলে ইনসুলিন নিঃসরণে প্রভাব পড়তে পারে।
নতুন এই গবেষণার সঙ্গে ডায়াবেটিসের সঙ্গে কোভিড সংক্রমণের প্রভাব সম্পর্কিত সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত অন্যান্য গবেষণার ফলাফলের মিল পাওয়া গেছে। এর মধ্যে আছে জানুয়ারিতে প্রকাশিত সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের শিশুদের নিয়ে করা একটি গবেষণা প্রতিবেদন।
গত মার্চে ডায়াবেটোলজিয়া জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় জার্মান গবেষকরা দেখিয়েছেন, কোভিড-১৯ হয়েছে এমন ব্যক্তিদের নতুন টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ২৮ শতাংশ বেশি। এতে কোভিড-১৯ নয় কিন্তু কোনো শ্বাসযন্ত্রের জটিলতায় আক্রান্ত হয়েছিলেন এমন ৩৫ হাজার রোগীর সাথে তুলনা করা হয় ৩৫ হাজার কোভিড রোগীর। অন্য ধরনের ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে এমন কিছু খুঁজে পাননি গবেষকরা।
জেএএমএ নেটওয়ার্কের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, কোভিড হওয়া ব্যক্তিদের সংক্রমণের ১-৫ মাস পরেই নতুন টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্তের আশঙ্কা দ্বিগুণ বেশি। কোভিড আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ৭ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক রোগী এর পাঁচ মাসের মধ্যে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন। কোভিড হয়নি এমন মানুষের মধ্যে একই সময়ে এ হার আরও অনেক কম, ৩.৬ শতাংশ।
গবেষণাটির সিনিয়র গবেষক, হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলের জেসন ব্ল্যাক বলছেন, এই গবেষণার ফলাফল বিশ্লেষণে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ আছে। অনেক মানুষ মহামারির সময় লকডাউনে অনেক দিন ডাক্তার দেখায়নি। হয়তো তাদের ডায়াবেটিস ছিল আগেই, তারা জানতেন না এমন হতে পারে। এছাড়া, গুরুতর কোভিড উপসর্গ সারাতে ব্যবহৃত স্টেরয়েড কিছু সময়ের জন্য ব্লাড সুগার বাড়িয়ে দিতে পারে।
কোভিড-১৯ সংক্রমণের কারণে কেন ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে এর বেশ কিছু সম্ভাব্য কারণ আছে। গবেষণায় প্রমাণ মিলেছে, করোনাভাইরাস অগ্নাশয়ের বেটা সেল আক্রান্ত করে ধ্বংস করতে পারে, এরফলে ইনসুলিন উৎপাদনের পরিমাণ কমে যায়।
একটি গবেষণায় গবেষকরা দেখেন, বেটা সেলের নমুনায় করোনাভাইরাস প্রবেশ করালে ওই কোষে জেনেটিক পরিবর্তন দেখা দেয়, ইনসুলিন তৈরির ক্ষমতা উল্লেখযোগ্য হারে কমে আসে। এর প্রতিক্রিয়া দেখা গেল কোষগুলোতে গ্লুকাগন নামের আরেকটি ভিন্ন ধরনের হরমোন তৈরি শুরু হয়, যা রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।
"বেটা সেল নিজস্ব বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ভিন্ন ধরনের কোষে পরিণত হয়," বলেন গবেষণাটির গবেষক ও ওয়েইল করনেল মেডিসিনের ডায়াবেটিস প্রোগ্রামের পরিচালক সুইবিং চেন।
ড. চেন বলেন, অবস্থাদৃষ্ট দেখা মনে হচ্ছে, কোভিড সংক্রমণের প্রভাবে টাইপ-১ ও ২ ছাড়াও নতুন এক ধরনের ডায়াবেটিস দেখা দিতে পারে। কোভিড থেকে সেরে উঠে নতুন ডায়াবেটিসের আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসার জন্য কোষের এই পরিবর্তন প্রক্রিয়া বন্ধ করা যায় কিনা তা নিয়ে গবেষণা করছে চেন ও তার দল।
গত বছরের আগস্টে 'সেল মেটাবলিজম' জার্নালে প্রকাশিত স্টানফোর্ডের গবেষকদের এক গবেষণায় দেখা গেছে, করোনাভাইরাস সক্রিয়ভাবে অগ্নাশয়ের বেটা সেল টার্গেট করে।