জলীয় বাষ্পপূর্ণ বাতাসই যেভাবে বিদ্যুৎ জোগাবে একদিন
ম্যাসাচুসেটসের আর্মহার্স্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরিতে একদিন অনিচ্ছাকৃতভাবেই ঘটে যায় এক বিস্ময়। অন্যমনস্ক এক ছাত্র একটি যন্ত্রে বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে ভুলে যান, আর তার ফলেই এমন কাণ্ড ঘটে- যা দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে যান গবেষকরা। চোখে যা দেখছেন, তা সত্যি নাকি স্বপ্ন- সেই প্রশ্ন তখন ঘুরছিল তাদের মাথায়। বিবিসি অবলম্বনে।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন বিজ্ঞানী জুন ইয়াও। সেদিনের ঘটনার এই প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, 'যে ছাত্র যন্ত্রটি নিয়ে কাজ করছিল, কোনো কারণে সেটির বৈদ্যুতিক সংযোগের প্লাগ লাগাতে ভুলে যায় সে। এই কাহিনির (গবেষণার) শুরুটাও সেখানে।'
পাঁচ বছর আগের ওই ঘটনার পর থেকেই ইয়াও এবং তাঁর সহকর্মীরা আদ্র বাতাস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রযুক্তি আবিষ্কারের চেষ্টা করছেন। বিজ্ঞানী মহলে 'হাইগ্রোইলেকট্রিসিটি' হিসেবে পরিচিত এ বিষয়টি।
বহু বছর ধরেই এই আইডিয়া নিয়ে ভেবে আসছেন বিজ্ঞানীরা। নিকোলা টেসলা-সহ আরও অনেক বৈজ্ঞানিক অতীতে এর সম্ভাবনা খতিয়ে দেখেছেন, কিন্তু আশাব্যঞ্জক সফলতা পাননি কেউই। তবে সেটি সম্ভবত এবার বদলাতে চলেছে।
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিজ্ঞানীদের একাধিক টিম বর্তমানে বাতাসে ভেসে বেড়ানো জলকণা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের নতুন নতুন উপায় আবিষ্কারের গবেষণা করছেন। আর এটা খুবই সম্ভব, কারণ বাতাসের জলকণা দুটি বিপরীত বৈদ্যুতিক চার্জের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হলে, নিজেও সামান্য পরিমাণে বিদ্যুৎ নিঃসরণ করে। আর এই প্রক্রিয়াটিকেই নিয়ন্ত্রিতভাবে করার চেষ্টা চালাচ্ছেন গবেষকরা।
এক্ষেত্রে প্রধান চ্যালেঞ্জ ব্যবহারযোগ্য পরিমাণ বিদ্যুৎ সংগ্রহ। তবে বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, এখন হয়তো তারা ক্ষুদ্রাকৃতির কম্পিউটার বা সেন্সর চালানোর মতোন শক্তি সংগ্রহ করতে পারবেন।
আর এখানেই বাজিমাতের হাতছানি দিচ্ছে ভবিষ্যৎ। কারণ আদ্র বাতাস আমাদের চারপাশে, আর তা থেকে দিনরাত ২৪ ঘন্টাই উৎপন্ন করা যাবে বিদ্যুৎ। কোনো প্রকার দূষণ ছাড়াই, এও নবায়নযোগ্য শক্তির এক দারুণ উৎস।

২০২০ সালে ড. ইয়াও এবং তার সহকর্মীদের একটি বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। এতে তারা এমন এক ব্যাক্টেরিয়া-জাত পদার্থের কথা জানান, যেটি বায়ু থেকে বিদ্যুৎ সংগ্রহ করতে পারে। পদার্থের গায়ে থাকা অতিসূক্ষ্ম ছিদ্রগুলো ভাসমান জলীয়কণাকে আটকাতে পারে। জলীয়কণা পদার্থটির সাথে ঘষা খেয়ে বৈদ্যুতিক চার্জ নির্গত করে।
