তারা সদরঘাটের কলম্যান!

সদরঘাটের ১৪ নম্বর পন্টুনে ভিড়ে আছে এমভি ইয়াদ। চারতলা উঁচু এ লঞ্চ। লম্বায় একশ ফুটের বেশি হয়ে যেতে পারে। পৌনে সাতটায় ছাড়বে। যাবে আমতলী। দুপুর তিনটাতেই জেটির সঙ্গে সিঁড়ি লাগানো হয়ে গেছে। লঞ্চের নিচতলার রেলিংয়ে বসে একজন মাঝেমধ্যে গলাটা ত্যাড়া করে উঁচুস্বরে আওয়াজ দিচ্ছেন: 'আমতলী… আমতলী!'
মানুষটির মুখে একগাল দাড়ি, কোঁকড়া চুল সবুজ টুপিতে ঢাকা। লুঙ্গির ওপর গায়ে ফুল-স্লিভ জামা। কীভাবে আলাপ শুরু করব ভেবে নিয়ে বললাম, 'কতক্ষণ হলো আসছেন?' উত্তর দিলেন, 'এই আধঘণ্টা।' মানে তিনি তিনটায় এসেছেন। পৌনে সাতটা পর্যন্ত ধরলে প্রায় চার ঘণ্টা ডেকে যাবেন তিনি।
আমি তাঁর নাম জানতে চাইলাম। বললেন, জিতু মিয়া। বয়স আন্দাজ করলাম ৫০ বা ৫২। তিনি আমার অনুমান উড়িয়ে দিয়ে বললেন, ৫৮। বললাম, 'আপনাকে দেখে এতটা বয়স বেশি তা মনে হয় না। আপনার কি শুধু ডাকাডাকিরই কাজ?'
জিতু মিয়া বললেন, 'জি, আমরা ক্যানভাসার, কলম্যান নামেও ডাকে লোকে। লঞ্চে যাত্রী ডাকা আমাদের কাজ। আমরা লঞ্চের স্টাফ না। ভিতরে আমাগো কোনো কাজ নাই, বাইরে ডাকাডাকি করি। তিন-চার ঘণ্টা খাটলে শ দুই টাকা পাই।'

কোনো খাতাপত্রে জিতু মিয়াদের নাম লেখা নেই মানে তারা রেজিস্টার্ড স্টাফ নন। লাইনম্যানের আন্ডারে কাজ করেন। পুরো সদরঘাটে লাইনম্যান যেমন আছে ২০ জন, আর তাদের আন্ডারে ক্যানভাসার আছে কমপক্ষে ১০০ জন।
কলম্যানদের মজুরি লঞ্চমালিকই দেন, তবে তার জন্য লাইনম্যানের সুপারিশ লাগে। কোনো কোনো ক্যানভাসার সারাদিনে দুইটা লঞ্চে ডাকাডাকির সুযোগ পেলে মোট মজুরি হয় ৪ থেকে ৫০০ টাকা। তবে এ সুযোগ বেশিজনের হয় না। বিশেষ করে পদ্মা সেতু হওয়ার পর বরিশাল রুটে লঞ্চ চলাচল অনেকটাই কমে গেছে।
ক্যানভাসারের কামাই যেমন কমেছে, আবার জাহেদুলের নানী সুরাইয়ার রোজগারও কমেছে। সুরাইয়া পান আর সিগারেট বিক্রি করেন ১০ নম্বর পন্টুনে। সারাদিন ঘরের কাজ সেরে বিকাল হলে তবে আসার সময় পান, আর থাকেন রাত ১০টা পর্যন্ত। সঙ্গে থাকে জাহেদুলও।
সুরাইয়া বলছিলেন, জাহেদুলদের মন্দ ভাগ্য। তার দাদা পুলিশে কাজ করে, ইজ্জতওয়ালা লোক, কিন্তু বাবা নেশাগ্রস্ত। কোনো কোনো মাসে ৫০ হাজার টাকাও নষ্ট করে। টাকা না পেলে মাথা ঠিক থাকে না, মারধোর করে। শেষে ভয় পেয়ে সুরাইয়া নিজের কাছে নিয়ে এসেছেন জাহেদুল ও তার মাকে।
জিতু মিয়া ক্যানভাসারের দিনও ভালো ছিল একদিন। শিংটোলায় (পুরান ঢাকা) তাদের নিজেদের বাবার আমলের বাড়ি ছিল। বলছিলেন, 'আমার আগের স্ত্রী দীর্ঘদিন ভুগছিলেন দুরারোগ্য ব্যাধিতে। তার চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে বাড়ি বিক্রি করেছি।'

