এক লাখ টাকা দামের মাছের অর্থনীতি ও বাস্তুবিদ্যা

জানুয়ারির এক হিমশীতল রাতে সুরমা নদীতে মাছ ধরতে থাকা জেলেদের জালে ধরা পড়ে বিশালাকৃতির বাঘাইর মাছ।
ওইদিন সকালেই সিলেটের লালবাজার মাছের বাজারে নিলামে ওঠে ১২০ কেজি ওজনের মাছটি। ৮৫ হাজার টাকায় মাছটি কিনে নেন একজন পাইকারি বিক্রেতা।
পুরো মাছটি এত দাম দিয়ে কিনতে কেউ আগ্রহী না হওয়ায় পরের দিন সেটির আলাদা আলাদা অংশ বিক্রি করেন তিনি। প্রতি কেজি ১৫০০ টাকা দরে বিক্রি করায় মাছটির দাম উঠে আসে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকায়।
লালবাজারের মাছ ব্যবসায়ী আলাউদ্দিন জানান, শীতকালে হাওরাঞ্চলের বিভিন্ন জাতের মাছ ওঠে তাদের বাজারে।
তিনি বলেন, "বাজারে বিশালাকৃতির কোনো মাছ উঠলে লন্ডনে বসবাসরত বাংলাদেশি প্রবাসীদের পরিবারের স্থানীয় সদস্য বা বড় কোনো ব্যবসায়ী পুরো মাছটি কিনে নেন।তারা সচরাচর খুব কমই দর কষাকষি করেন। ক্যাশেই মূল্য পরিশোধ করেন তারা। সম্পূর্ণ মাছটি কেনার ক্রেতা না পাওয়া গেলে ওইদিনই আমরা সেটি কেটে কেজি দরে বিক্রি করি।"
গত বছরের সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে তিনি ১ লাখ টাকায় ১০০ কেজির বাঘাইর বিক্রি করেন।
দৈত্যাকার এ মাছগুলো বাজারে উঠলেই তা দেখার জন্য ভিড় জমায় উৎসুক স্থানীয়রা। তাদের মধ্যে কৌতূহলী দর্শক থেকে শুরু করে থাকে সম্ভাব্য ক্রেতারাও।মাছ ব্যবসায়ীদের কাছে বরাবরই পুরো মাছটি কিনে নেওয়ার মতো লোকেরাই বেশি প্রাধান্য পায়।
তবে, বিশালাকার এই মাছের ক্রেতারা সচরাচর বাজারে যান না। ফোনেই মাছ কেনার কাজ সাড়েন তারা। কেনার পর সেটি পৌঁছে দেওয়া হয় তাদের দোরগোড়ায়।
ঐতিহ্যগতভাবে বাজারের সবচেয়ে বড় মাছ কিনে নেওয়াকে আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মৎস্যজীবীরা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে চলে আসা এই ঐতিহ্য সম্পর্কে খুব ভাল করেই জানেন।
এ কারণেই প্রতি শীতে স্বাদু পানির জেলেরা হাড়-কাঁপানো ঠাণ্ডা উপেক্ষা করে মধ্যরাতেই নৌকা নিয়ে বেরিয়ে পড়েন।
সাধারণত শীতকালে পানির স্তর কমে যাওয়ায় বড় মাছের আবাসস্থল ছোট হয়ে আসে। মাছ-রসিকরা সারা বছরই এই মৌসুমের জন্য অপেক্ষা করেন।
বাসস্থানে ক্ষতি হওয়ায় বিলুপ্তপ্রায় এই দৈত্য বোয়াল, কাতলা, পাঙ্গাস, বাঘাইর, রিটা এবং এই জাতের মাছ নিয়মিত ধরা পড়ার খবর জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণকারীদের কাছে বরাবরই আকর্ষণীয়। সেপ্টেম্বরে 'কুশিয়ারা নদীতে ধরা পড়লো ১০০ কেজির বাঘাইর', 'ব্রহ্মপুত্রে ধরা পড়েছে ১৫ কেজির বোয়াল' এবং অক্টোবরে 'পদ্মায় ধরা পড়লো ২৪ কেজির পাঙ্গাস', নভেম্বরে 'পদ্মায় ২০ কেজির কাতলা ধরলো চরভদ্রাসনের জেলেরা'-এর মতো শিরোনামে বেশ কিছু খবর প্রকাশিত হয় সংবাদমাধ্যমে।
রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দ উপজেলার জেলে আলহাজ শেখ তার পাঁচ সহকর্মীর সাথে মিলে গত মাসে পদ্মায় ১৮ কেজি ওজনের একটি কাতলা ধরেন।মাছটি ২৫হাজার ৫০০ টাকা নিলামে বিক্রি হয়। সেই মাছ আরও ৫ হাজার টাকা লাভে আরেক ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করেন ওই পাইকারি বিক্রেতা।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, "বড় মাছ ধরা সবসময়ই একটি গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষ। আমরা জানি যে কিছু ধনী ক্রেতা এসব বিশালাকৃতির মাছের জন্য অপেক্ষা করে থাকেন। আমরা নাইলন ফাইবারের জাল দিয়েও অনেক সময় বড় মাছ ধরতে পারি না। এটা আদতে ভাগ্যের উপর নির্ভর করে।"
মাছ ধরার মৌসুমে আলহাজের মতো জেলেরা পদ্মায় মাছের আবাসস্থলগুলোতে জাল ফেলে খোঁজ করেন বিশালাকৃতির মাছের। মাছ ধরার প্রধান সময় মূলত মধ্যরাত।
ভোরবেলাতেই বিখ্যাত গোয়ালন্দ মৎস্য কেন্দ্রে নিয়ে আসা হয় মাছগুলো। সেদিনই সকাল ৯টার মধ্যে বেশিরভাগ মাছ নিলামে বিক্রি হয়ে যায়। এরপর সেগুলো টুকরো করে পাইকারি দামে বিক্রির পসরা সাজানো হয়।
গোয়ালন্দ ভিত্তিক চাঁদনী আরিফা মৎস্য আড়তের (মাছের গুদাম) মালিক চান্দু মোল্লা গ্রাহকদের সাথে যোগাযোগ করতে বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করেন। তার নিজস্ব তালিকায় থাকা ধনী গ্রাহকদের সাথে তিনি ফোনে কথা বলেন। তিনি তার ফেসবুক পেজে জীবন্ত মাছের ভিডিও এবং ছবি পোস্ট করেন। ঢাকার বাজারে মাছ বিক্রি করার প্রয়োজন পড়ে না এসব ব্যবসায়ীর।
তিনি বলেন, "এখানে প্রতিদিন মাছের ব্যবসা চলে। পরের দিনের জন্য পণ্য সংরক্ষণ করার প্রয়োজন পড়ে না আমার। এটি খুবই প্রতিযোগিতামূলক একটি বাজার।"
"বেশিরভাগ সময় ধরার পরপরই মাছ বিক্রি হয়ে যায়। বিশালাকৃতির মাছগুলো দ্রুতই ভাইরাল হয়ে পড়ে। শিল্পপতি এবং বড় ব্যবসায়ীরা ব্যক্তিগতভাবে বা ফোনে দামি মাছ কেনেন। ফোনকলের মাধ্যমে কেউ মাছ কিনলে তা আমি হোম ডেলিভারি দিয়ে থাকি," বলেন তিনি।
বেশি দূরে ডেলিভারি দিতে হলে মাছ সংরক্ষণের জন্য বরফ ব্যবহার করেন তিনি। তবে, অনেক ক্রেতাই জমে যাওয়া মাছ পছন্দ করেন না। তাদের মতে, প্রিজারভেটিভের ফলে মাছের সতেজতা নষ্ট হয়ে যায় বলে উল্লেখ করেন চান্দু মোল্লা।
এদিকে রাজবাড়ী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মশিউর রহমান সম্প্রতি টিবিএসকে জানান, গত কয়েক বছর ধরে জেলেরা শীতকালে বড় আকারের মাছ খুঁজে পাচ্ছেন। গোয়ালন্দ ঘাট বর্ষাকালে ইলিশের একটি বড় অবতরণ কেন্দ্রে পরিণত হয়। কিন্তু এক দশক আগেও গোয়ালন্দে বিশালাকার মাছ খুব কমই পাওয়া যেত বলে জানান তিনি।
"জেলা মৎস্য অফিস নিয়মিতভাবে পদ্মার একটি মোহনার আশেপাশে মাছ ধরা পর্যবেক্ষণ করে। এই অঞ্চলে ১৫০০ জেলে পরিবার রয়েছে। মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞার সময় কোনো জেলে পানিতে জাল ফেলতে পারে না। আমি মনে করি, মাছ ধরার সীমাবদ্ধতার কারণে মাছের প্রজাতি বাড়ছে," বলেন মশিউর।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের রিভারাইন সেন্টারের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোঃ আনিসুর রহমান বড় মাছের প্রাচুর্যের কারণ সম্পর্কে টিবিএসকে বিস্তারিত জানান। তিনিও সম্মত হন যে, মাছ ধরার সীমাবদ্ধতাই এর পেছনে মূল কারণ।
