পোড়াদহের ঐতিহ্যবাহী ‘জামাই মেলা’য় কোটি টাকার মাছ-মিষ্টি বিক্রি হয় একদিনেই

বগুড়ার গাবতলীর পোড়াদহ এলাকায় ইছামতী নদীর পাড়ের ঐতিহ্যবাহী 'জামাই মেলায়' কয়েক কোটি টাকার মাছ বিক্রি হয়েছে। স্থানীয়দের মতে, এক সময় এটি 'সন্ন্যাস মেলা' নামে পরিচিত ছিল, যা পরে মাছের মেলায় পরিণত হয়। বর্তমানে এ মেলায় মাছের পাশাপাশি মাছের আদলে তৈরি মিষ্টিও দর্শনার্থীদের আকর্ষণ করে।
স্থানীয়রা জানান, মূলত একদিনের মেলা হলেও আগের দিন সন্ধ্যা থেকেই কেনাবেচা শুরু হয় এবং চলে গভীর রাত পর্যন্ত। প্রথমে পাইকারি বিক্রেতারা বড় আকারের মাছ নিয়ে আসেন, পরে খুচরা ব্যবসায়ীরা তা কিনে বিক্রি করেন। মেলায় প্রায় ২০০-৩০০টি মাছের স্টল বসে মেলায়। ভোর থেকেই হাজারো মানুষের ঢল নামে এগুলোতে।
ব্যবসায়ী ও দর্শনার্থীরা জানান, এক সময় এই মেলায় অন্তত ৫-৭ কোটি টাকার মাছ বিক্রি হলেও ২০২০ সালের পর থেকে বিক্রি কমতে শুরু করেছে। এর জন্য তারা মহামারির পরে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়াকে দায়ী করেছেন।

নানান প্রজাতির মাছ, দাম চড়া
বুধবার (১২ ফেব্রুয়ারি) হয়ে যাওয়া এবারের মেলায় ব্ল্যাক কার্প, চিতল, বোয়াল, রুই, কাতলা, মৃগেল, হাঙড়ি, গ্রাস কার্প, সিলভার কার্প, বিগহেড, কালিবাউশ, পাঙ্গাসসহ নানা প্রজাতির মাছ উঠেছে। কয়েকজন বিক্রেতা সামুদ্রিক তলোয়ার মাছও এনেছেন, যার দাম প্রতি কেজি ১,০০০-১,২০০ টাকা পর্যন্ত হাঁকিয়েছেন তারা।
মেলায় ঘুরে দেখা গেছে, বেশিরভাগ দোকানে বড় আকারের রুই, কাতলা, গ্রাস কার্প, ব্ল্যাক কার্পসহ নদীর মাছের মধ্যে আইড়, বোয়াল, চিতল বিক্রি হচ্ছে। মাছের আকারভেদে দামে পার্থক্য দেখা গেছে।
ব্যবসায়ীরা জানান, প্রতি কেজি রুই ৩০০-৮০০, কাতলা ৩৫০-৮০০, মৃগেল ২৫০-৪০০, বোয়াল ৬০০-১২০০, গ্রাস কার্প ২৫০-৫৫০, সিলভার কার্প ৩০০-৫০০, বিগহেড ২৫০-৫০০, কালিবাউশ ২৫০-৪০০, পাঙ্গাস ২০০-৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

আগের মতো বড় মাছ কম
মেলায় বাঘাইড়সহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বিক্রি হচ্ছে বলে জানান ব্যবসায়ী হাবিবুর রহমান ও আব্দুল মমিন। তারা বলেন, এবারের মেলায় ২ থেকে ২৫ কেজি ওজনের মাছ উঠেছে।
এক সময় মেলার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল দুই থেকে আড়াই মণ ওজনের বাঘাইড় মাছ। বন বিভাগের বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট মাছটিকে মহাবিপন্ন ঘোষণা করায় গত তিন বছর মেলায় এটি কম দেখা গেছে। তবে এবার অন্তত পাঁচটি দোকানে বাঘাইড় মাছ পাওয়া গেছে।
বিক্রেতা জমির উদ্দিন জানান, তিনি প্রতিবছর এই মেলায় বড় মাছ বিক্রি করেন। এবারও ৪০ কেজি ওজনের একটি বাঘাইড় মাছ এনেছেন, যার দাম হাঁকিয়েছেন ৬৪ হাজার টাকা। সকালে কয়েকজন ক্রেতা দাম বললেও এখনো মাছটি বিক্রি হয়নি। সর্বোচ্চ ৩৩ হাজার টাকা দাম উঠেছে বলে জানান তিনি।
আহরণ ও বিক্রি নিষিদ্ধ মাছ কীভাবে প্রকাশ্য বিক্রি হচ্ছে জানতে চাইলে গাবতলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ হাফিজুর রহমান বলেন, 'বিষয়টি জানা মাত্রই আমরা আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করেছি। মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হচ্ছে।'

