ভারতে করোনাভাইরাস: জীবন-মৃত্যুর সিদ্ধান্ত ঠিক করে দেওয়া বার্তাগুলো
করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ে বিপর্যস্ত ভারত। প্রতিদিন সাড়ে তিন লাখেরও বেশি নতুন রোগী শনাক্ত হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো ভারি হয়ে উঠেছে আক্রান্তদের স্বজনদের সাহায্যের আবেদনে।
দিন-রাত একাকার করে তারা ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করছেন। হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ও ফোনবুক ঘেঁটে বিভিন্ন নম্বরে পাঠাচ্ছেন মেসেজ বা ক্ষুদে বার্তা। হাসপাতালের শয্যা, অক্সিজেন, কোভিডের ওষুধ রেমডিসিভির ও প্লাজমার সন্ধানে দিশেহারা তারা।

পরিস্থিতি খুবই গোলমেলে ও টালমাটাল। একটি হোয়াটসঅ্যাপ বার্তায় প্রচার করা হয়: 'দুটি আইসিইউ বেড ফাঁকা রয়েছে।' কয়েক মিনিটের মধ্যেই সেটিও ভরে গেছে- 'আগে এলে আগে পাবেন' ভিত্তিতে। আরেকটি বার্তায় লেখা হয়: 'দ্রুত ভিত্তিতে অক্সিজেন কনসেনট্রেটর দরকার। দয়া করে সাহায্য করুন।'
ভারতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা যখন হিমশিম খাচ্ছে, জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছে যার-যার প্রচেষ্টা তার-তার করার বাস্তবতা আর নিয়তি।
কিন্তু সরবরাহের ক্ষমতাকে বহুদূর ছাপিয়ে গেছে চাহিদার চাপ। বিলাসিতা করার কোনোই সুযোগ নেই।
গত শুক্রবার যখন আমি এই লেখা লিখতে শুরু করি, এমন এক লোকের সঙ্গে আলাপ হয়, উত্তর প্রদেশের যে লোক তার ৩০ বছর বয়সী কাজিনের জন্য অক্সিজেন চেয়ে হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা দিয়েছেন। রোববার এ লেখা যখন শেষ করলাম, খোঁজ নিয়ে জানি, আক্রান্ত লোকটি মারা গেছেন!
নিজেদের প্রিয় মানুষের জীবন বাঁচানোর অবিরাম প্রচেষ্টায় ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে উঠেছেন আরও অনেকেই।
'আমি যখন ফোন করতে শুরু করি, ভারতে সময় তখন সকাল ৬টা। আমরা জানতে পারি, আমার নানার সেদিনই অক্সিজেন কিংবা ইনজেকশন লাগবে। আমরা হোয়াটসঅ্যাপে একের পর এক বার্তা দিতে থাকি; পরিচিত সবাইকে করতে থাকি ফোনকল,' বলেন অবণী সিং।
তার ৯৪ বছর বয়সী নানা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে দিল্লিতে ভয়াবহ অসুস্থ। যুক্তরাষ্ট্রে নিজেদের বাসা থেকে অবণী ও তার মা অমৃতা পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মী- সবার সঙ্গে সাহায্য চেয়ে যোগাযোগ করতে থাকেন। ওদিকে দিল্লিতে অবণীর নানার শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটছিল।
"পরিচিত সবার সঙ্গেই যোগাযোগ করতে থাকি আমরা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে আমি নজর রাখছিলাম। 'ওখানে আইসিইউ বেডের নিশ্চয়তা দিচ্ছে', কিংবা 'এখানে এক্সিজেন আছে'- এ ধরনের পেজগুলো ফলো করতে থাকি। এ সময়ে প্রায় ২০০টি জায়গায় চেষ্টা চালিয়েছি আমরা,' বলেন অবণী।
অবশেষে এক স্কুল সহপাঠীর মাধ্যমে তারা একটি হাসপাতালে বেডের ব্যবস্থা করতে পারলেও জানতে পারেন, সেখানে কোনো অক্সিজেন নেই। ততক্ষণে অবণীর নানা অজ্ঞান হয়ে গেছেন। 'এরপর আমি ফেসবুকে একটা আবেদন জানিয়ে পোস্ট করি। সেটির সূত্র ধরে পরিচিত এক বন্ধু অক্সিজেন রয়েছে- এমন একটি ইমার্জেন্সি বেডের খোঁজ দেয়। ওই বন্ধুর সহযোগিতাতেই সে রাতে প্রাণ বাঁচে আমার বাবার', বলেন অমৃতা।
শনিবার যখন তাদের সঙ্গে কথা হয়, অবণীর নানার শারীরিক অবস্থা তখন একটু উন্নতির দিকে। কিন্তু অবণী ও তার মায়ের জন্য নতুন লড়াই শুরু হয়- রেমডিসিভির ইনজেকশনের ব্যবস্থা করা। তারা আবারও জনে জনে ফোন করতে শুরু করেন। আর যেখানে যেখানে খোঁজ পান, সেসব লোকেশনের কথা জানিয়ে দেন অবণীর মামাকে। অবণীর মামা দিল্লিতে এক দিনে প্রায় ১৬০ কিলোমিটার গাড়ি চালিয়ে সেগুলো সংগ্রহ করেন।

