তিনশ’ বছর ধরে ঠিক সময়ে জমছে যে দইমেলা!

সিরাজগঞ্জের চলনবিলের কোলঘেঁষা তাড়াশ উপজেলা সদরের ইদগাহ ময়দানে প্রতিবছর সরস্বতী পূজার দিন অনুষ্ঠিত হয় কয়েকশ বছরের ঐতিহ্যবাহী 'দইয়ের মেলা'। স্থানীয় এবং পার্শ্ববর্তী জেলা ও উপজেলার নামীদামি দই নির্মাতারা মণকে-মণ দই তৈরি করে হাঁড়ি, ছোট পাতিল, সরা, খুটিতে (দই বসানোর পাত্রবিশেষ) দই বিক্রি করেন।
জনশ্রুতি আছে, তাড়াশের 'দই মেলা'-র বয়স তিনশ' বছরের কাছাকাছি। তাড়াশের তৎকালীন জমিদার বাবু বনোয়ারী লাল রায় বাহাদুর দই-মিষ্টি খুব পছন্দ করতেন। পূজার সময় ছাড়াও বাড়িতে অতিথি এলে দই দিয়ে তাদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করতেন তিনি। জমিদারের পৃষ্ঠপোষকতায় জমিদারবাড়ির সামনের রসিক রায় মন্দিরের মাঠে দইয়ের মেলার আয়োজন করা হতো।
তাড়াশে এখন জমিদারদের ভিটেবাড়ির কিঞ্চিত ধ্বংসাবশেষ আর ঠাকুরদালান ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট নেই। তাড়াশের স্থানীয় দই নির্মাতাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন দইয়ের কারিগরদের অন্যতম শ্রী উজ্জ্বল ঘোষকে মেলার ইতিহাস-ঐতিহ্যের ব্যাপারে প্রশ্ন করলে তিনি জানান, 'বাবা আর ঠাকুরদার মুখে শুনতাম এই মেলায় এককালে শয়ে শয়ে ঘোষরা দই তৈরি করে নিয়ে আসত। যার দই সবচেয়ে সুস্বাদু হতো, জমিদারবাবুরা তাকে অনেক মূল্যবান পুরস্কার দিতেন। হাজার হাজার মণ দই বিক্রি হতো সেকালে। এখন সেই জৌলুস না থাকলেও মেলার রেওয়াজটা টিকে আছে।'
'আমরা তিন পুরুষ ধরে দই তৈরি করছি। ১১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে আমাদের পরিবার সরাসরি দইয়ের কারিগরির সঙ্গে যুক্ত।'
তাড়াশের দই মেলার কথা বাংলা একাডেমি প্রকাশিত 'বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা—সিরাজগঞ্জ' বইটিতেও এসেছে। এ বইয়ে বলা হয়েছে, তাড়াশের মেলায় এককালে ৭০০ থেকে ৮০০ জন ঘোষ ৮-১০ হাজার মণ দই নিয়ে এসে বিক্রি করত। তখন মেলা তিন দিনব্যাপী হলেও এখন হয় একদিন। এখনকার বিক্রি-বাট্টার পরিমাণ মোটামুটি কয়েকশ মণ।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মেলবন্ধন তাড়াশের দই মেলা
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ, তাড়াশের সাংগঠনিক সম্পাদক মানিক কুমার রায় জানান, 'এই মেলা বসতে বর্তমানে কারো সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন পড়ে না। আমরা সামাজিকভাবে পুজোটাকে পরিচালনা করি। এই মেলা জাতি-ধর্মের ঊর্ধ্বে একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে এখন।'
