পকেটে এঁটে যায় যে ‘তরমুজ’, ঘ্রাণ পারফিউমের চেয়ে দ্বিগুণ

কুইন অ্যান'স পকেট মেলন, বাংলায় অর্থ করলে দাঁড়ায় রানি অ্যানের পকেট তরমুজ। হাজার বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকাজুড়ে জন্মেছে ছোট আকৃতির তরমুজ সদৃশ এই ফলটি। যার বৈজ্ঞানিক নাম কুকুমিস মেলো ডুডাইম। আধুনিক বিশ্বেও ছড়িয়ে পড়লে ফলটির নতুন নতুন নামকরণ হয়। তবে শেষ পর্যন্ত ফলটি কীভাবে কুইন অ্যান'স পকেট মেলন হিসেবে পরিচিতি পায় তা একটি রহস্য।
১৯ শতকে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলে এটিকে ডাকা হতো 'ভেজেটেবল পোমেগ্রানেটস' বা সবজি প্রজাতির ডালিম নামে। পরবর্তীতে পরিচিতি পায় পাম গ্রানিস নামে, যার অর্থ বরইয়ের দাদি। আকারের কারণেই মূলত তার এমন নামকরণ হয়। শেষ পর্ন্ত রানি অ্যানের নামে পরিচিত হয় খর্বাকৃতির ফলটি। এমন নামকরণে অবাক হওয়ার কারণ, অ্যান নামে ব্রিটিশ যে রানি ছিলেন তিনি মারা যান ১৭১৪ সালে। অথচ ফলটির এই নামকরণ হয় তারও প্রায় ২০০ বছর পর।
ফলটির অনন্য গুণ হলো এর সুগন্ধি। ইতিহাস থেকে জানা যায়, রানি অ্যান সুগন্ধি পছন্দ করতেন। তিনি শ্যাম্পেইন ও ভায়োলেন্ট নামের ফুল দিয়ে গোসল করতেন। হয়তো এ কারণেই রানির অ্যানের সঙ্গে এর নাম জুড়ে দেওয়া হয়েছে।
প্রাচীনকাল থেকে মানুষ মিষ্টি ঘ্রাণের জন্য তরমুজগুলোকে নিজেদের চারপাশে ব্যবহার করত। ৯ম শতাব্দিতে ইরানে ফলটিকে 'দাস্তানবউয়া' ডাকা হতো, যার অর্থ হাতের সুগন্ধি। বাড়িতে সুগন্ধি হিসেবে ফলটি তখন থেকেই জনপ্রিয়। এমনকি অসাধু ফল ব্যবসায়ীরা তাদের পঁচে যাচ্ছে এমন ফলের গন্ধ লুকাতে এসব 'তরমুজ' ক্রেটে লুকিয়ে রাখত।

শতাব্দী ধরে, কুইন অ্যান,স পকেট মেলন উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে গেছে। ১৯ শতক জুড়ে ফলটির জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়তে থাকে। তবে ভিক্টোরিয়ান কৃষক ও বাগান মালিকদের হাত ধরে তা আবার প্রচলিত হয়ে ওঠে। ১৮৬৭ সালে দ্য জার্নাল অব হর্টিকালচারের এক লেখক উল্লেখ করেন, আমি বিশ্বাস করি এই ক্ষুদ্র তরমুজটি অনেক প্রাচীন। এটি পুরনো কোট বা পুরনো গানের মতো, যা আবার ফ্যাশনে পরিণত হবে।
কুইন অ্যান'স পকেট মেলন কী?
কুইন অ্যান'স পকেট মেলন মোটামুটিভাবে একটি টেনিস বল আকারের। ছোট এবং গোলাকার ফলটি মসৃণ, কিছুটা মখমল টেক্সচারের । ত্বক ডোরাকাটা। অপরিপক্ক অবস্থায় ডোরাকাটা হয় সবুজ রঙের; তখন এটাকে সত্যিকারের তরমুজ বলে ভুল বুঝবে অনেকে। তবে পরিপক্ক হতে হতে ডোরাকাটা ত্বক কমলা রঙ ধারণ করে। ফলটি কাটা হলে মাঝখানে কুমড়োর মত অনেক বীজ পাওয়া যাবে।
মধ্যপ্রাচ্য থেকে ফলটি পর্তুগালে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর ১৮ শতকে ইংল্যান্ড হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়ে। একসময় যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাপালাচিয়া ও ওজার্ক অঞ্চলে বাগানগুলোয় উৎপাদিত প্রধান পণ্যে পরিণত হয় ফলটি।