স্থানীয় বাসিন্দা ও মাছ ব্যবসায়ীরা জানান, অনেক মাছচাষী কেবল এই মেলার জন্যই বড় মাছ সংরক্ষণ করেন। বিশেষ করে নদী থেকে ধরে পুকুরে রেখে বড় করা হয় আইড়, বোয়াল, চিতলসহ বিভিন্ন মাছ।
ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা
প্রায় সাড়ে ৪০০ বছর আগে এই মেলার গোড়াপত্তন হয়। কথিত আছে, একসময় এখানে বিশাল এক বটবৃক্ষ ছিল। সেখানে একদিন এক সন্ন্যাসীর আগমন ঘটে। পরবর্তীকালে সেখানে আশ্রম গড়ে ওঠে এবং স্থানটি হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে পবিত্রস্থানে পরিণত হয়।
এরপর প্রতি বছর মাঘ মাসের শেষ বুধবার সন্ন্যাসী পূজা উপলক্ষে দূর-দূরান্ত থেকে ভক্তরা আসতে থাকেন। এ উৎসবই কালের বিবর্তনে কোনোভাবে মাছের মেলায় রূপ নিয়েছে।
দর্শনার্থীরা জানান, পোড়াদহের এ মেলা জামাইদের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। মেলা উপলক্ষ্যে জামাইরা শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে এসে এখানে বড় মাছ কেনেন। মাছের পাশাপাশি তারা মাছের আদলে তৈরি মিষ্টিও নিয়ে যান।

কোটা টাকার লেনদেন
গাবতলীর মহিষাবান ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেলা কমিটির সভাপতি আব্দুল মজিদ মণ্ডল জানান, মেলায় প্রায় ৫০০টি মাছের দোকান বসেছে। এসব দোকানে কয়েক কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে।
বগুড়া সদরের বাসিন্দা শাহাদাত হোসেন ও সায়েম রহমান জানান, তারা প্রতিবছর এ মেলায় মাছ কিনতে আসেন। এবারও এসেছেন। এর মধ্যে শাহাদাত ১২ কেজির একটি কাতলা মাছ কিনেছেন। তবে আগের তুলনায় বড় মাছ কম উঠেছে বলে জানান তারা।
গাবতলীর আনিছুর রহমান ১১ কেজির একটি বিগহেড মাছ কিনেছেন। তিনি পরিবার নিয়ে আত্মীয়ের বাড়ি এসেছেন এবং মেলায় ঘুরে দরদাম করে পছন্দের মাছ কিনেছেন। এখন কিছু মিষ্টি নিয়ে বাড়ি ফিরবেন বলে জানান।
বগুড়ার কলোনী এলাকার বাসিন্দা আফ উদ দৌলা নিওন বলেন, তিনি প্রায় ১০ বছর ধরে নিয়মিত মেলায় আসছেন। 'আগে মেলায় বড় মাছের সমৃদ্ধি বেশি ছিল, কিন্তু করোনার পর মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমায় বড় মাছের সংখ্যা ও সাইজও কমে গেছে।'

মহিষাবান এলাকার বাসিন্দা আমিনুল ইসলাম জানান, মেলার উপলক্ষে আশপাশের গ্রামগুলোতে আত্মীয়-স্বজনদের নিমন্ত্রণ করা হয়। অতিথিদের বড় মাছ ও মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়, উৎসবের আমেজ সপ্তাহজুড়ে থাকে। তিনি বলেন, 'মেলার নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভালো, কারণ এটি আমাদেরই মেলা, সবাই মিলে দেখাশোনা করি।'
গাবতলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ হাফিজুর রহমান জানান, মেলায় বাঘাইড় মাছসহ কোনো সংরক্ষিত বা নিষিদ্ধ মাছ বিক্রি হচ্ছে কি না তা তদারকি করা হচ্ছে। 'ইতোমধ্যে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা শুরু হয়েছে।'
গাবতলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি আশিক ইকবাল জানান, মেলায় যাতে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে, সেজন্য পুলিশ টহল দিচ্ছে। যানজট নিয়ন্ত্রণে ট্রাফিক পুলিশও কাজ করছে।
ছবি: খোরশেদ আলম/টিবিএস