হায়দ্রাবাদের নিজাম, চ্যাপলিন, ক্যারি গ্র্যান্ট: কৃপণ ধনী তারা

প্রচুর অর্থবিত্ত থাকলেই সবসময় মানুষ হাতখুলে খরচ করে না। বিশ্বের অনেক মহাধনী ব্যক্তিই অর্থব্যয়ের দিক থেকে অনুদার ছিলেন। এরকম কয়েকজন কৃপণ ধনীর কথা জানিয়েছে অর্থনীতি বিষয়ক ওয়েবসাইট লাভমানি।
ড্যানিয়েল ড্যান্সার
১৭১৬ সালে ইংল্যান্ডের এক ধনী কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ড্যানিয়েল ড্যান্সার। মৃত্যুর পরে তার সম্পদের পরিমাণ ছিল ১০,০০০ পাউন্ড যা মুদ্রাস্ফীতির হিসাবে এখনকার ২.২ বিলিয়ন ডলারের সমতুল্য।
এত অর্থের মালিক হওয়া সত্ত্বেও ড্যান্সার খরচ কমাতে খেতেন নিম্মমানের খাবার। এমনকি খুব বেশি গোসলও করতেন না তিনি, কারণ তা-তে সাবান খরচ হবে যে!
শোনা যায়, একবার তার বোন ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু পয়সা খরচ হবে বলে তিনি ডাক্তার ডাকেননি। এর ফলে ১৭৬৬ সালে ওই বোন মারা যান। বোনের মৃত্যুর পর তার সম্পদের অর্ধেকের মালিক হন ড্যান্সার।

জীবনের এক পর্যায়ে সম্পদ নিয়ে বাতুল হয়ে পড়েন ড্যান্সার। বাড়ির বিভিন্ন জায়গায় অর্থ লুকাতে শুরু করেন। শোয়ার ঘরের দরজা ও জানালায় তিনি তালা দিয়ে শুতেন যাতে কেউ ঢুকতে না পারে।
হেটি গ্রিন
হেটি গ্রিনকে ডাকা হতো 'ওয়াল স্ট্রিটের ডাইনি' নামে। তখনকার হিসেবেই তিনি ১০০ থেকে ২০০ মিলিয়ন ডলারের মালিক ছিলেন। তবে অর্থ নয়, বরং তার স্বভাবের জন্যই তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন সবার কাছে।
১৮৬৪ সালে তার বাবার মৃত্যুর পর ৭.৫ মিলিয়ন ডলার সমমূল্যের সম্পদের মালিক হন গ্রিন। ওই অর্থ রিয়াল এস্টেট ও রেলপথে বিনিয়োগ করেছিলেন তিনি। স্বামী এডওয়ার্ড হেনরি গ্রিন তার অর্থে বিলাসিতা শুরু করলে বিচ্ছেদ নিয়ে নেন গ্রিন।
গ্রিনের কৃপণতা কিংবদন্তিতে পরিণত হয়। অর্থ হাতছাড়া হয়ে যাবে এমন ভাবনায় তিনি রাতে ঘুমানোর সময় কোমরে ব্যাংক ডিপোজিটের চাবির ছড়া বেঁধে শুতেন। আর হাতে বাঁধা থাকত একটি বন্দুক।

শোনা যায়, নিজের হার্নিয়ার চিকিৎসার জন্য খরচ না করতে নিজেই নিজের চিকিৎসা করতে গিয়েছিলেন তিনি। এছাড়া তার ছেলে পায়ে আঘাত পর দাতব্য হাসপাতালে যান অর্থ বাঁচানোর জন্য। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ চিনতে পেরে তাকে ফেরত পাঠায়।
ওয়েলিংটন বার্ট
১৯০০-এর দশকে অন্যতম ধনী ছিলেন ওয়েলিংটন বার্ট। ১৮৩১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানে জন্ম হওয়া বার্টের কাঠের ব্যবসায় ছিল। একইসঙ্গে লবণ ব্যবসায়, রেলপথ, ও লোহার খনিতে বিনিয়োগ থেকেও বিস্তর আয় করেছিলেন তিনি।
পরিবারের সঙ্গে তার সদ্ভাব ছিল না। পরিবার থেকে আলাদা থাকতেন তিনি। মৃত্যুর পর পরিবারের সদস্যদের জন্য বিশেষ কিছু উইল করেও যাননি।
বার্টের উইল অনুযায়ী, তার ১০০ মিলিয়ন ডলার সম্পদের কোনো কিছুই তার সন্তান ও নাতি-নাতনিরা পাননি। সন্তানদের জন্য বছরে ১০০০-৫,০০০ ডলারের ভাতা রেখে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু নিজের প্রিয় এক পুত্রকে মাসে ৩০,০০০ ডলার দিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। আরেক হতভাগ্য কন্যার ভাগে কিছুই জোটেনি।

