ব্র্যাকইউ দ্বিচারী: বিশ্বজয় করা একদল যুবকের গল্প

'ছোটবেলা থেকে ইচ্ছে ছিল আন্তর্জাতিক কোনো জায়গায় গিয়ে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করার। বাকেট লিস্টে থাকা ইচ্ছে পরিপূর্ণ হলো', বলছিলেন 'ব্র্যাকইউ দ্বিচারী'র গবেষণা দলের প্রধান সাদীকুল আলীম ত্বকী। স্বপ্ন সত্যি হলো তো বটেই। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে খোদ পোল্যান্ডে গিয়ে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করা তো চাট্টিখানি কথা নয়। তার ওপর যেখানে কিনা এশিয়া মহাদেশের মধ্যে বাংলাদেশের 'ব্র্যাকইউ দ্বিচারী' দল ছাড়া আর কেউ সুযোগই পায়নি!
পোল্যান্ডের পোজনান শহরে ২০ জুন শুরু হয় ইউরোপিয়ান রোবোটিকস লীগ (ইআরএল) প্রতিযোগিতা। ইউরোপের চারটি দল ও এশিয়ার একটি দল অর্থাৎ পাঁচটি দল অংশগ্রহণ করার সুযোগ পায় এখানে। ৫ দিনের এই প্রতিযোগিতায় পর পর ভালো ফলাফলের কারণে 'ব্র্যাকইউ দ্বিচারী' দল অর্জন করে পারসিভিয়ারেন্স এওয়ার্ড। ইউরোপের বাইরে থেকে গিয়ে ক্রমাগত নিজেদের প্রমাণ করে ভালো অবস্থানে নিয়ে যাওয়ায় তারা পান এই এওয়ার্ড।
'ইআরএল ইমার্জেন্সি লোকাল কম্পিটিশন' শিরোনামের আওতায় ইউরোপিয়ান রোবোটিকস লীগ (ইআরএল) প্রতিযোগিতার যৌথ আয়োজক ছিল ইউরোপিয়ান স্পেস ফাউন্ডেশন, সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড অ্যারোস্পেস টেকনোলজিস ও পোজনান ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি। দুই ধাপের বাছাইপর্ব শেষে মোট পাঁচটি দলকে পোল্যান্ডে আমন্ত্রণ জানানো হয়। দুই ধাপ পার করে প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্বে অংশগ্রহণের সুযোগ পায় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের দল 'ব্র্যাকইউ দ্বিচারী'।
প্রতিযোগিতাটি ছিল মূলত ঝুঁকিপূর্ণ বা প্রতিকূল পরিস্থিতিতে রোবট ও ড্রোনকে কাজে লাগিয়ে বিপদ মোকাবেলা করা। এখানে স্থলের জন্য ছিল রোভার আর আকাশের জন্য ছিল ড্রোন, এই দুটিকে সমন্বয় করেই মূল প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতায় ড্রোনকে ব্যবহার করা হয়েছে একটি বিশাল এলাকা ওপর থেকে পর্যবেক্ষণ করার জন্য আর রোভার ব্যবহার করা হয়েছে ঝুঁকি এড়িয়ে যাওয়ার জন্য। ড্রোন আর রোবটকে একসঙ্গে ব্যবহার করে মিশন শেষ করাই হলো প্রতিযোগিতার মূল লক্ষ্য।

নাম কেন 'ব্র্যাকইউ দ্বিচারী'
'আমাদের দুইটা রোবট আছে। এর মধ্যে একটা এয়ারে চলে, আরেকটা গ্রাউন্ডে। দুইটা রোবট যেহেতু একসঙ্গে চলে; এই আইডিয়া থেকেই দ্বিচারী নাম রাখা হয়', বলছিলেন ব্র্যাকইউ দ্বিচারী দলের পাইলট মোহাম্মদ ফিরোজ ওয়াদুদ।
সকলেই ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম দ্বিচারীর আগে যুক্ত করে দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম। ফলে দলের নাম দাঁড়ায় 'ব্র্যাকইউ দ্বিচারী'। এই দলের মূল স্লোগান হলো 'এক্সপ্যান্ডিং হরাইজন' অর্থাৎ দিগন্ত বিস্তৃত করা। তাই পোল্যান্ডের প্রতিযোগিতা শেষ করে আসার পরেও পুরো দল 'ব্র্যাকইউ দ্বিচারী' হিসেবেই কাজ করছে।

যাত্রা শুরুর গল্প...