এখন জিতু মিয়া ভাড়া বাড়িতে থাকেন। ঢাকায় জমিদার (বাড়ির মালিক অর্থে) বলে কোনো কাজে দক্ষ হননি। মানে কাজ করে খেতে হবে, তেমনটা ভাবেননি জিতু মিয়া কোনোদিন। তাই কোনো কাজে ভালো দক্ষতা অর্জন করেননি। এখন তার নতুন একটি পরিবার আছে। ষাট ছুঁই ছুঁই বয়সে আর কোন কাজে লাগবেন, পারবেনও না ভারী কোনো কাজ, শেষে ক্যানভাসারের কাজে লেগেছেন। প্রতিদিন দুটি লঞ্চের যাত্রী ডেকে দেওয়ার কাজ পেলে মোটামুটি শ চারেক টাকা রোজগার করতে পারেন।
বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন বরিশাল জেলার হিসাব অনুযায়ী, ২২টি নৌযান বরিশাল-ঢাকা-বরিশাল রুটে চলাচল করে। তার মধ্যে নামকরা হলো সুরভী, সুন্দরবন, পারাবত, কীর্তনখোলা, টিপু, ফারহান, কালাম খান, গ্রীন লাইন, কুয়াকাটা ইত্যাদি। ঢাকা-ভোলা, ঢাকা-বোরহানউদ্দিন, ঢাকা-লালমোহন, ঢাকা-হিজলা, ঢাকা-হাতিয়া, ঢাকা-কালীগঞ্জ, ঢাকা-ইলিশা-পাতারহাট ইত্যাদি আরো অনেক রুটে অনেক লঞ্চ যাতায়াত করে।
সদরঘাট থেকে সর্বমোট ৪২টি নৌপথে ২২১টি যাত্রীবাহী লঞ্চের চলাচলের অনুমতি রয়েছে। সাধারণত সবসময় লঞ্চের নাম ও তার মালিক প্রতিষ্ঠানের নাম একই হয় না, যেমন কুয়াকাটা লঞ্চের মালিক প্রতিষ্ঠানের নাম মেসার্স ডলার এন্টারপ্রাইজ। কুয়াকাটা নামে এই প্রতিষ্ঠানের একাধিক লঞ্চ থাকতে পারে, যেমন আছে টিপু, সুন্দরবন, সুরভী বা ফারহানের।
তাই যে ক্যানভাসার যত বড় নেভিগেশন কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত হতে পারে তার ইনকাম তত ভালো হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বরিশালের লঞ্চ ছেড়ে যাওয়ার পর, একই ক্যানভাসার আবার তজুমদ্দিন বা সিদ্দিকখানগামী লঞ্চের জন্য যাত্রী ডাকার সুযোগ পেয়ে যেতে পারে। যদিও এর অনেকটা নির্ভর করে লাইনম্যানের ওপর। পদ্মাসেতু চালু হওয়ার আগের এক হিসাব বলছে, প্রতিদিন গড়ে ৮০টি লঞ্চ সদরঘাট থেকে ছেড়ে যায়।