যদিও কুইন অ্যান'স পকেট মেলন খাওয়া যায়, তবে প্রধানত আসাধারণ সুগন্ধি হিসেবেই তা ফলানো হতো। তরমুজের শক্তিশালী ঘ্রাণের পাশাপাশি শিউলি বা ক্যান্টালুপের ঘ্রাণ পাওয়া যায় এতে। অনেকে জেসমিন বা আনারসের ঘ্রাণ আছে বলেও উল্লেখ করেন। কারো কারো কাছে কুইন অ্যান'স পকেট মেলোনের ঘ্রাণ অপ্রতিরোধ্য। যা সুগন্ধি তৈরিতে ব্যবহার হওয়া ইন্ডোলের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
কুইন অ্যান'স পকেট মেলনের স্বাদ কেমন?
সুগন্ধি হিসেবে জনপ্রিয় হলেও ফলটি খাওয়া যায়। তবে ঘ্রাণের তুলনায় এর স্বাদ অনেকটাই কম। তবে একদমই স্বাদহীন তা বোধহয় বলা যাবে না। ফলটিকে নরম, স্পঞ্জি টেক্সচারের শসার সাথে তুলনা করা যায়।
কিছু ঐতিহাসিক সূত্র দাবি করেছে যে, কুইন অ্যান'স পকেট মেলন ছিল অখাদ্য। তবে এটিকে জ্যাম, জেলি ও আচার তৈরির জন্য ব্যবহার হওয়ার অনেক প্রমাণ আছে। মাঝে মাঝে, সুগন্ধযুক্ত ছোট তরমুজগুলি কাঁচা খাওয়া হত।
যদিও ১৯ শতকের একটি উৎস থেকে জানা যায়, ফলগুলো আরো সুস্বাদু করার জন্য চিনি এবং ওয়াইন দিয়ে পরিবেশন করা হতো। আধুনিক রেসিপিতে ভেতরের অংশ খুঁড়ে তা ছোট ছোট করে কেটে গ্রানিটা (চূর্ণ বরফ দিয়ে তৈরি একটি পানীয়) হিসেবে পরিবেশন করা হয়।
কোথায় কিনতে পাওয়া যাবে?
বিশ্বের অনেক জায়গায় কুইন অ্যান'স পকেট মেলন চাষ হলেও সেগুলো কিনতে পাওয়া কঠিন। কম স্বাদ হওয়ায় এবং ফলগাছগুলো অনেক আগাছা জন্ম দেওয়ায় বানিজ্যিক চাষিরা কুইন অ্যান'স পকেট মেলন এড়িয়ে চলেন। তাই ফলগুলো কেনার চেষ্টার চেয়ে নিজে চাষ করাই ভালো বুদ্ধি। ফলটি উত্তরাধিকার সূত্রে বাগান করে চলা চাষিদের মধ্যে আবার জনপ্রিয়। তবে ফ্লোরিডা, অ্যারিজোনা ও ক্যালিফোর্নিয়ায় এই ফলকে আবার ক্ষতিকর বলে মনে করা হয়।

তবে বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদের সম্ভবনা এখনো পুরোপুরি খারিজ করে দেওয়া হয়নি। ২০২০ সালে 'হর্টিকালচারাল সাইন্স'-এ প্রকাশিত এক গবেষণায় 'পিয়েল ডি সাপো' জাতের তরমুজের সঙ্গে কুইন অ্যান'স পকেট মেলনের ক্রস-ব্রিডিংয়ের সম্ভাবনা যাচাই করা হয়। স্পেনে সবচেয়ে জনপ্রিয় পিয়েল ডি সাপো জাতটি মিষ্টি, পুষ্টিকর। আকারে বড় ও ভারি।
গবেষকরা দেখেছেন, ক্রস ব্রিডিং করলে গোলাকার, ছোট আকারের তরমুজ উৎপন্ন হয় যা কোমল স্বাদের এবং একজন ব্যক্তি খাওয়ার জন্য আদর্শ।
আশা করা হচ্ছে, সুদীর্ঘ ইতিহাসের কুইন অ্যান'স পকেট মেলন আবারো জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। তবে তা হয়তো নতুন এবং ভিন্ন আকারে।