তিনি বলেন, বাঘাইর এবং একই ধরনের বড় আকৃতির মাছের প্রাচুর্য থাকায় কিছু বিপন্ন প্রজাতির মাছের জন্য আশার আলো দেখা দিয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২ এর অধীনে বাঘাইর এবং রিটা মাছ ধরা নিষিদ্ধ। অতিরিক্ত মাছ ধরা এবং পানি দূষণের কারণে কমে আসছিলো এ মাছগুলোর সংখ্যা।
'বেহুন্দি' নেট ব্যবহারের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে কৃতিত্ব দিয়েছেন আনিসুর।জেলেরা সাধারণত জলের স্রোতের বিপরীতে বেহুন্দি জাল ফেলে এবং এতে করে বয়স-আকার নির্বিশেষে প্রচুর মাছ ধরা পড়ে। এটি পরিবেশের জন্য অনেক বেশি ক্ষতিকর।
"একটি মাছ যদি দুই বা তিনটি জীবনচক্র সম্পন্ন করতে পারে, তবে তা যথেষ্ট পরিপূর্ণতা পায়। শুধু তাই নয়; মাছটি দেশান্তরিত হতে পারে এবং আরও বংশবৃদ্ধি করতে পারে। অবৈধ জালের ব্যবহার মাছের জীবনচক্রকে ছোট করে দেয়," বলেন আনিসুর।
অন্যদিকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সাথে মিলে মৎস্য কর্তৃপক্ষ বছরের দুটি সময় ইলিশ মাছ ধরা নিষিদ্ধ করেছে। ইলিশের প্রজনন হার ঠিক রাখার জন্য ১ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল এবং অক্টোবর মাসে ২২ দিন মাছ ধরা নিষিদ্ধ।
"নিষেধাজ্ঞাগুলো যদিও ইলিশ মাছ ধরা রোধ করার জন্য জারি করা হয়েছে, এর ফলে অন্যান্য প্রজাতিও রক্ষা পায়।এছাড়া, করোনাকালে জাহাজ চলাচলের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করায় পানির দূষণ কমেছে," যোগ করেন তিনি।
মাছ ধরার বেশ কয়েকটি স্থান পরিদর্শনের সময় আনিসুর জানতে পারেন, যেসব জেলে আগে ছোট মাছ ধরার জন্য উদগ্রীব থাকতেন, তারাই এখন বড় মাছ ধরতে পেরে এই নিয়মের প্রশংসা করছেন।
বড় মাছ ধরলে সেটি জেলে এবং মাছ কিনতে উৎসাহী, উভয়েই খুশি হন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুরান ঢাকার এক ব্যবসায়ী বলেন, বিয়ের অনুষ্ঠানে বড় ট্রে-তে দৈত্যাকার মাছ রাখার প্রথা পুরান ঢাকার একটি ঐতিহ্য।
বিবাহিত কন্যার বাবা তার মেয়ের জামাইয়ের পাতে বড় মাছের উপাদেয় সাজাতে পারলে গর্বিত বোধ করেন। একটি পারিবারিক অনুষ্ঠানের সময় প্লেটে বড় মাছের তরকারি থাকলে সেটি অনুষ্ঠানে আভিজাত্যের আভা যোগ করে। এই মাছগুলোর বেশিরভাগই আসছে গোয়ালন্দ থেকে। মাছের উৎস জানার সময় তাই গোয়ালন্দের নামও চলে আসে।
"অনেক সময় আমার কাছে টাকা থাকা সত্ত্বেও আমি বড় মাছ সংগ্রহ করতে পারিনি। বড় আকারের মাছ ছিল না তখন। ভাগ্যক্রমে এক মাস আগে আমি প্রায় ২০ কেজি ওজনের একটি বড় বোয়াল পেয়েছি। এর দাম পড়ে ৪০ হাজার টাকা। এটি ছিল আমার জন্যে একটি প্রতিপত্তির বিষয়," বলেন তিনি।