'আমরা সবাই শুরুতে অন্য আরেকটা দলের অংশ ছিলাম। সেই দলটা ভেঙ্গে যাওয়ার পর আমরা সবাই খুঁজছিলাম নতুন কিছু একটা করতে হবে। আত্মপ্রকাশের জন্য আমরা তখন নতুন কোনো প্রতিযোগিতা খুঁজছিলাম, খুঁজতে খুঁজতেই এই প্রতিযোগিতার সন্ধান পাই', বলছিলেন ড্রোনের পাইলট মোহাম্মদ ফিরোজ ওয়াদুদ। বিভিন্ন বিভাগের বিভিন্ন শ্রেণির শিক্ষার্থীদের সমন্বিত দল হিসেবে তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে 'ব্র্যাকইউ দ্বিচারী' হিসেবে কাজ করার। যারা একসঙ্গে মিলে পার করেছে ইউরোপিয়ান রোবোটিকস লীগ (ইআরএল) প্রতিযোগিতা।
'এপ্রিলের ৫ তারিখ রাতের বেলায় ত্বকী ভিডিও কল দিয়েছিল আমাকে আর অর্ণবকে। আমরা তিনজন বসে ঠিক করি আমরা এখানে যাব। ওদের গাইডলাইন পড়ে আমরা জানতে পারলাম প্রতিযোগিতায় যাওয়ার জন্য একজন একাডেমিক উপদেষ্টা আমাদের সাথে লাগবে। ১৭ তারিখ ছিল রিপোর্টের সাবমিশন টাইম। আমাদের হাতে সময় ছিল খুব কম। এই সময়ের মধ্যে নিজেদের কাজ ঠিক করা, ফান্ডিং ম্যানেজ করা, এডভাইজরকে রাজি করানোসহ কিছু ঝামেলা তো ছিলই। এরপর ৮ তারিখ আমরা উপদেষ্টা হিসেবে আবদুল্লাহ হিল কাফি স্যারকে রাজি করাতে যাই', বলছিলেন প্রকল্পের ইঞ্জিনিয়ারিং ম্যানেজার জহির উদ্দীন।
শিক্ষককে কোনোভাবে রাজি করিয়ে তারা প্রতিযোগিতার জন্য রেজিস্ট্রেশন করেন। এর মধ্যে তারা রিপোর্ট রেডি করে এপ্রিলের ১৫ তারিখে প্রথম ড্রোন শিক্ষককে দেখানোর জন্য টেস্ট ফ্লাইট দেন। উড়ানোর সময় গোঁড়াতেই দেখা যায় গলদ। শুরুতেই ড্রোনের তার ছিঁড়ে যায়। সেটা অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই পাশের দোকানে গিয়ে ঝালাই করে আনেন তারা। পরে সেটা ভালোভাবেই উড়ে আর শিক্ষক আবদুল্লাহ হিল কাফিও তাদের নেতৃত্ব দিতে রাজি হন।
কীভাবে বানালেন তারা ড্রোন
এপ্রিলের ১৭ তারিখ 'ব্র্যাকইউ দ্বিচারী' প্রজেক্টের রিপোর্ট ও ভিডিও ইআরএল প্রতিযোগিতায় জমা দেয়। ফলাফল চলে আসে পাঁচ-ছয়দিনের মধ্যেই। শুরুর দিকে যে ড্রোনটা তারা বানিয়েছিলেন সেটা দেখতে অনেকটা খেলনার মতো ছিল। উপদেষ্টা তখন তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করে আরও ভালোভাবে কাজ করার জন্য। কারণ অংশগ্রহণকারী অন্যান্য দলের কাজ আরও ভালো ছিল। শুরুতে তাদের কাছে তেমন ফান্ডিং ছিল না বলে কাজও ভালো হচ্ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফান্ডিং পাওয়ার পর তারা এই খেলনা ড্রোনকে কার্বন ফাইবার ড্রোনে পরিণত করে।
