মহামারি কীভাবে শেষ হয়?

২০২০ সাল থেকে সার্স কোভ-২ ভাইরাস বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়লে সামাজিক দূরত্ব, কোয়ারেন্টিন এই বিষয়গুলো আমাদের জীবনে নতুন স্বাভাবিকতা হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। আমেরিকায় পরিচালিত একটি জরিপ অনুযায়ী, এক-তৃতীয়াংশ মানুষ বলেছেন মহামারি তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করেছে। আরও ২৩ ভাগ মানুষের দাবি, এটি তাদের কর্মজীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামীতে প্রতিবছরে অন্তত দুবার মহামারি ব্যাপক আকারে আঘাত হানতে পারে। তার মানে, বর্তমান তরুণ প্রজন্ম আবার মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা- এইরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারে।
আধুনিক বিশ্বে দ্রুত কোনও রোগ বিপুল সংখ্যক মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পরার নজির খুব কম। কিন্তু পূর্ববর্তী শতাব্দীতে বসবাসকারী মানুষের মধ্যে মহামারি সৃষ্টিকারী রোগের প্রাদুর্ভাব অনেক বেশি ছিল। মধ্যযুগে আমাশয়, ইনফ্লুয়েঞ্জা, ম্যালেরিয়া, গুটিবসন্ত, সিফিলিস এর মতো রোগগুলোর প্রাদুর্ভাব ছিল বেশি।
অতীতের মহামারিগুলি অধ্যয়ন করে বিশেষজ্ঞরা একরকম ধারণায় পৌঁছাতে পারেন যে, কীভাবে এবং কতো সময়ের মধ্যে কোভিড-১৯ মহামারিটি নির্মূল হবে এবং তার ফলে কতদিন পর মানুষের দৈনন্দিন জীবন স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে পারে। অতীতের ঘটনাই আমাদের দিতে পারে বর্তমানের ইঙ্গিত।
মহামারির উৎপত্তির ইতিহাস:
মানুষ যখন থেকে গোষ্ঠী-ভিত্তিক যাযাবর জীবনধারণ থেকে দূরে সরে এসেছে তখন থেকেই মহামারি দেখা দিতে থাকে। তারা তখন কৃষিভিত্তিক জীবনধারণ শুরু করে এবং হাঁস-মুরগি ও পশুপালন শুরু করেছিল। ফলে তাদেরকে পোষা প্রাণীদের থেকে আসা রোগজীবাণুর মুখোমুখি হতে হয়েছিল।
পরবর্তী সময়ে পণ্য আমদানি বা লেনদেন প্রথার জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকলে বাণিজ্যের জন্য জাহাজে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াতের প্রয়োজন দেখা দেয়। ফলে পণ্য লেনদেনের সাথে সাথে এক ব্যক্তির রোগ অন্য ব্যক্তিতে; এক অঞ্চল থেকে বিশ্বের অন্য অঞ্চলে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
উদাহরণস্বরূপ; ষষ্ঠ শতাব্দীতে রোম সম্রাট জাস্টিনিয়ানের আমলে, বিউবোনিক প্লেগ দেখা দিয়েছিল যা মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা এবং ভূমধ্যসাগরীয় কিছু অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। রোগটি সমগ্র অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল কারণ শস্য পরিবহনকারী জাহাজগুলিতে ইঁদুর ও মাছি ছিল। প্রাণীগুলো প্লেগের জন্য দায়ী 'ইয়ার্সিনিয়া পেস্টিস ব্যাকটেরিয়া' বহন করে।
শিল্পোন্নয়নের সময়ে শহরে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকলে স্যানিটেশন-সম্পর্কিত মহামারির প্রকোপ বাড়তে থাকে। যেমন কলেরা মহামারি ১৮ দশকের মাঝামাঝি সময়ে বিশ্বজুড়ে দূষিত খাদ্য ও জলের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
এছাড়া, অন্যান্য মহামারির সময়েও বিপুল মৃত্যু ঘটেছিল; যা কয়েক বছর পর্যন্তও অব্যাহত ছিল।
বিউবোনিক প্লেগের দ্বিতীয় তরঙ্গ 'ব্ল্যাক ডেথ' নামেও পরিচিত। এই প্লেগে আক্রান্ত হয়ে ১৩ দশকের মাঝামাঝি ইউরোপীয় জনসংখ্যার আনুমানিক ৩০- ৫০ শতাংশ মানুষ মারা যায়। সেই সময়ে মাছিবাহিত রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যু আশঙ্কা অনেক বেশি ছিল এবং মৃত্যুহার ৮০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড়িয়ে যায়।
প্লেগটির প্রাদুর্ভাব কমতে শুরু করলেও কিছু কিছু অঞ্চলে তা পুনরায় দেখা দেয়, এভাবে কয়েক শতাব্দী ধরে চলতে থাকে। সর্বশেষ ১৭২৩ সালে ইউরোপের মার্সেই অঞ্চলে প্লেগটি আঘাত হানে।
আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যার উন্নতির ফলে এখন এমন অনেক জটিল রোগ নির্মূল বা প্রশমিত করা সম্ভব হচ্ছে; যা একসময় বিশ্বে মহামারি রূপ ধারণ করেছিল। ১৯৮০ সালে টিকা আবিষ্কারের মাধ্যমে পোলিও ও গুটিবসন্ত নির্মূল সম্ভব হয়। এই রোগগুলো কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশে মহামারি সৃষ্টি করেছিল।
অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের কল্যাণে সিফিলিস, কলেরা, টায়ফোয়েদেড় মতো রোগের প্রতিরোধ সম্ভব হয়েছে। এখনও অনেক দেশে ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব থাকলেও; উন্নত চিকিৎসা রোগে গুরুতর অসুস্থতা ও মৃত্যু কমাতে সহায়তা করছে।
২০০৯ সালে প্রথম এইচওয়ানএনওয়ান মহামারি দেখা দিলে এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে ১০ লাখ আমেরিকান এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। টিকা এবং অ্যান্টিভাইরাস ওষুধ বের হওয়ার ফলে ২০১০ সালের মধ্যে ভাইরাসটি নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখন কোভিড-১৯ এর টিকা পাওয়া যাচ্ছে যা মানুষের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি ও মৃত্যু ঝুঁকি কমিয়ে এনেছে। কিন্তু এই মহামারিটি কখন শেষ তা নিয়ে কারও সঠিক ধারণা নেই। কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন শেষ হওয়ার পর এই ভাইরাসটি নির্মূলের সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু ইতিহাস বলছে, কখন এমন ধরনের ব্যাপক বিশ্বমারির শেষ হবে- তা পূর্বানুমান করা বেশ কঠিন।
- সূত্র: ডিসকভার ম্যাগাজিন