মহামারিতে সম্পূর্ণ বিপরীত নির্বাচনী কৌশল অবলম্বন করছেন ট্রাম্প ও বাইডেন

আগামী ৩ নভেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে ঘিরে জমে উঠেছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তার প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্রেট দলের প্রার্থী জো বাইডেনের লড়াই। প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন দুজনেই । কিন্তু, নতুন করোনাভাইরাসে পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবিত এ দেশটিতে ভোটব্যাংক দখলে সম্পূর্ণ দুই ধরনের প্রচারণা কৌশল বেঁছে নিয়েছেন তারা।
প্রথমেই আসা যাক রিপাবলিকান দলের প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের মহামারির মধ্যে নির্বাচনী কৌশল প্রসঙ্গে। এক্ষেত্রে, প্রথম উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে নর্থ ক্যারোলিনা অঙ্গরাজ্যে তার সাম্প্রতিক প্রচারাভিযানে। রাজ্য প্রশাসন সেখানে ৫০ জনের বেশি লোক একত্রে জড়ো হওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন। কিন্তু, একথা ট্রাম্প বা তার সমর্থকদের কে বোঝাবে! নির্বাচনী ফলাফল নির্ধারণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এ রাজ্যে তিনি কয়েক হাজার মাস্কবিহীন সমর্থকের ভিড়ে তীব্র উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন।
এসময় ট্রাম্প বলেন, 'যতদূর দৃষ্টি যায় শুধু মানুষ আর মানুষ। আগের নির্বাচনের তুলনাতেও এবার বেশি সংখ্যক লোক এসেছেন বলেই আমার বিশ্বাস।' জনস্বাস্থ্য নীতিমালাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েই এমন মন্তব্য করেন তিনি। খবর এপির।
বাইডেন শিবিরের চিত্রটি অবশ্য ভিন্ন। বাইডেন এই রাজ্যে এসে একটি বাড়ির আঙ্গিনায় আয়োজিত এক ছোট্ট সমাবেশে অংশ নেন। স্বাস্থ্যবিধি এত কঠোরভাবে অনুসরণ করা হয় যে, সমবেত ভিড়ের জনসংখ্যা কম রাখতে বাধ্য হয়েই সমাবেশস্থল ত্যাগ করেন বাইডেনের কিছু কর্মী। তাছাড়া, তার নির্বাচনী টিম সামাজিক দূরত্বের মতো বিষয়টি মানতেও সতর্ক ছিল।
এব্যাপারে বাইডেনের প্রতিক্রিয়া হচ্ছে-'সমর্থকদের সঙ্গে হাত মেলানো, আরও ঘনিষ্ঠভাবে কুশল বিনিময়ের সুযোগটা মিস করছি। কিন্তু, এ মুহূর্তে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের স্বার্থে- তা করাও উচিৎ হবে না।'
পার্থক্যটা এভাবে তৈরি হয়েছে দুই প্রার্থীর নির্বাচনী মনোভাব ও মহামারিতে নির্বাচনী কৌশলে। ৩ নভেম্বরের নির্বাচনকে লক্ষ্যে রেখে দুই ভিন্ন পথের যাত্রী হয়েছেন তারা। শুধুমাত্র রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে নয়- মহামারি নিয়ন্ত্রণে উভয়ের ভিন্ন মনোভাবও এতে প্রকাশ পায়।
যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ গড়ার দুই ধরনের পরিকল্পনা তুলে ধরেছেন তারা। বাইডেন প্রত্যেক অঙ্গরাজ্যের জন্য স্থানীয় প্রশাসনের দিক-নির্দেশনা মেনে চলার প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছেন। অন্যদিকে, ট্রাম্প যেকোনো প্রকার নিষেধাজ্ঞার বিরোধিতা করে বলছেন, এসবই নাকি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
নর্থ ক্যারোলিনার সমাবেশে খোলাখুলি বিষয়টি তুলে ধরেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
'আপনাদের রাজ্য প্রশাসনের উচিৎ সব নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের মাধ্যমে অর্থনীতিকে উন্মুক্ত করা' তিনি বলেন। নর্থ ক্যারোলিনার ডেমোক্রেট দলীয় গভর্ণর রে কুপার রাজ্যের শার্লট শহরে রিপাবলিকান দলের জাতীয় সমাবেশ অনুষ্ঠান বাতিলের অনুরোধ করেছিলেন। এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে ট্রাম্প বলেন, 'সমস্যা সমাবেশস্থল নিয়ে নয়। সমস্যা অন্যখানে। যেমন মিশিগান একটি সমস্যা। আপনিও সেই সমস্যা তৈরি করছেন' এভাবেই ডেমোক্রেট দল শাসিত গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যগুলির প্রশাসকদের আক্রমণের নতুন কৌশল অবলম্বন করেছেন মার্কিন রাষ্ট্রপতি।