ড্রোন বানানোর জন্য প্রথমে কীভাবে কাটা হবে বা ফ্রেমে ডিজাইন করা হবে তা ঠিক করা হয়। এরপর মোটর আউটসোর্স করার কাজ করেন তারা, কারণ দেশে এই ধরনের মোটর সহজলভ্য ছিল না। অবশেষে তারা আড়াই কেজির ব্রাস দেয়া চারটি মোটর সংগ্রহ করেন। এর মধ্যে একটি মোটর আবার বেশ পুরোনো।

মোটরের জন্যই তারা ভালো প্রপেলারটি পায়নি, পরিবর্তে অন্য আরেকটি প্রপেলার তাদের সংগ্রহ করতে হয়। বাংলাদেশের প্রপেলারগুলো খুবই পাতলা হয়, বাতাসের তোড়েই ভেঙ্গে যায়। কীভাবে না ভেঙ্গে প্রপেলার ঠিক রাখা যায় সেটি নিয়ে তারা ভিন্ন পরিকল্পনা করে। এক্ষেত্রে ত্রাতা হয়ে এগিয়ে আসেন তাদেরই একজন বড় ভাই। তার কাছে কার্বন ফাইবার প্রপেলার থাকায় এ যাত্রাতেও দল দ্বিচারী বেঁচে যায়। একসেট মোটর আর একসেট প্রপেলার নিয়েই পোল্যান্ডের পথে যাত্রা করে তারা।
এ তো গেল ড্রোনের গল্প। রোভার কীভাবে পায় তা জানতে চাইলে সাদীকুল আলীম ত্বকী জানান, 'রোভারের আইডিয়ার জন্য আমরা খলিল স্যারের কাছে যাই। স্যারের কাছে আগের একটা বেইস ছিল, জাস্ট বডির অংশ। স্যার আমাদের সেটি নিয়ে কাজ করতে বলেন। আমরা সেটা নিয়ে কাজ শুরু করি। আস্তে আস্তে আরও মেকানিক্যাল ইম্প্রুভমেন্ট করি। সেটাই আমরা প্রতিযোগিতায় নিয়ে যাই।'
কী ছিল প্রতিযোগিতায়
প্রতিযোগিতায় অনেকগুলো পর্যায় বা লেভেল আছে। একটি পার করে আরেকটি পর্যায়ে যেতে হয়। কেমন ধরনের প্রতিযোগিতা ছিল জানতে চাইলে প্রকল্পের ইঞ্জিনিয়ারিং ম্যানেজার জহির উদ্দীন জানান, 'প্রতিযোগিতা এমন ছিল যে আমরা একটা জায়গায় যাব, গিয়ে দেখব মানুষ বেঁচে আছে কী না, সেখানে কী ধরনের ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতি কী কী হয়েছে তা বোঝানোর জন্য ওরা কিছু কালার ইন্ডিকেশন দিতে থাকে। আবার মানুষের মতো কিছু ম্যানিকুইন বসানো থাকে। রোভারকে এগুলো খুঁজে বের করতে হবে'।
প্রতিযোগিতার জন্য কর্তৃপক্ষ একটি দৃশ্য তৈরি করে দেবে আর সেই দৃশ্যের মাধ্যমে প্রতিযোগীদের পরিস্থিতি বুঝে নিতে হবে। পরিস্থিতি বিবেচনা করে রোভার ও ড্রোনকে কাজে লাগাতে হবে তাদের।
পোল্যান্ডে দুঃসাহসিক অভিযান!
