ক্ষমতার পালাবদলে উধাও রাজনৈতিক ক্রেতারা, বিলাসবহুল আবাসন বাজারে ধস

গত বছরের সরকার পরিবর্তনের পর দেশের বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট বাজারে বড় ধাক্কা লেগেছে। রাজনৈতিকভাবে সংযুক্ত অনেক ক্রেতা—যাদের বেশিরভাগই ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সঙ্গে জড়িত—দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন বা কারাগারে গেছেন। ফলে বহু উচ্চমূল্যের চুক্তি বাতিল হয়ে গেছে।
ডেভেলপারদের মতে, ডজন ডজন দামি ফ্ল্যাট—যেগুলোর কিছু ইউনিটের দাম ২১ কোটি টাকা পর্যন্ত—সংরক্ষিত ছিল সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও দলীয় ঘনিষ্ঠদের জন্য। এদের অনেকেই শুধু ডাউনপেমেন্ট দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেছেন। এখন এই ফ্ল্যাটগুলো পুনরায় বিক্রি করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
বারিধারা কূটনৈতিক এলাকার ৭ নম্বর রোডে ছয় কাঠা জমির ওপর একটি ছয়তলা বিলাসবহুল প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছিল ২০২৩ সালের শেষ দিকে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে সাবেক ক্ষমতাসীন দলের একজন সাবেক সংসদ সদস্য প্রতি বর্গফুট ৫৭ হাজার টাকা দরে তৃতীয় তলার ২,৯০০ বর্গফুটের একটি অ্যাপার্টমেন্ট বুক করেন। মোট দাম প্রায় ১৭ কোটি টাকা, যা ১৫টি কিস্তিতে পরিশোধযোগ্য ছিল। দলিল হস্তান্তরের সময় নির্ধারিত ছিল ২০২৫ সালের জুনে।
তবে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হারানোর পর ওই সংসদ সদস্য পরিবারের সঙ্গে আত্মগোপনে চলে যান। ছয়টি কিস্তি দেওয়ার পর তিনি আর টাকা দেননি। পরে নভেম্বরে ডেভেলপারকে জানান, তিনি এই চুক্তি চালিয়ে যেতে চান না। অর্থ ফেরতের অনুরোধ জানান এবং ফ্ল্যাটটি অন্য ক্রেতার কাছে বিক্রি করে দিতে বলেন।
প্রকল্পের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মারুফুর রহমান টিবিএসকে বলেন, 'কক্সবাজারের এই সাবেক এমপিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমরা এখন ইউনিটটি পুনরায় বিক্রির চেষ্টা করছি।'
তিনি আরও জানান, প্রকল্পের ছয়টি অ্যাপার্টমেন্টের মধ্যে তিনটি বুক করেছিলেন দুই সাবেক এমপি ও এক সাবেক হুইপ। তারা প্রত্যেকেই ছয়টি করে কিস্তি দিয়েছিলেন, তবে পরে বাতিল করেন। এখন প্রতিষ্ঠানটি এসব ইউনিট ফেরত ও পুনরায় বিক্রির প্রক্রিয়া চালাচ্ছে।
২৬ এপ্রিল সাইটে গিয়ে দেখা গেছে, ভবনের নির্মাণ প্রায় শেষ। কিছু অভ্যন্তরীণ কাজ বাকি আছে। প্রতিটি ফ্ল্যাটে রয়েছে দুটি বেজমেন্ট পার্কিং, আমদানি করা ওক কাঠের দরজা-জানালায় ফ্লোট গ্লাস, এবং ইতালীয় মার্বেল ফ্লোরিং। ইউনিটগুলোতে তিনটি বড় শোবার ঘর, একটি কর্মচারীর ঘর ও দুটি উত্তরমুখী বারান্দা রয়েছে। ছাদে রয়েছে সুইমিং পুল এবং সুইজারল্যান্ড থেকে আনা ছয়টি রিমোট-চালিত ছাতা, যেগুলো বৃষ্টিতে নিজে থেকেই খুলে যায়।
এটি বহু বিলাসবহুল প্রকল্পের একটি, যেগুলো রাজনৈতিক অস্থিরতায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
একটি বড় রিয়েল এস্টেট কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'এই ধরনের প্রকল্পে সাধারণত রাজনীতিবিদ, বড় ব্যবসায়ী ও আমলারা বিনিয়োগ করেন। গত আগস্ট থেকে বিনিয়োগ নাটকীয়ভাবে কমে গেছে।'
তিনি আরও বলেন, 'সাবেক এমপি, মন্ত্রী ও দলীয় নেতা অনেক ক্রেতা আত্মগোপনে রয়েছেন বা তাদের অ্যাকাউন্ট জব্দ হয়েছে। ফলে অর্থের জোগান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তারা বুকিং বাতিল করেছেন।'
বিলাসবহুল খাতে বিক্রি কমেছে
উচ্চমূল্যের অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পগুলো মূলত ঢাকার অভিজাত এলাকাগুলো—গুলশান, বনানী, বারিধারা, ধানমন্ডি, বসুন্ধরা, নিকেতন ও নিকুঞ্জ-কেন্দ্রিক।
গুলশান সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাইয়ের মধ্যে ৬ কোটি থেকে ২১ কোটি টাকার মধ্যে মোট ৭২৮টি বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের দলিল নিবন্ধিত হয়েছে, যার মোট মূল্য প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা।