ট্রাম্পের সহযোগী এবং মিত্ররা জানান, অর্থনৈতিক উত্তরণের পথে বাঁধা তৈরি করার জন্য ডেমোক্রেটরা মহামারিকে নির্বাচনী ইস্যুতে রূপান্তর করেছে, বলে প্রেসিডেন্ট বিশ্বাস করেন। অর্থনীতিতে গতি ফেরানোর তার লক্ষ্য অর্জনে এটি বাঁধা এবং ভোটাররাও নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার চান, বলেই মনে করেন তিনি।
একারণেই আগেভাগে অর্থনীতিকে উন্মুক্ত করার ফলে সংক্রমণ পরিস্থিতির তীব্র অবনতির আশঙ্কা যারা করেছেন, তাদের আক্রমণ করেই চলেছেন ট্রাম্প। মূল লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে সতর্ক দিক-নির্দেশনা বজায় রাখা ডেমোক্রেট শাসিত রাজ্য গভর্ণরেরা।
ট্রাম্প ইঙ্গিত দেন যে, নির্বাচনের একদিন পরই এসব রাজ্য নিজে থেকেই উন্মুক্তকরণের পথে হাঁটবে। তার পুনঃনির্বাচিত হওয়ায় আর বাঁধা সৃষ্টির প্রয়োজন না থাকায়- তখন এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, বলেও জানান তিনি।
নিজ প্রশাসনের দেওয়া জনস্বাস্থ্য বিষয়ক পরামর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক অবস্থানে নিয়ে গেছে মার্কিন প্রেসিডেন্টের এমন রণনীতি। যার সমালোচনা করেছেন তার জাতীয় স্বাস্থ্য উপদেষ্টা এবং শীর্ষ সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞ ড. অ্যান্থনি ফাউচি।
সিবিএস নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ফাউচি জানান, ট্রাম্পকে নির্বাচনী প্রচারণায় ফিরতে দেখে তিনি গভীর হতাশা অনুভব করছেন। রাষ্ট্রের শীর্ষ নেতৃত্বের ব্যাপারে তার বক্তব্য ছিল; 'আমরা সকলের জন্য একটি আদর্শ উদাহরণ তুলে ধরতে পারতাম। কিন্তু, এখন যা হচ্ছে-তা মেনে নেওয়া যায় না।'
মহামারির শুরুর দিকে ইনডোর আবহেই অধিকাংশ সভা-সমাবেশ করেছেন ট্রাম্প। বদ্ধ জায়গায় ভিড়ের গুঞ্জন আর নিজ বক্তব্যের প্রতিধব্বনি যেন তাকে আরও রোমাঞ্চিত করে। কিন্তু, ধারাটা পাল্টে দেয় গত জুনে ওকলাহোমার টুসলা রাজ্যে আয়োজিত এক ইনডোর সমাবেশ। সমাবেশস্থল স্টেডিয়ামের অর্ধেক আসনই ছিল খালি, অথচ ৫০ হাজারের বেশি মানুষ এতে অংশ নেবে- বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন ট্রাম্প। তারপর থেকেই সমাবেশের জন্য বিমানবন্দরের হ্যাঙ্গার বা টারমাক ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয় তার নির্বাচনী টিম।
তবে একটা জিনিস কিন্তু একেবারেই বদলায়নি। আগের মতোই নিজ সমাবেশে অংশ নেওয়াদের সংখ্যাকে বাইডেনের সমাবেশে অংশ নেওয়া লোক সংখ্যার সঙ্গে তুলনা করে চলেছেন মার্কিন রাষ্ট্রপতি।
'ওর সমাবেশে যদি ২৬০ জন লোকও হয়, তাহলেই তা অনেক' গত মঙ্গলবাড়ি নিজ প্রতিপক্ষের প্রতি এ টিপ্পনী কাটেন তিনি।
'গোলাকৃতির ব্যায়ামাগার কখনও দেখেছেন, যেখানে খুব বেশি হলে মাত্র দুইশ' লোক হতে পারে! এটাই ওর (বাইডেনের) জনসভার চেহারা' তিনি যোগ করেন।
ব্যাপারটি অবশ্য মোটেই বানিয়ে বলা নয়। বাইডেন সমাবেশে ভিড় সীমিত রাখতেই আগ্রহী। আর এমনটাই দেখে যাচ্ছে, তার রাজনীতির জনসংযোগ কর্মধারায়। তাছাড়া, মহামারির পর থেকে জনসমাগম স্থলে খুবই কম উপস্থিত হয়েছেন প্রাক্তন এ ভাইস প্রেসিডেন্ট। কোথাও উপস্থিত হলেও, সেক্ষেত্রে পালন করেছেন কঠোর স্বাস্থ্যবিধি। ইতোপূর্বে, স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নিয়মকে সম্মান জানিয়ে; পেনিলেভানিয়ায় মাত্র ২৫ জনকে নিয়ে সমাবেশ করেন। আর মাত্র ১০জন ছিল তার মিশিগানের সমাবেশে। ওই ক্ষুদ্র জমায়েতের সকলেই আবার রাজ্য প্রশাসনের নিয়ম মেনে মাস্ক পড়ে উপস্থিত হয়েছিল সেখানে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, মূল সমর্থক গোষ্ঠীর চিন্তাধারা এবারের নির্বাচনী প্রার্থীরা বেশ ভালোই রপ্ত করেছেন। বাইডেনের অধিকাংশ সমর্থক যেমন জনসমাগম স্থলে যোগ দিতে অনিচ্ছুক, স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করতে চান- ঠিক তার বিপরীতেই আছেন ট্রাম্প ও তার সমর্থকেরা। নির্বাচনী প্রতিযোগিতার বিপরীতমুখী এ দুই ধারা বিশ্বের শীর্ষ পরাশক্তিটির সংক্রমণ পরিস্থিতিতে কী প্রভাব ফেলে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।