প্রতি বছর শীতে মাঘ মাসের পঞ্চমী তিথিতে জমিদার বাড়ি থেকে যে দই মেলার আয়োজন করা হতো সে পরম্পরা মেনেই এখনও একই সময়ে দইমেলার আয়োজন করা হয়।
তাড়াশ প্রেস ক্লাবের সভাপতি, সাংবাদিক সনাতন দাস পূজা ও দই মেলা নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, 'জমিদারেরা যখন মেলার আয়োজন করতেন, তখন পুজোর দিনে সমাজের সকল নিম্ন-আয়ের মানুষদের বাড়িতে ডেকে পেট পুরে দই-চিড়া খাওয়াতেন। আমরা ছোট থাকতে দেখেছি একজন মুসলমান বর্ষীয়ান মহিলা পুজোর ভোগ বা প্রসাদ রান্না করছেন, গামলায় বেড়ে দিচ্ছেন। তাড়াশের সরস্বতী পূজো ও দইমেলা অসাম্প্রদায়িক বন্ধনের চরম উদাহরণ।'
মেলায় দই আসে দূর-দূরান্ত থেকে
তাড়াশের দই মেলায় দই নির্মাতারা দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে দই নেয়ে হাজির হয়। বিক্রেতাদের একটি বড় অংশ আসে বগুড়া থেকে। দেশব্যাপী বগুড়ার দইয়ের সুনাম। মজার ব্যাপার হল, এখানে বগুড়া থেকে যারা আসেন তাদের সিংহভাগই ঘরোয়াভাবে অল্পপরিসরে দই বানান। কারোরই কোনো নামীদামি শোরুম বা দোকান নেই। কিন্তু এদের দইয়ের স্বাদ যেকোনো নামীদামি দোকানের দইয়ের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে।
তাড়াশের স্থানীয় দই নির্মাতারা দই মেলায় নিয়মিতই দোকান ভাড়া নেন। জীবন ঘোষ, কার্তিক ঘোষ, রতন ঘোষ, উজ্জ্বল ঘোষ, মহাদেব ঘোষেরা পুরুষানুক্রমে তাড়াশে দই নির্মাণ করে আসছেন। তারা মেলায় আলাদা আলাদাভাবে স্টল সাজিয়ে বেচাকেনা করেন।
সিরাজগঞ্জ সদর, রায়গঞ্জ, উল্লাপাড়া ও বেলকুচি থেকে কয়েকজন দইয়ের কারিগর দই নিয়ে এসেছেন। পাবনার চাটমোহর ও নাটোরের গুরুদাসপুর থেকেও দই এসেছে। গুরুদাসপুরের শ্রীপুরের দই বেশ বিখ্যাত। স্থানীয় ভাষায় একে বলা হয় 'শ্রীপুরী দই'।

'প্রিয়া দই ঘর'-এর প্রোপাইটার লক্ষ্মণ কুমার ঘোষ ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে দই মেলায় নিজের দোকানের নামে স্টল বসাচ্ছেন। স্টলে পাওয়া গেল তার ছোট ভাই আনন্দ কুমার ঘোষকে। আনন্দ ঘোষ জানালেন, 'দই মেলা সরস্বতী পূজা উপলক্ষে এখন তিনটি জায়গায় বসে। তাড়াশ, সিরাজগঞ্জ সদর ও টাঙ্গাইলের এক জায়গায়। তাড়াশের মেলাটি সবচেয়ে বড় ও বিখ্যাত।'
আছে হরেক পদের দই
তাড়াশের দই মেলায় ঠিক কত প্রকারের দই পাওয়া যায় সেটা বলা মুশকিল। তবে কোন কোন মানের ওপর ভিত্তি করে দইয়ের প্রকারভেদ হয় সেটা খানিকটা জানা গিয়েছে। প্রাথমিকভাবে দইয়ের প্রকারভেদ করা হয় পরিবেশিত পাত্রের আকার ও অবয়বের ওপর ভিত্তি করে। হাঁড়ির দই, পালিত দই, সরার দই, খুটির দই, গেলাসের দই ইত্যাদি।