প্রতিযোগিতার দিকে যাওয়ার পথেও উপস্থিত হয় পদে পদে বিপদ। যেদিন দলটি বার্লিন পৌঁছায় সেদিন এয়ারপোর্টে লাগেজ আটকে যায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ড্রোনের পাইলট মোহাম্মদ ফিরোজ ওয়াদুদ জানান, 'আমাদের আবার হোটেল বুক দেওয়া ছিল পোল্যান্ডে। আমরা যদি না যাই তাহলে বার্লিনে আবার হোটেল বুক দেওয়া লাগবে সেক্ষেত্রে রিফান্ডও পাব না। তাই স্যারসহ দুইজন বার্লিনে থেকে যায় আর আমরা বাকিরা চলে যাই পোল্যান্ডে।'

কোনোরূপ লাগেজ ছাড়াই দল দ্বিচারী রওনা হয় পোল্যান্ডের পোজনান শহরের উদ্দেশে। পোল্যান্ডে খালি হাতে পৌঁছানোর কারণে অখণ্ড অবসর। যদিও তাদের পূর্ব পরিকল্পনা ছিল পোল্যান্ডে পৌঁছে তারা রোভার সেটাপ করবে, পরীক্ষা করে দেখবে তা ঠিকঠাক চলছে কী না। কিন্তু বিধি বাম, সেটা এ যাত্রায় সম্ভব হলো না।
অবশ্য লাগেজ সময়মতো না পৌঁছানো কিঞ্চিৎ শাপে বর হয়ে এলো তাদের কাছে। দুদিন সময় পাওয়ায় পোজনান শহরে ইচ্ছেমতো ঘোরাঘুরি করার সুযোগ কিন্তু তারা হাতছাড়া করেননি।
'কোয়াইট আওয়ার' ভঙ্গ
পোল্যান্ড শহরের একটি অদ্ভুত অলিখিত নিয়ম আছে। রাত দশটা থেকে ভোর ছয়টা পর্যন্ত জোরে আওয়াজ করে কথা বলা যাবে না। একে 'কোয়াইট আওয়ার' বলে বিবেচনা করা হয়। যদি উক্ত সময়ের মধ্যে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটে কিংবা জোরে আওয়াজ করার কারণে কোনো প্রতিবেশী বিরক্ত হন, তবে পুলিশ ডাকার অধিকারও তাদের আছে।
পোজনান শহরে এই নিয়ম নিয়েও মজার ঘটনা ঘটে তাদের সাথে। কথায় আছে, 'ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে'। তাই স্বর্গে গিয়ে ঢেঁকির ধান ভানার মতো হুল্লোড়প্রিয় বাঙালি জাতির চুপ করে থাকা ধাতে নেই। ফলে সেই শহরে থাকাকালীন ভোর চারটার সময় দলের কয়েকজন সদস্য গান গেয়ে ওঠে।
ব্যস! নিয়ম ভাঙায় হোটেল কর্তৃপক্ষ থেকে একজন এসে চেঁচামেচি জুড়লো। অবশ্য কোনো সাজা পেতে হয়নি। কিন্তু কোলাহলপূর্ণ ঢাকা শহরে দাঁড়িয়ে এ কথা বলতে গিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে দ্বিচারী দলের সদস্যরা।

আত্মবিশ্বাস ছিল তুঙ্গে
লাগেজ কিংবা যন্ত্রপাতি সময়মতো না পৌঁছানো তাদের আত্মবিশ্বাসে বিন্দুমাত্র ফাটল ধরাতে পারেনি। যন্ত্রপাতি সমেত লাগেজ হাতে পান প্রতিযোগিতার একদিন আগে।
পোজনান শহরের সৌন্দর্য অতুলনীয়। ইউরোপের অনেক মানুষ এই শহরে ছুটিতে সময় কাটাতে আসে। দ্বিচারী দল তাই এই ভীড়ের মধ্যে পোজনান শহরে আর লাগেজ খুলে রোভার আর ড্রোন সংস্থাপন করেননি। একদিনের জন্য তারা যান পোল্যান্ডের বাবিমোস্ট শহরে। সন্ধ্যাবেলা শহরে পৌঁছে হোটেলে গিয়ে রাতের খাবারদাবার শেষে শুরু হয় রোভার আর ড্রোনের সব যন্ত্রপাতি একত্রিত করার কাজ। দুটি দলে ভাগ হয়ে নির্ঘুম রাতে ড্রোন আর রোভার নিয়ে কাজ করেন তারা।