২০১১ সালে, বার্টের মৃত্যুর প্রায় ১০০ বছর পরে তার ১২ জন উত্তরসূরীর মাঝে উইলটি ভাগ করা হয়।
স্যার উসমান আলি খান, হায়দ্রাবাদের নিজাম
হায়দ্রাবাদের শেষ নিজাম স্যার উসমান আলি খান একসময় বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি ছিলেন। ১৯৩৭ সালেই তার মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল আনুমানিক দুই বিলিয়ন ডলার — বর্তমানের হিসেবে যা প্রায় ৩৮ বিলিয়ন ডলারের সমান।
উসমান আলি খান তার উদ্ভট স্বভাবের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। বিভিন্ন মূল্যবান রত্নের পেছনে লাখ-লাখ অর্থব্যয় করে কুণ্ঠাবোধ করতেন না এ নবাব। অথচ দীর্ঘ ব্যবহারে কম্বল জীর্ণ হয়ে যাওয়ার পরেও ৩৫ রুপি খরচ করে নতুন কম্বল কেনেননি তিনি।
নিজাম সাহেব সেলাইকরা জামাকাপড় মাসের পর মাস পরতেন বলে শোনা যায়। তার প্রাসাদে আসা অতিথিদের সিগারেট ঝেড়ে দিতেন তিনি, সিগারেটের ফেলে দেওয়া অংশও তুলে রাখতেন পরে সুখটান দেওয়ার জন্য।

খোয়া যাওয়ার ভয়ে নিজের রত্নভান্ডার পাতালঘরে লুকিয়ে রাখতেন উসমান আলি। একবার এক ট্রাংক সোনা ভারতের ন্যাশনাল ডিফেন্স ফান্ডে দান করেছিলেন নিজাম। কিন্তু সেই সঙ্গে তিনি পইপই করে বলে দিয়েছিলেন, ওই ট্রাংকটি তাকে ফেরতে দিতে হবে।
চার্লি চ্যাপলিন
নির্বাকযুগের তারকা অভিনেতা চার্লি চ্যাপলিনও ব্যক্তিজীবনে ব্যয় করতে বিচলিত বোধ করতেন। ১৯১৬ সালে তার সাপ্তাহিক আয় ছিল ১০,০০০ ডলার। কিন্তু অর্থকড়ির বিষয়ে ভীষণ সচেতন ছিলেন তিনি।
শোনা যায়, বন্ধুদের সঙ্গে খেতে গেলে চ্যাপলিন কদাচিৎ সঙ্গে করে নগদ অর্থ নিয়ে যেতেন। তাকে দিয়ে কেউ কখনো বড় অংকের বিল পরিশোধ করতে পারেনি।
বেভারলি হিলে বাড়ি তৈরি করার সময় খরচ কমাতে সিনেমা সেটের কাঠমিস্ত্রীদের ধার নিয়ে কাজ চালাতেন তিনি। এতে অবশ্য লাভের চেয়ে লোকসানই বেশি হয়েছিল তার। বাড়িটা পরে ধীরে ধীরে জীর্ণ হতে থাকে। ওই বাড়ি পরিচিত হয়ে ওঠে 'ব্রেকঅ্যাওয়ে হাউজ' হিসেবে।

ক্যারি গ্র্যান্ট
তার সময়ে ক্যারি গ্র্যান্ট সবচেয়ে ধনী অভিনেতাদের একজন ছিলেন। ১৯৮৬ সালে মৃত্যুকালে তার সম্পদের পরিমাণ ছিল ৬০ মিলিয়ন ডলার।
কথিত আছে, গ্র্যান্ট দুধের বোতলে চিহ্ন দিয়ে রাখতেন যাতে বোঝা যায় তার কোনো ভৃত্য ওই বোতল থেকে দুধ খেয়েছে কিনা। তার পরের কাজটি কৃপণতার সব মাত্রাকে ছাড়িয়ে গেছে বললেও অত্যুক্তি হবে না। গ্র্যান্ট তার বাড়িতে আসা অতিথিদের জামাকাপড় লন্ড্রি করার জন্য তাদের কাছ থেকে খরচ নিতেন। এমনকি অটোগ্রাফপ্রতিও ২৫ সেন্ট করে নিতেন তিনি।

জে. পল গেটি
১৮৯২ সালে জন্মগ্রহণ করা গেটি ১৯৩০ সালে তার বাবার তেলের ব্যবসায়র হাল ধরেন। ক্রমে সেটিকে বিলিয়ন ডলার মূল্যের কোম্পানিতে পরিণত করেন তিনি। অতিথিরা যেন ফোনে বেশি কথা বলে খরচ বাড়াতে না পারে, সেজন্য বাড়িতে একটি পে-ফোন বসানোর ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি।
১৯৭৩ সালে তার নাতি রোমে অপহরণের শিকার হয়। অপহরণকারীরা পল গেটির কাছে ১৭ মিলিয়ন ডলার মুক্তিপণ দাবি করে। গেটির কাছে এ অর্থ বেশি কিছু হওয়ার কথা নয়। কিন্তু তিনি মুক্তিপণ দিতে সরাসরি অস্বীকার করেন।
তিনি বলেছিলেন, 'আমার ১৪ জন নাতি-নাতনি আছে। যদি আমি মুক্তিপণ দেই, তাহলে ওই ১৪ জনই অপহৃত হবে।' ১৬ বছর বয়সী তৃতীয় জন পল গেটি তিনমাস অপহরণাকারীদের জিম্মায় থাকে। অবশেষে অপহরণকারীরা তার একটি কান কেটে দিলে গেটি তিন মিলিয়ন ডলার মুক্তিপণ দিতে রাজি হন।