দ্বিতীয় প্রকারভেদের আদর্শ ধরা হয় দইয়ের জ্বাল ও কাঁচামালের অনুপাত। দুধ, চিনি, পানির পরিমাণ এবং চুলায় দেওয়া জ্বাল দইয়ের মান ও স্বাদ নির্ধারণে ভূমিকা রাখে। জ্বালের ওপর ভিত্তি করে দইয়ের প্রকারভেদ্গুলো হলো—মিষ্টি দই, টক দই, ক্ষীর দই, স্পেশাল দই, চিড়েভেজা দই ইত্যাদি।
এদের কোনোটি তৈরি হয় কড়া জ্বালে, কোনোটি হালকা জ্বালে। স্পেশাল ও ক্ষীর দই কড়া জ্বালে প্রস্তুত করা হয়। টক ও চিড়েভেজা বসানো হয় হালকা জ্বালে। চিড়েভেজা দইটি সরস্বতী পূজার জন্য অনেক নির্মাতা আলাদাভাবে তৈরি করেন।
দইয়ের বিক্রেতা সুব্রত ঘোষ দইটিকে পূজার স্পেশাল আইটেম হিসেবে উল্লেখ করেন। দইটি স্বাদে অন্যান্যগুলোর চেয়ে পিছিয়ে। মানে খেতে খানিকটা পানসে। এটি সরাসরি খাওয়ার নিয়ম নেই। পাত্রে চিড়ার সঙ্গে একে ভেজানো হয়; পরে খানিকটা মিষ্টি দই বা চিনি-গুড় দিয়ে মাখিয়ে খাওয়া হয়। এটি ডায়াবেটিক রোগীদের খাওয়ার জন্য বেশ উপযোগী।
মেলায় দরকষাকষির মজা
মেলায় রতন ঘোষের বিখ্যাত দুই কেজির সরার দই কিনতে এসেছিলেন প্রতুল চন্দ্র সাহা। রতনের সঙ্গে দরদাম করে প্রতুল দুটো ২৫০ টাকার সরার দই নিলেন ৪৪০ টাকা দিয়ে। গ্রামীণ মেলার দরদাম দেখতেও আলাদা রকম মজা।
'কাকা, দিয়্যা দিলি কিন্তু লিয়্যা বাড়ি বিল্যা য়াটা দিবার পারি; তুমি আমাক আটকা রাইকচ্যাও।' রতন বলেন, 'না রে গ্যাদা। তোক ওই দামে দই দিলি আমার ঘরের চাল বেইচ্যা খৈ কেনা লাগবিনি।'
'আচ্চা, কাকা। আর দশটো ট্যাকা লিও, যাও! দুইডো সরা বাদো।'
প্রত্যেক দোকানের পাশে দাঁড়ালেই এমন প্রাণখোলা দরদাম শুনতে পাওয়া যাবে।
তাড়াশের মেলায় দই পাত্রের আকার, ওজন এবং পিছ হিসেবে বিক্রি হয়। দরদামের অফুরন্ত সুযোগ রয়েছে। তবে, একবারে কয়েক পিস নিলে ঘোষেরা দামে কিছু কম রাখে।
বসুধাসুন্দরী দেবী আট বছরের নাতির হাত ধরে মেলায় দই কিনতে এসেছিলেন। বৃদ্ধার বয়স হলেও মিষ্টান্নের প্রতি আগ্রহ বিন্দুমাত্র কমেনি। কাঁপা কণ্ঠে বৃদ্ধা বিমান ঘোষের দোকানে দইয়ের দরদাম করছিলেন। তিনি বলেন, 'বিমান ঘোষের শেরপুরী দই আমার পছন্দের। গত ২০ বছর ধইরা খাই। নাতি-পুতি নিয়া আজ দই-চিড়া খাব।'
দইয়ের দাম ও স্বাদে কেন ও কীভাবে ভিন্নতা আসে সে ব্যাপারে শাম্পা দই ঘরের সুব্রত ঘোষ দারুণ তথ্য দিলেন। দইয়ের ঘনত্ব, স্বাদ ইত্যাদি ক্রেতার পছন্দের আলোকে নির্ধারণ করা হয়। তিনি বললেন, 'আমাদের এমনও অর্ডার আসে যেখানে পার কেজি দই ২০০ টাকা করে বানিয়ে দিতে বলা হয়। তখন স্বাভাবিকভাবে দইয়ের ঘনত্ব ও স্বাদ গাঢ় রাখতে হয়।'
'গরীব মানুষেরা এসে যখন অল্পদামি দই চান, তাদের কথা মাথায় রেখে আমরা ৮০ টাকা কেজির দইও বানাই।'