ভোর পাঁচটা নাগাদ তাদের কাজ শেষ হয়। কিন্তু যে স্থানটি তাদের যন্ত্রপাতি একত্রিত করার জন্য বরাদ্দ ছিল, সেখানে আকস্মিক বৃষ্টি শুরু হয়। অগত্যা তাদের ফিরতে হয় হোটেলের লবিতে।
লবিতেই তারা রোভার রান করে। কিন্তু এখানেও শুরু হয় যান্ত্রিক গোলযোগ। রোভার রান দেওয়ার পরে সেখান থেকে আওয়াজ করা শুরু করে। তারপর তারা সেখান থেকে রোভারের চাকা ঠিকঠাক চলছে কী না তা যাচাই করার পর বাবিমোস্ট শহর ত্যাগ করেন।
পরদিন সকালে তাদের যাত্রা শুরু হয় ওয়াজা শহরের উদ্দেশে। সেখানে গিয়ে তারা অন্যান্য যন্ত্রপাতি ঠিকমতো আছে কী না সেটা পরীক্ষা করে দেখেন। এরপর শুরু হয়ে যায় প্রতিযোগিতা।

প্রতিযোগিতার দিনগুলো
পুরো প্রতিযোগিতাটিকে তিনভাগে ভাগ করা হয়। প্রথম ধাপটি হলো রিপোর্ট ও ভিডিও সাবমিশন। এই ধাপ উত্তীর্ণ হলে তারা মূল প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার জন্য বিবেচিত হবেন। এরপর সেফটি চেক নামে আরেকটি পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয় তাদের। ড্রোনের সাথে যুক্ত থাকে সেফটি সুইচ, যার উপর ভিত্তি করে দ্বিতীয় ধাপ পার করতে হয়। এই ধাপ উত্তীর্ণ হলেই যাওয়া যায় মূল প্রতিযোগিতায়। কোডিং-এ কিছু ভুল থাকার কারণে সেফটি চেক পরীক্ষায়ও শুরু হয় সাময়িক গোলযোগ। পরে অবশ্য উপদেষ্টার সহায়তায় এই সমস্যাও মিটে যায়। এরপর শুরু হয় চূড়ান্ত প্রতিযোগিতা।
মূল প্রতিযোগিতার আগেরদিন তারা সব যন্ত্র সংস্থাপন করলেও চূড়ান্তভাবে সব ঠিক আছে কী না তা যাচাই করে দেখতে পারেননি। এর পেছনে সময় স্বল্পতাও অন্যতম কারণ ছিল। তার ওপর পোল্যান্ডে তাদের ব্যক্তিগত গাড়ি না থাকায় অন্যান্য দলের সাথে পাঁচটার মধ্যেই হোটেলে ফিরে আসতে হতো। ফলস্বরূপ কোনোরকম যান্ত্রিক যাচাই ছাড়াই তাদের পা রাখতে হয় প্রতিযোগিতায়।

শূন্য পেয়ে শুরু
এর ফলও অবশ্য তাদের ভুগতে হয়। প্রজেক্ট ইঞ্জিনিয়ারিং ম্যানেজার জহির উদ্দীন জানান, 'যাচাই করে প্রতিযোগিতায় না যাওয়ায় আমরা প্রথম দিনের প্রথম ট্রায়ালেই বড় ঝামেলায় পড়ি। আমাদের রোভার চলেনি, টেস্ট ফ্লাই না দেওয়ার কারণে আমাদের ড্রোন কেমন আচরণ করবে সেটাও আমরা জানতাম না। আমাদের প্ল্যানিং-এ একটু সমস্যা ছিল, যার জন্য প্রথম ট্রায়ালে আমরা জিরো পাই'।