ইয়াও ব্যাখ্যা করে বলেন, তাদের আবিষ্কৃত প্রযুক্তিতে বেশিরভাগ জলকণা পদার্থের বহির্ভাগের কাছাকাছি থেকে বিপুল বৈদ্যুতিক চার্জ নির্গমন করে, আর অল্পকিছু পরিমাণ পদার্থের আরও ভেতরে প্রবেশ করে। এতে পদার্থের স্তরগুলোর মধ্যে উপরিতল ও নিম্নতলে বৈদ্যুতিক চার্জের পার্থক্য তৈরি হয়।
'এতে চার্জের ভিন্নতা তৈরি হয়ে যায়। বিপরীতমুখী বৈদ্যুতিক চার্জ জমা হওয়ার কারণেই আরও নাটকীয় ও বড় পরিসরে বিদ্যুতের ঝলকানি দেখি আমরা ঝড়ো মেঘে।'
অর্থাৎ, জলীয়বাষ্পের চলাচলকে প্রভাবিত করে, চার্জ আলাদা করার সঠিক অবস্থা তৈরি করা গেলেই উৎপন্ন করা যাবে বিদ্যুৎ। ইয়াও জানান, এই ধরনের যন্ত্র বিশ্বের যেকোনো স্থানেই বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে পারবে।
তবে ২০২০ সালের গবেষণা নিবন্ধটি ছিল সম্ভাবনার হিমশৈলের চূড়ামাত্র।
চলতি বছরের মে মাসে আরেকটি গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশ করেছেন ইয়াও এবং তার সহকর্মীরা। সেখানে তারা সূক্ষ্মকণা-বিশিষ্ট বিভিন্ন ধরনের কাঠামো তৈরির কথা জানান। গ্রাফিন অক্সাইডের চুর্ন থেকে শুরু করে পলিমার, সেলুলোজ ন্যানোফাইবারের মতো নানান পদার্থ দিয়ে কাঠামোগুলো বানানো হয়। দেখা যায়, এর সবগুলোই বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে পারছে। তবে পদার্থভেদে উৎপাদনে কমবেশি হচ্ছে কিছুটা। এতে প্রমাণ হয়েছে, যেকোনো পদার্থ দিয়ে সঠিক কাঠামো তৈরি করেই বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে।
তবে পরীক্ষাগারে এপর্যন্ত খুবই সামান্য পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা গেছে। কারণ, যে যন্ত্রের মাধ্যমে তা করা হয়েছে সেটি বেশ ক্ষুদ্র। এমনকী মানুষের চুলের চেয়েও পাতলা। এতে এক ভোল্টের ভগ্নাংশ-মাত্র উৎপাদন করা যায়। তাই এ ধরনের অনেকগুলো ডিভাইসকে একত্র করে বহু ভোল্ট উৎপাদনের সম্ভাবনার কথা জানান ইয়াও। সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, তরল পদার্থ দিয়েও তৈরি করা যাবে এই ধরনের ডিভাইস। অর্থাৎ, দেওয়ালে তা রঙ আকারে লাগানোও যাবে। ভাবুন একবার, বাড়ির দেওয়াল থেকে মুফতে পাচ্ছেন বিদ্যুৎ, আর তাতেই চলছে সমস্ত হোম ইলেকট্রনিক্স।
শুধু তাই কি! বৈদ্যুতিক গাড়ির এমন পেইন্টের কথাও ভাবুন। গাড়ি চলছে, আর রঙই যোগাচ্ছে শক্তি।
লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজের পদার্থ প্রকৌশলী রেশমা রাও বলেন, 'এটা দারুণ উত্তেজনার বিষয়। বিভিন্ন ধরনের পদার্থ ব্যবহারের এক বিপুল সুযোগ আছে এখানে।'
তবে এই মুহূর্তেই পুরো একটি ভবন বা গাড়ি চালানোর মতো বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা যাবে না ছোট্ট এই ডিভাইসে। রেশমা রাও জানান, আপাতত ছোটখাট পরিধেয় ইলেকট্রনিক্স, সেন্সর, আওটি (ইন্টারনেট অভ থিংস) ডিভাইস এই বিদ্যুতে চলতে পারবে।