এখনকার হিসাব অবশ্য অনেকটাই বদলে গেছে। ফারহানের ক্যানভাসারদের একজন যেমন বললেন, আগে বরিশাল থেকে ৭টা লঞ্চ ছেড়ে আসত, সমানসংখ্যক ছেড়েও যেত—কিন্তু এখন দুটি বা তিনটি যাওয়া-আসা করে। ফারহানের ক্যানভাসার ২ জন সমানতালে শোর মাচিয়েছেন। একজন বলেন, ধুলিয়া; অন্যজন বলেন, ফারহান; অথবা প্রথমজন হিজলা বললে অন্যজন ফারহান বলেন।
এভাবে তারা টানা পাঁচ থেকে ৭ বার জোড়া ক্যানভাস করেন। এদের বয়স চল্লিশের কিছু বেশি। দুজনেই পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি পরা। বলছিলেন, 'দেখতাছেন না মানুষ নাই, ঘাটে আর মানুষ ভিড় করে না। বাসে যাতায়াত সহজ হওয়ায় লঞ্চে মানুষ খুঁইজা পাই না। একটা লঞ্চে ৪০০ যাত্রী উঠলেই কিন্তু মালিক লোকসান থেকে বাঁচে। আর ৫০০ উঠলে কিছু ইনকাম হয়। কোনো কোনো ট্রিপে ৬০ জন যাত্রীও পাওয়া যায় না তখন আরেক লঞ্চে যাত্রী তুলে দিতে হয়। একেকটা ট্রিপে মালিকের লাখ টাকা খরচ আছে, শ চারেক যাত্রী পেলে দিয়ে-থুয়ে কিছু থাকে মালিকের।'
প্রায় ১০০ জন ক্যানভাসার আছে সদরঘাটে । তবে লঞ্চের লস্কর বা কেবিন বয়রাও প্রয়োজনে ক্যানভাসার বা কলম্যানের কাজ করে। যদিও এর জন্য আলাদা কোনো টাকা পায় না, তবে চাকরি বাঁচিয়ে রাখতে এটুকু তো করতেই হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বললেন, 'এখনকার বাজার সবদিক থেকেই মন্দা—আগের মতো লঞ্চে যাত্রী পাওয়া যাইতেছে না। যেখানে আগে দিনে ৪টা লঞ্চ যাইত, এখন সেখানে ২টা লঞ্চ যায়। এর মধ্যে বাজারে জিনিসপত্রের দাম চড়তেছে প্রতিদিন। ছেলেমেয়ে নিয়ে বাঁইচা থাকাই মুশকিল।'
তবে ক্যানভাসারদের নিয়েও অভিযোগ আছে অনেক। যাত্রীরা তাদের টানাহ্যাঁচড়ায় পড়ে নাকাল হয়। এক রুটের যাত্রীকে তারা আরেক রুটের লঞ্চে তুলে দেয়। জিতু মিয়ার কাছে কথাটি তুললে তিনি বললেন, 'কিছু কিছু ক্যানভাসার আছে, বেশি বাড়াবাড়ি করে, এইটা ঠিক না। মানুষের উপকার না করতে পারি, ক্ষতি ক্যান করুম?'

ঈদ আসছে। সদরঘাট ঈদে থাকত জমজমাট। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর আগের মতো ভিড় থাকবে না, তা অনুমান করাই যায়। কিন্তু সাধারণ সময়ের চেয়ে কিছুটা তো বাড়বে। ফারহানের দুই ক্যানভাসারের একজন বললেন, '১০-১২ রমজানের পর থেকে কিছু যাত্রী বেশি পাইতে পারি, তবে অনেক বেশি হবে তা মনে হয় না। এমনিতে কিছু যাত্রী আমরা পাই, যারা আরাম-আয়েশ পছন্দ করে, তারা লঞ্চে ঘুমায়া ঘুমায়া যাইতেই বেশি ভালোবাসে। তবে ঈদের কথা আলাদা। একই পরিবারের অনেকে একসঙ্গে যাওয়ার জন্য লঞ্চই ভালো। তাই ঈদে কিছু যাত্রী লঞ্চগুলো পাবে বলেই মনে করতেছি।'
ক্যানভাসার হতে গেলে কী যোগ্যতা লাগে?—প্রশ্নটি শুনে হেসে ফেললেন জিতু মিয়া, বললেন, 'এইখানে তো বিএ, এমএ পাশ করা লোক লাগে না। তবে শরীরে শক্তি থাকা লাগে আর গলায় তেজ থাকতেই হবে। ডাক এমন হবে যেন ১২ নম্বর পনটুন থেকে ডাকলে ১৪ নম্বর থেকেও শোনা যায়।'

দুই-তিনজন ক্যানভাসার একসঙ্গেও ডাকাডাকির কাজটি করেন, আর তখন বেশ একটা ছন্দ তৈরি হয়। দামামা বাজানোর মতো করে তারা বলতে থাকেন… 'তজুমদ্দিন, সিদ্দিকখান, ধুলিয়া, বালিয়া, মুলাদি, লালমোহন, গলাচিপা, দুমকি, বগা…!' দারুণ দারুণ সব নাম। ক্যানভাসারদের হাঁকডাকে কান ঝালাপালা হলেও দেশের নদীবন্দরগুলোর নাম জানা হয়ে যায়।