বৈরী আবহাওয়ার ধাক্কা এবারের মেলায়
করোনার ভেতরে এই নিম্ন-আয়ের দই নির্মাতারা করুণ সময় পার করেছেন। এবারের মেলাতেও তারা খুব সুবিধা করতে পারেননি। কারণটা আবহাওয়া—প্রচণ্ড শীত, মেঘলা আকাশ, সকালের দিকে ইলশেগুঁড়ি মৃদু বর্ষণ।
সকাল আটটা থেকে শুরু হওয়া মেলা বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে। দিনের মধ্যভাগে মেলা সবচেয়ে জমজমাট হয়ে ওঠে। কিন্তু এ বছর খানিকটা ব্যতিক্রম দেখা গেছে। তাড়াশ বাজার নিয়ন্ত্রণ কমিটির কয়েকজনের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, 'গতকাল যে মুষলধারায় বৃষ্টি ছিল তাতে আমরা আশা করতে পারি নাই যে আজকে মেলা বসতে পারবে। মেঘ মেঘ দিনে বৃষ্টির আশঙ্কার কারণে সকাল সকাল সব ক্রেতা এবার দই কিনে বাড়ি ফিরতে চাচ্ছে। অন্যান্যবার এরকম হয় না।'
আকাশের অবস্থা খারাপ হওয়ার জন্য দুপুরের দিকে ঘোষেদের কেউ কেউ দইয়ের দাম কেজিতে ১০ টাকা করে কমিয়ে দেয়। তারা জানায়, শীতের দিনে এমনিতেই দইয়ের বিক্রি কমে যায়। তার উপর পশলা বৃষ্টি শীতের প্রকোপ বাড়িয়ে দিয়েছে। দইগুলো বাড়িতে নিয়ে গেলে নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তাই অল্প লাভেই ছাড়তে হচ্ছে।
দইয়ের টানে
তাড়াশের দইমেলায় এ বছর দোকান বসেছিল প্রায় ২৫টির বেশি। স্থানীয় দই বিক্রেতারা দোকান বসিয়েছিলেন ৭-৮টির মতো। তাদের অনেকেরই শোরুম নেই। অল্পশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত সেই কারিগরদের কেউ কেউ তিন-চার পুরুষ ধরে দই বানাচ্ছেন। বৃদ্ধ রতন ঘোষ তার পূর্ববর্তী দুই পুরুষকে দই বানাতে দেখেছেন। তার ঠাকুরদাদা দীপেন ঘোষ এবং বাবা নীপেন ঘোষের কাছে তিনি দই বানানো শিখেছিলেন।
তাড়াশের দই মেলায় একজন মুসলমান দই নির্মাতার স্টলের সামনে এসে থেমে যেতে হয়। পসরা সাজানোর প্রতিযোগিতায় যেন 'বেলি দই-মিষ্টি ঘর' সবাইকে ছাপিয়ে নিজের স্বকীয় অবস্থান জানান দিচ্ছে। ব্রিটিশ আমলে শাহাদত হোসেন স্থানীয় ঘোষদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এই দোকান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এখন সেটির চারটি শো-রুম।
বর্তমান স্বত্বাধিকারী সাব্বির হোসেন দইয়ের সরার মুখ বাঁধতে বাঁধতে অনেক কথাই জানালেন। তিনি বলেন, 'চিড়া-ভেজানো দইয়ের চাহিদা ভালো থাকলেও এটি বানানো সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। দুধ কেটে বা ফেটে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।'
