যেভাবে নিজের শরীরের ওজনের চেয়েও বেশি ভার বহন করে মানুষ

ভিয়েতনামের গ্রামীণ খামারের শ্রমিকদের প্রায় অতিমানবীয় শক্তির অধিকারী মনে করা হতো। প্রতিদিন তারা কাঁধে ভারী বোঝা বহন করতেন। লম্বা বাঁশের খুঁটির দুই প্রান্তে ঝোলানো এসব বোঝার মধ্যে থাকত পণ্য, সরঞ্জাম বা অন্যান্য উপকরণ, যা প্রায়ই তাদের নিজের ওজনের চেয়েও বেশি ভারী হতো। তবুও তারা অবলীলায় এগুলো বহন করতেন। খবর বিবিসি'র।
এটি এক ধরনের দক্ষতা, যা অনেকের পক্ষেই অর্জন করা কঠিন। যেখানে আমরা নিজের ওজনের সমান কিছু তুলতেই হিমশিম খাই, সেখানে তা বহন করে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার কথা ভাবাই দুঃসাধ্য। তবে ভিয়েতনামের খামারের শ্রমিকরা এক বিশেষ কৌশল প্রয়োগ করে এ কাজ সম্পন্ন করেন। তারা লম্বা বাঁশের খুঁটির সাহায্যে ভার বহনের কৌশল রপ্ত করেছেন।
তারা এমনভাবে খুঁটি বহন করেন, যাতে উভয় প্রান্তে থাকা বোঝাগুলো তাদের গতির সঙ্গে দুলতে থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে, এ দোলনের ফলে বোঝা বহনের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তির মাত্রা প্রায় ১৮ শতাংশ কমে যায়। তবুও বছরের পর বছর ভারী বোঝা বহনের ফলে এ শ্রমিকদের দেহে যে অপরিসীম শক্তি গড়ে ওঠে, তা অনস্বীকার্য।
আমাদের অনেকের দৈনন্দিন কাজে এতটা শারীরিক শ্রমের প্রয়োজন না হলেও শারীরিকভাবে শক্তিশালী হওয়া নিঃসন্দেহে উপকারী। তবে শরীরের শক্তি বাড়ানোর উপায় কী?
মানুষের শারীরিক শক্তি সম্পর্কে আগ্রহ বহু প্রাচীন। ভারোত্তোলন খেলাটি ৪০০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রচলিত। প্রাচীন মিশর, গ্রীস ও চীনে এর নিদর্শন পাওয়া যায়। গ্রীসে পাওয়া প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, যেমন বিশালাকৃতির নিক্ষেপযোগ্য পাথর (হ্যাল্টারেস), প্রমাণ করে যে খ্রিস্টপূর্ব ৫৫৭ সালেই ভারোত্তোলন জাতীয় প্রতিযোগিতা জনপ্রিয় ছিল।
আধুনিক ভারোত্তোলনের অন্যতম কিংবদন্তি হলেন জর্জিয়ার লাশা তালাখাদজে। ২০২১ সালে উজবেকিস্তানের তাসখন্দে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ভারোত্তোলন চ্যাম্পিয়নশিপে তিনি তিনটি বিশ্ব রেকর্ড গড়েন। এর মধ্যে 'ক্লিন অ্যান্ড জার্ক' বিভাগে ২৬৭ কেজি ভারোত্তোলন উল্লেখযোগ্য। এটি তার নিজের ওজনের দ্বিগুণেরও বেশি, যা আমাদের বেশিরভাগ মানুষের জন্য অকল্পনীয়।
তবে ভারোত্তোলন শুধু প্রতিযোগিতার জন্যই নয়, এটি স্বাস্থ্য ও সুস্থতার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। গবেষণায় দেখা গেছে, বয়স্কদের মধ্যে ওয়েট ট্রেইনিং (ওজন প্রশিক্ষণ) শারীরিক সক্ষমতা বাড়ায় এবং চলাফেরার ক্ষমতা উন্নত করে। এটি অ্যাথলেটিক পারফরম্যান্স বাড়াতে সাহায্য করে এবং ক্যান্সার ও হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। পাশাপাশি, এটি মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও উপকারী।