প্রথম পরীক্ষাতেই শূন্য পাওয়ায় কিছুটা হতাশা তাদের গ্রাস করে। তারপরেও তারা আবার পরের ট্রায়ালে ভালো নাম্বার পাওয়ার জন্য নতুনভাবে পরিকল্পনা করতে বসে। প্রতিদিন দুটি করে ট্রায়ালে তাদের অংশ নিতে হতো। প্রথম দিনের দ্বিতীয় ট্রায়ালে তারা গাইডলাইন মেনে ড্রোন উড়ানোর কারণে কিছু নাম্বার পায়।
এরপর থেকেই শুরু হয় তাদের প্রবল অধ্যবসায়। প্রতিদিনই তাদের চেষ্টা থাকতো আগের দিনের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার। কখনো ভাগ্য হয়তো সহায় হতো, কখনো হতো না। দ্বিতীয় দিনের প্রথম ট্রায়ালে তাদের আবার নতুন ঝামেলার সম্মুখীন হতে হয়।
'আমাদের ড্রোনে একটা বার্জার লাগানো আছে, যেটা ব্যাটারি লো হলে বিপ বিপ বিপ করে আওয়াজ করে। কিন্তু ড্রোনের পপের সাউন্ড এর থেকে বেশি হওয়ায় সেই বিপ সাউন্ড আমরা শুনতে পাইনি। ফলে ড্রোনের ব্যাটারি শেষ হয়ে যায়, ড্রোন ক্র্যাশ করে। আর আমাদের যেহেতু সব হ্যান্ডমেইড ছিল ক্র্যাশ করার কারণে ল্যান্ডিং গিয়ার ভেঙে যায়। বাংলাদেশে ড্রোনের কম্পোনেন্টস এভেইলেবল না হওয়ায় আমরা এক সেটের বেশি কিছুই নিয়ে যেতে পারিনি', বলছিলেন জহির উদ্দীন।
হোটেলে ফিরে শুরু হয় নতুন চ্যালেঞ্জ। ফেটে যাওয়া ড্রোন ঠিক করতে না পারলে যাত্রাপথ এখানেই শেষ হয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে। প্রথমে ল্যান্ডিং গিয়ার জিপ-টাই দিয়ে কোনোভাবে চালানোর মতো ঠিকঠাক করা হয়। ড্রোনের পপের ওপর ইপোক্সি আর সুপারগ্লু দিয়ে মেরামত করার চেষ্টা করা হয়। এরপর গ্লাইন্ডার দিয়ে ঘষে মসৃণ করা হয়।

শেষ দানে বাজিমাত
প্রতিযোগিতার স্থলে তাদের সাথে একজন সেফটি পাইলট ছিলেন, যিনি পোল্যান্ডেরই অধিবাসী। পরদিন সবাইকে তাক লাগিয়ে তারা পুনরায় প্রতিযোগিতার স্থলে যান। জোড়া লাগানো ড্রোন দেখে সেফটি পাইলটও অবাক হয়ে যান। এবার অবশ্য ড্রোন ভালোভাবেই উড়ল। আর কোনো সমস্যা হয়নি। তৃতীয় দিনের ট্রায়ালে সবকিছুই ঠিকঠাকভাবে চলে। ম্যানিকুইন পর্যন্ত পৌঁছে যান তারা।
চতুর্থ দিন প্রতিযোগিতার স্থানে বাতাসের বেগ ছিলো ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটারের মতো। সেদিন দ্বিচারী ছাড়া আরেকটি দল ড্রোন নিয়ে প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। সেদিন বাতাসের বেগ এত বেশি ছিল যে ড্রোন নিজেদের আয়ত্বে রাখাও কষ্টকর হয়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু এবারেও টাল সামলাতে না পেরে ড্রোন ওপর থেকে পড়ে ভেঙ্গে যায়।
ভাঙ্গা ড্রোন পরে অবশ্য আবার ঠিক করা হয়। সেই ড্রোন এবার আর প্রতিযোগিতায় নয়, নিজেদের কাজেই ব্যবহার করে দল দ্বিচারী। দলের পাইলট মোহাম্মদ ফিরোজ ওয়াদুদ হেসে জানান, 'প্রতিযোগিতার শেষে আমরা বারবিকিউয়ের জন্য কয়লা জ্বালানোর চেষ্টা করছিলাম। বাতাস করে আমরা আর পারছিলাম না। তখন ওই ড্রোন ঠিকঠাক করেই বাতাসের ব্যবস্থা করা হয়।'