বিক্রি-বাট্টার ব্যাপারে তার দোকানের আরেকজন কর্মচারী সোহানুর রহমান জানান, 'বেলি দই ঘরের তিন কেজির খুটি স্পেশাল আইটেম। আজকে প্রায় ৪০০-৫০০ কেজি দই বিক্রির টার্গেট করেছি। বিক্রি না হলেও চিন্তা নেই। শো-রুম যাদের আছে তারা বিক্রি না হওয়া দইগুলো শো-রুমে নিয়ে বিক্রি করতে পারবে।'
রংপুর থেকে চলনবিল এলাকায় প্রায় এক দশক ধরে চাকরিসূত্রে বাস করছেন শরীফুল ইসলাম। তিনি উজ্জ্বল ঘোষের দইয়ের বাঁধা খরিদ্দার। মেলায় তার সঙ্গে কথা বললে তিনি বলেন, 'মেলার দিনে এই এলাকায় দুপুরে কারো বাড়িতে সচরাচর ভাত রান্না হয় না। দই-চিড়া চলে। গরিব-ধনী, হিন্দু-মুসলমান সবার বাড়িতে আজকে দই-চিড়া। অতিথিদের আপ্যায়নও করা হবে দই-চিড়া দিয়ে।'

উজ্জ্বল ঘোষ হাসতে হাসতে শরীফুল ইসলামের কথায় সায় দিলেন। তিনি আরেকটু যোগ করে বললেন, 'এই পরম্পরা তাড়াশ এলাকায় কয়েকশ বছরের পুরোনো। পঞ্চমী তিথির মধ্যে যেকোনো সময় পূজা শেষ করে উপোস ভাঙ্গার নিয়ম। সকাল এগারোটা-বারোটার ভেতরেই সাধারণত পূজা শেষ করে দই-চিড়া খাওয়া হয়।'
এবারের দই মেলায় উজ্জ্বল ঘোষ কাকলী দই-মিষ্টি ভাণ্ডারের স্টলে ১ হাজার ৮০০ কেজির দই বিক্রির জন্য তৈরি করেছিলেন। সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার শাম্পা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার দই এনেছিল ৪০০ কেজির কিছু বেশি। 'প্রিয়া দই ঘর', 'আনন্দ মিষ্টান্ন', 'মিঠু দই ঘর', 'বলরাম দই ভাণ্ডার' প্রত্যেকে দই এনেছিলেন ৪০০ থেকে ৫০০ কেজি।
স্থানীয় নির্মাতাদের দইয়ের পরিমাণ যোগ করলে ৫ হাজার কেজির বেশি দই এবারের তাড়াশের দইয়ের মেলায় বিক্রি হয়েছে।
তাড়াশের দই মেলায় ছড়ি ঘোরায় না কোনো কর্তৃপক্ষ
তাড়াশের দই মেলার আরেকটি বিশেষত্ব হল এটি কোনো কর্তৃপক্ষ নিয়ন্ত্রণ করে না। যে যেভাবে পারে এসে পসরা সাজিয়ে হাঁকাহাঁকি শুরু করে। তবে বহিরাগত বিক্রেতাদের কাছ থেকে বাজার নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ খুব সামান্য ভাড়া নিয়ে থাকেন। ছোট দোকান হলে ১৫০-২০০ টাকা। বড় স্টল নিলে ৫০০-৬০০ টাকাও পড়তে পারে।
শুধু দই নয়, বিক্রি হয় চিড়া-মুড়ি-মুড়কিও
তাড়াশের দই মেলায় মেলা প্রাঙ্গনের একপাশে কয়েকটি চিড়া-মুড়ি-মুড়কির দোকান বসে। এদের কেউ কেউ তাড়াশের বাইরে থেকে ব্যবসা করতে আসে। শ্রী নির্মল কুমার দাশ ছেলেপুলেদের সঙ্গে নিয়ে সিরাজগঞ্জের আরেকপ্রান্ত ভূঁইয়াগাতী থেকে তাড়াশের মেলায় মুড়ি-মুড়কি বিক্রি করতে এসেছেন।
মেলায় দুই রকম চিড়া বিক্রি হয়েছে। ইরির চিড়া আর আমনের চিড়া। দুটোর দামই কেজিপ্রতি ৬০ টাকা। চিড়ার পাশাপাশি ছিল মুড়ি, খৈ, মোয়া, গুড়, চিনির তৈরি হাতি-ঘোড়া-খেলনা, কটকটি, মুড়কি, ঝুরি, কদমা, বাতাসা আরো কত কী!