শক্তিশালী হওয়ার এবং অধিক ভার বহনের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো পেশী গঠন করা। কলোরাডো স্কুল অব মাইনের সহযোগী অধ্যাপক জেফ্রি অ্যাকারম্যান বলেন, 'আমাদের শরীর নিজস্ব ওজন বহনের জন্য তৈরি। তবে অতিরিক্ত ভার বহনের জন্য আমাদের পেশীগুলোর শক্তি বাড়ানো জরুরি। এটি করতে হলে মূল ও সহায়ক পেশীগুলোর ধারাবাহিক প্রশিক্ষণ নিতে হবে, যা শরীরের ভারসাম্য ও গতিকে সহায়তা করে।'
তবে শুধু বড় পেশী তৈরি করাই যথেষ্ট নয়, সেগুলোকে সঠিকভাবে সক্রিয় করাও জরুরি। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারী ওজন তোলার আগে ধাপে ধাপে প্রশিক্ষণ নেওয়া উচিত। প্রগ্রেসিভ ওয়েট ট্রেনিং পদ্ধতিতে ক্রমান্বয়ে শরীরের ওপর চাপ বাড়ানো হয়। যেমন, কেউ যদি আটটি রিপিটেশনের চারটি সেট সহজেই সম্পন্ন করতে পারেন, তবে তার উন্নতির জন্য ওজন, রিপিটেশনের সংখ্যা বা অনুশীলনের সময়সীমা বাড়ানো দরকার।
অর্থাৎ, শক্তিশালী হতে চাইলে কেবল শারীরিক পরিশ্রমই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন সঠিক কৌশল ও ধৈর্যের সঙ্গে প্রশিক্ষণ চালিয়ে যাওয়া।
কিছু গবেষণায় বলা হয়েছে, হালকা ওজন দিয়ে বেশি রিপিটেশন এবং ভারী ওজন দিয়ে কম রিপিটেশন প্রায় একই ফলাফল দিতে পারে।
অন্য গবেষণাগুলো বলছে, ভারী ও হালকা ওজনের সংমিশ্রণ শক্তি ও ক্ষমতা বৃদ্ধিতে কার্যকর হতে পারে। বিশেষত একাধিক সেট শেষ করলে বেশি সুবিধা পাওয়া যায়। গবেষণার এক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, দুই থেকে পাঁচ মিনিট বিশ্রাম নিয়ে একাধিক সেট সম্পন্ন করাই সর্বোচ্চ শক্তি বৃদ্ধির জন্য সবচেয়ে উপযোগী।
বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞ মোট শক্তি বৃদ্ধির জন্য ভারী ওজন ব্যবহার করে স্কোয়াট (ওঠাবসা) করার পরামর্শ দেন। তবে এটি পিঠের স্বাস্থ্যের জন্য কতটা ভালো, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবে দীর্ঘ সময় জিমে কাটানো ছাড়াও ভার বহনের সক্ষমতা বাড়ানোর বিভিন্ন উপায় রয়েছে।
২০ শতকের গোড়ার দিকে লন্ডনের কভেন্ট গার্ডেন বাজারের কুলিরা তাদের মাথায় ফল ও সবজির ঝুড়ি বহন করতেন। এ ধরনের ঐতিহ্যবাহী বহন পদ্ধতি আজও অনেক জায়গায় প্রচলিত, বিশেষত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। উত্তর-পূর্ব ভারতের পাহাড়ি ভূখণ্ড ও অপর্যাপ্ত পরিবহন অবকাঠামোর কারণে দীর্ঘ দূরত্বে পণ্য পরিবহনে ম্যানুয়াল লোড বহন ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। অর্থনৈতিক কারণেও এটি টিকে আছে। পূর্ব আফ্রিকায় লুও সম্প্রদায়ের নারীরা তাদের শরীরের ওজনের প্রায় ৭০ শতাংশ ভার মাথার ওপরে বহন করে এবং ভারসাম্য বজায় রেখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তা বহন করতে পারেন। গবেষণা মতে, তারা 'শক্তি-সাশ্রয়ী' কৌশল রপ্ত করেছেন, যা ভার বহনের জন্য প্রয়োজনীয় পেশীর কার্যকারিতা বাড়ায়।