উপদেষ্টার ভরসার জায়গা
'ব্র্যাকইউ দ্বিচারী' দলের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ ইঞ্জিনিয়ারিং এর গবেষণা সহযোগী আবদুল্লাহ হিল কাফি। কাফি জানান, 'গত এপ্রিল মাসে দ্বিচারী দল আসে আমার কাছে। কম্পিটিশনে বেশি সময় ছিলো না; প্রজেক্ট প্রপোজাল জমা দেয়ার জন্য হাতে সময় ছিল ৭দিন। এত কম সময় দেখে আমি তখন এই প্রজেক্টে যুক্ত হতে চাচ্ছিলাম না। কিন্তু ওরা আমাকে ভুল প্রমাণ করে। তারপরেই শুরু হলো সবাই মিলে পথ চলা'।
'ব্র্যাকইউ দ্বিচারী' নিয়ে ভীষণ আশাবাদী আবদুল্লাহ হিল কাফি। এই দলের পরিশ্রম, ক্রমাগত নিজেদের ভালো অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার প্রাণান্তকর চেষ্টা, সর্বোপরি ভেঙে না পড়ে ইতিবাচকতা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার গুণ- মুগ্ধ করেছে তাকে। তাই শুরুতে এতটা ভরসা করতে না পারলেও পরে এই দলটিই তাকে ভুল প্রমাণ করে।
শুরু থেকেই নেতৃত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে নিজের পূর্ব অভিজ্ঞতা দলের মাঝে ছড়িয়ে দিতে থাকেন আবদুল্লাহ হিল কাফি। ভবিষ্যতে এরা আরও এগিয়ে যাবেন এমনটাই কামনা আবদুল্লাহ হিল কাফির।

বর্তমান পরিকল্পনা
দেশে ফেরার পর 'ব্র্যাকইউ দ্বিচারী'র মূল লক্ষ্য প্রতিযোগিতায় তাদের যেসব উদ্ভাবন ছিলো সেগুলো নামকরা আন্তর্জাতিক প্রকাশনায় প্রকাশ করা। সেটা নিয়েই এই মুহূর্তে পরিকল্পনা চলছে।
প্রকল্পটি দেশের কাজে ব্যবহারের চিন্তাভাবনাও তাদের আছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রকল্পটি নিয়ে দেশের বনবিভাগের সাথেও আলাপ আলোচনা করেছেন। জহির উদ্দীন জানান, 'বন বিভাগ ড্রোন দিয়ে বন পর্যবেক্ষণ করে, এজন্য তারা বাইরে থেকে অনেক টাকা খরচ করে তাদের ড্রোন কেনে। ড্রোনগুলোর দামও অনেক বেশি, আমরা এই ক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারি। আমরা ওনাদের এটি নিয়ে একটা প্রপোজালও দিয়েছিলাম। যেখানে বলা হয়েছে, স্বয়ংক্রিয় ড্রোন একটা নির্দিষ্ট জায়গা থেকে উড়ে গিয়ে নির্ধারিত এলাকার গাছগুলো কেমন আছে বা কেউ গাছ পাচার করছে কী না বা কোনো অনৈতিক কাজ হচ্ছে কী না, তা ঘুরে দেখবে। এতে কাজটা যেমন সহজ হবে, নিজেদের বানানো ড্রোন হওয়ায় খরচও কমে যাবে। তাছাড়া আমাদের মূল উদ্দেশ্য হলো দুর্যোগের সময় রোভার ও ড্রোন কাজে লাগিয়ে উদ্ধার কার্যক্রমে সহায়তা করা। সেটি নিয়ে আমরা ওয়ালটনের সহযোগী হয়ে কাজ করছি'।