অন্যদিকে, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত নিবন্ধিত হয়েছে মাত্র ৩৯টি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট। এর মধ্যে ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চে মাত্র ২১টি চুক্তি সই হয়েছে, যার মধ্যে গুলশানে মাত্র ছয়টি।
নিবন্ধন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট লেনদেনের পরিমাণ ছিল ২১ হাজার কোটি টাকা। এর আগের বছরগুলোতে এই পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ১৯ হাজার (২০২২), ১৫ হাজার ৫০০ (২০২১), ১৪ হাজার (২০২০) এবং ১২ হাজার কোটি টাকা (২০১৯)। কয়েক বছর ধরে বাজারে স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধি দেখা গেলেও এখন সেটি হঠাৎ করে উল্টে গেছে।
রিহ্যাব: সব খাতে সংকট
আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাবের (রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ) সভাপতি মো. ওয়াহিদুজ্জামান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'শুধু বিলাসবহুল নয়, মধ্যম ও সাধারণ অ্যাপার্টমেন্ট ইউনিটগুলোও এখন সংকটে। বিক্রি না হওয়া ইউনিট আর আটকে থাকা বিনিয়োগের কারণে ডেভেলপাররা চাপে পড়েছেন।'
তিনি কোম্পানির অভ্যন্তরীণ তথ্যের ভিত্তিতে জানান, ঢাকাজুড়ে বিভিন্ন চলমান প্রকল্পে ১০০টির বেশি বিলাসবহুল এবং ২ হাজারেরও বেশি সাধারণ অ্যাপার্টমেন্ট এখনও বিক্রি হয়নি।
ক্রেতারা পিছিয়ে, বিক্রেতারা অচলাবস্থায়
২০২৪ সালের জুনে ঢাকা-২০ (সাভার-ধামরাই) আসনের তিনবারের সংসদ সদস্য বেনজীর আহমেদ বসুন্ধরার ব্লক ই-তে পাঁচ কাঠা জমির ওপর একটি ছয়তলা বাড়ি কিনতে ৭ কোটি ৫০ লাখ টাকায় চুক্তি করেন। চুক্তি অনুযায়ী তিনি ৫০ লাখ টাকা অগ্রিম দেন। ডিসেম্বরের মধ্যে বাকি অর্থ পরিশোধ করার কথা ছিল।
তবে আগস্টের শেষ দিকে তিনি মধ্যস্থতাকারী ওজিউল ইসলাম রোমানের মাধ্যমে জানিয়ে দেন, তিনি আর এগোতে চান না এবং অগ্রিম দেওয়া টাকার ৯০ শতাংশ ফেরত চান।
রোমান বলেন, 'চুক্তি বাতিলের পর থেকে আমরা আর নতুন কোনো ক্রেতা পাচ্ছি না।' তিনি জানান, এখন কানাডা-প্রবাসী মালিক ৭ কোটি টাকায় সম্পত্তিটি বিক্রি করতে চাচ্ছেন।
একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে পোস্তগোলায় ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের পাশে বসুন্ধরা রিভারভিউ প্রকল্পেও। স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতা ১৭ নম্বর রোডে পাঁচতলা বাড়ি নির্মাণের জন্য ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকায় চুক্তি করেন এবং ৩০ লাখ টাকা অগ্রিম দেন। ৫ আগস্টের পর থেকে তিনি নিখোঁজ। বিক্রেতা জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, দলিল নিবন্ধিত হয়ে যাওয়ায় এখন ক্রেতার সহযোগিতা ছাড়া তা বাতিল বা পুনরায় বিক্রি করা যাচ্ছে না।
নতুন প্রকল্প বন্ধ হচ্ছে
শান্তা হোল্ডিংস, সাউথব্রিজ রিয়েল এস্টেট, বিটিআই, কনকর্ড, নাভানা, শেলটেক, র্যাংগস, ডোম-ইনোসহ শীর্ষস্থানীয় ডেভেলপাররা ক্রেতাদের আগ্রহ কমে যাওয়ায় বর্তমানে নতুন প্রকল্প চালু করতে অনাগ্রহী হয়ে পড়েছে।
র্যাংগস প্রপার্টিজের বিক্রয় বিভাগের মহাব্যবস্থাপক অমলেন্দু বিশ্বাস বলেন, 'আমাদের বেশিরভাগ ইউনিট বিক্রি হয়ে গেছে। তবে বাজারে মন্দা থাকায় আমরা নতুন কোনো প্রকল্প শুরু করছি না।'
রিহ্যাবের সাবেক পরিচালক নাইমুল হাসান বলেন, আবাসন খাত কয়েক বছরের মধ্যে এখন সবচেয়ে খারাপ মন্দার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তিনি খাতটিকে স্থিতিশীল রাখতে সরকারের হস্তক্ষেপের আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, 'রিয়েল এস্টেট খাতে অপ্রকাশিত অর্থ বড় ভূমিকা রাখত। এখন সেই প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে।' তিনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছ থেকে নতুন কর সুবিধা এবং ওই তহবিল পুনরায় আবাসন খাতে বিনিয়োগের অনুমতির দাবি জানান।
সরকার সীমাবদ্ধতা মেনে নিচ্ছে
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. নজরুল ইসলাম বলেন, বিলাসবহুল আবাসন বাজারে সরকার খুব বেশি কিছু করতে পারে না।
তিনি বলেন, 'যদি কেউ বৈধভাবে আয় করে এবং ব্যয় করে, তাহলে সরকারের কোনো আপত্তি নেই—বরং আমরা উৎসাহিত করি। কিন্তু এর বাইরে হস্তক্ষেপের সুযোগ খুবই সীমিত।'