বিশ্ববিখ্যাত হিমালয়ের শেরপারা দীর্ঘদিন ধরে কাঁধ ও মাথার সাহায্যে ভার বহনের কৌশল ব্যবহার করে আসছেন। তারা পিঠে ঝোলানো বোঝা কপালের ওপর দিয়ে একটি স্ট্র্যাপে আটকে রাখেন। তাদের বহন করা ওজন প্রায়ই তাদের শরীরের ওজনের চেয়ে বেশি হয়ে থাকে। হিমালয়ের পেশাদার কুলিরা প্রায় ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত অসমান পাহাড়ি পথে ২৬ হাজার ফুট উচ্চতায় কয়েকদিন ধরে ভ্রমণ করেন।
একটি গবেষণায় শারীরিকভাবে সক্ষম ১০ জন কৃষককে শেরপাদের পদ্ধতিতে ভার বহন করতে বলা হয়। অংশগ্রহণকারীরা একটি ঢালু ট্রেডমিলে হাঁটার সময় প্রথমে নিজেদের শরীরের ওজনের ১০ শতাংশ এবং পরে ৪০ শতাংশ ভার বহন করেন। দেখা গেছে, কাঁধের স্ট্র্যাপের মতো সহায়ক ব্যবস্থা ব্যবহারের ফলে তাদের হৃদস্পন্দনের হার ও অক্সিজেন গ্রহণের মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। মূলত, স্ট্র্যাপ ব্যবহারের ফলে শেরপারারা ভার বহনে আরও দক্ষ হয়ে ওঠেন এবং দীর্ঘ সময় ধরে ভার বহন করতে পারেন।
ভার বহনের সক্ষমতা বয়স, প্রশিক্ষণের ধরন, লিঙ্গ, পেশীর শক্তি, দেহের গঠন, জলবায়ু, ভূখণ্ড এবং বোঝার অবস্থানের ওপর নির্ভর করে। কিছু প্রকৌশলী 'স্প্রিং-লোডেড' বা 'ভাসমান ব্যাকপ্যাকে'র ধারণা নিয়ে গবেষণা করছেন, যা পিঠ ও কাঁধের ওপর চাপ কমিয়ে শরীরকে স্বাভাবিকভাবে নড়াচড়ার সুযোগ দেয়।
সামরিক বাহিনীতেও ভার বহন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সৈন্যরা প্রায়ই ৪৫ কেজি বা তারও বেশি ওজন বহন করেন, যেখানে অস্ত্র, বর্ম, গোলাবারুদ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম অন্তর্ভুক্ত থাকে। অনেক ক্ষেত্রে যুদ্ধক্ষেত্রের প্রতিকূল পরিবেশে মোটরগাড়ি ব্যবহার সম্ভব হয় না, তখন সৈন্যদের ভার বহনের সক্ষমতা ও গতিই তাদের মিশনের সফলতার মূল চাবিকাঠি হয়ে ওঠে।
সামরিক পরিবেশে লোড ক্যারেজ পারফরম্যান্সের ওপর প্রশিক্ষণের শারীরিক প্রভাব নিয়ে পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সম্মিলিত শারীরিক প্রশিক্ষণ ভারী ওজন বহনের সক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করে। বিশেষত, চার সপ্তাহ ধরে অ্যারোবিক ট্রেইনিংয়ের সঙ্গে প্রগ্রেসিভ রেসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং করলে এর কার্যকারিতা আরও বৃদ্ধি পায়।
মজার বিষয় হলো, সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় 'হাইব্রিড প্রশিক্ষণ' ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে, যেখানে কার্ডিও এবং ওয়েট ট্রেইনিংয়ের সংমিশ্রণ দেখা যায়। দৌড়বিদরাও উভয় ধরনের ব্যায়ামের সুবিধা পেতে তাদের রুটিনে ভারোত্তোলন যুক্ত করছেন।
বর্তমানে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা নিয়মিত ওজন প্রশিক্ষণকে উৎসাহিত করছেন। যেমন, আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন প্রতি সপ্তাহে ৩০ থেকে ৬০ মিনিট রেসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং করাকে কার্ডিওভাসকুলার স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী বলে মনে করে।