মুড়ি কেজিপ্রতি ৬০ টাকা, মুড়কি ১০০ টাকা, মোয়া ১০০ টাকা, গুড় ১২০ টাকা, ঝুরি ১০০ টাকা, ধানের খৈ ২০০ টাকা করে বিক্রি হয়েছে। পূজা উপলক্ষে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে চিড়া।
রফিকুল ইসলাম তার চার ভাইকে সঙ্গে নিয়ে চিড়ার ব্যবসা শুরু করেছেন। ২৮ বছর ধরে সমানতালে ব্যবসা করে যাচ্ছেন। তিনি জানান, 'তাড়াশ বাজারে আমাদের দোকান থাকলেও শুধু আজকের মেলায় বিক্রির জন্য অনেক আগে থেকে আমরা চিড়া-মুড়ি-মুড়কি ভাজা শুরু করি।'
রফিকুল ইসলামের আরেক ভাই শিবলু ইসলাম বলেন, 'আজ সকাল থেকে চিড়াই বিক্রি হয়েছে ১০ মণের বেশি। মুড়ির সঙ্গে কদমা, চিনির খেলনাগুলাও ভালোই বিক্রি হচ্ছে।'
মেলা থেকে দইয়ের ভাঁড় নিয়ে ফেরার পথে প্রায় প্রত্যেক খরিদ্দারকে একবার হলেও মুড়ি-মুড়কির দোকানগুলোয় উঁকি মারতে দেখা যায়। কেউ গুণ ও মান নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলে দোকানদার কর্তৃক তাকে ধরেবেঁধে চিড়া-মুড়ি-মুড়কি খাইয়ে নতুন করে তার মন্তব্য আদায় করার একটা প্রতিযোগিতা দেখা যায়। এই কথা স্থানীয় দই নির্মাতাদের ক্ষেত্রেও খাটে।
সিরাজগঞ্জ সদরের দই মেলা
তাড়াশের দই মেলার কথা এ পর্যন্তই। এবার সিরাজগঞ্জ সদরের দইমেলা নিয়ে কয়েকটি কথা বলে শেষ করি।
সেখানকার ঘোষদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সিরাজগঞ্জ সদরের দই মেলার বয়স পাঁচ দশকের কম নয়। কে বা কারা এর প্রথম পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করেছিলেন সে ব্যাপারে খুব বেশি তথ্য জানা যায় না।
সিরাজগঞ্জের মাড়োয়ারি পট্টির সামনের সড়কে দই মেলার পত্তন ঘটেছিল। সড়কটির বর্তমান নাম মুজিব সড়ক। হৈমবালা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে মুজিব সড়কে সরস্বতী পূজার দিন দইয়ের মেলা বসে। জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ঘোষেরা দই নিয়ে হাজির হয় সেখানে।
আবহাওয়া খারাপ হওয়া সত্ত্বেও এ বছর সিরাজগঞ্জ সদরের দই মেলার জৌলুস খুব বেশি কমেনি। মোটামুটি ২০টি ঘোষ পরিবার তাদের দই নিয়ে পসরা সাজিয়েছিল। বেলকুচি, ভূঁইয়াগাতী, ঘুড়কা, কামারখন্দ, কামারপাড়া, নবাবপুরসহ সদরের বিভিন্ন ঘোষেরা দই মেলায় স্টল সাজায়। সদরের দই মেলায় বগুড়া থেকে দই নির্মাতাদের আসতে দেখা যায় না।
আনন্দ দই ঘরের আনন্দ নাথ ঘোষ জানান, 'ভয় করছিলাম এবার বিক্রি অইবে না খুব একটা। যা হইছে খারাপ হয় নাই।'
জয় দধি ভাণ্ডারের উত্তম কুমার ঘোষ বলেন, 'এই মেলাটায় আমরা আসি পরম্পরা অনুসরণ করে। কোনো কর্তৃপক্ষ আমাদের আনে না বা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে না।'
ছানাউল কাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে মেলায় দই কিনতে এসেছিলেন। তিনি বেলকুচির ঘোষেদের দই খুঁজছিলেন। দই কিনে যাওয়ার পথে তিনি বলেন, 'সদরের দই মেলার একটা আলাদা ঐতিহ্য আছে। তাড়াশে যেটা হয় সেটার ইতিহাস তো আরো পুরাতন। দই মেলায় দইয়ের দাম কিছুটা কম পাওয়া যায়। টাটকা দই পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সে কারণেই আসা আরকি।'
'নিউ দধি মিষ্টান্ন', 'রনি মিষ্টান্ন', 'পলাশ দই ঘর', 'রাজাপুর দধি ভাণ্ডার', 'জয়দুর্গা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার', 'জয় দধি ভাণ্ডার'-এর দোকানদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দই বিক্রির পরিমাণে এটি তাড়াশের মেলাকে ছাপিয়ে গেলেও দইয়ের বৈচিত্র্যে এটি তাড়াশের মেলার সমকক্ষ হতে পারেনি।
তাড়াশের ক্ষীরসা, ক্ষীরখাসা, খাসার মতো দইগুলো সিরাজগঞ্জের দইমেলায় খুব একটা চোখে পড়েনি। তাড়াশের মেলার সঙ্গে সদরের দই মেলার আরেকটি পার্থক্য হলো, প্রত্যেকটি দইয়ের পাত্রের মুখে দোকানের লেবেল প্রিন্ট করে বেঁধে দেওয়া। এভাবে মেলার গ্রামীণতার ছাপ সদরে কিছুটা ক্ষুণ্ণ হয়ে নাগরিকার ছোঁয়া পায়।