'আমার নানা আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। ইনস্টাগ্রামে যারা সাহায্যকারী পেজগুলো চালাচ্ছেন, শুধুই ধন্যবাদ দিয়ে সেই ঋণ শোধ করা যাবে না,' বলেন অবণী।
তবে এ ধরনের তথ্য খুব দ্রুতই অচল হয়ে যায়। তাছাড়া ফেক হওয়ার ঝুঁকিও থাকে।
'আমরা জানতে পেরেছিলাম, একটা ফার্মেসিতে ইনজেকশন আছে। কিন্তু যখন আমার কাজিন সেখানে পৌঁছল, ততক্ষণে একটাও নেই। ফার্মেসিটি খোলা হয়েছিল সকাল সাড়ে আটটায়। লোকেরা এরজন্য আগের দিন মাঝরাত থেকে লাইন ধরে দাঁড়িয়েছিল। শুধু প্রথম ১০০ জনই ইনজেকশন কিনতে পেরেছে।'
'এখন কালোবাজারে ওষুধ বিক্রি হচ্ছে। ১২০০ রুপি দামের ওষুধ তারা বিক্রি করছে ১ লাখ রুপিতে। আর সেগুলো আদৌ আসল কি না, এরও কোনো নিশ্চয়তা নেই,' বলেন অমৃতা।
তবে ব্যক্তিগত যোগাযোগের ওপর নির্ভরশীল যেকোনো ব্যবস্থার ক্ষেত্রেই প্রত্যেকের ক্ষেত্রে সমান ন্যায্যতার নিশ্চয়তা নেই। টাকা, পারিবারিক যোগাযোগ, উচ্চতর সামাজিক মর্যাদা, এবং একই সঙ্গে ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোন ব্যবহারের সক্ষমতা এসব ক্ষেত্রে সাফল্যের বড় সুযোগ বয়ে আনে।
চলমান বিশৃঙ্খলার মধ্যেই বেশ কিছু ব্যক্তিমানুষ খেটে যাচ্ছেন কমিউনিটি গ্রুপ প্রতিষ্ঠা এবং ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টগুলোতে প্রকাশিত যোগাযোগ নম্বরগুলো কিছুটা গুছিয়ে তথ্যগুলো কেন্দ্রীভূত করার কাজে।
ভারতের রাজধানী দিল্লির একটি কলেজের ছাত্রী ২০ বছর বয়সী অর্পিতা চৌধুরী এমনই একজন। তিনি ও তার কলেজের কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী মিলে একটি গ্রুপ করেছেন অনলাইনে ভেসে বেড়ানো তথ্যগুলো নিজেরা যাচাই করে একটি অনলাইন ডাটাবেস তৈরির কাজে।

'প্রতিটি ঘণ্টা ও মিনিটেই এটি বদলে যায়। পাঁচ মিনিট আগে আমাকে একটি হাসপাতাল জানিয়েছিল, সেখানে ১০টি বেড ফাঁকা রয়েছে; কিন্তু পাঁচ মিনিট পর ফোন করতেই জানাল, একটাও ফাঁকা নেই আর,' বলেন অর্পিতা।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অক্সিজেন, বেড, প্লাজমা কিংবা ওষুধ থাকার বিজ্ঞাপন বা পোস্ট যতগুলো চোখে পড়ে, তিনি ও তার সহকর্মীরা সেগুলোতে থাকা ফোন নম্বরে কল করে তথ্য যাচাই করেন এবং তারপর গুছিয়ে অনলাইনে প্রকাশ করেন। এরপর, যারা কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসায় এ ধরনের সাহায্য চান, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন অর্পিতা ও তার সহকর্মীরা।


'এভাবে আমাদের পক্ষে কিছু করা সম্ভব বলে মনে করি,' বলেন তিনি।
গত শুক্রবার আদিত্য গুপ্ত আমাকে জানিয়েছিলেন, উত্তর প্রদেশের গোরাখপুরে নিজের ভয়াবহ অসুস্থ কাজিন সৌরভ গুপ্তের জন্য তিনি একটি অক্সিজেন কনসেনট্রেটর খুঁজছেন। ভারতের ওই অঞ্চলে কোভিডের প্রকোপ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে; প্রতিনিয়ত বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা।
৩০ বছর বয়সী প্রকৌশলী সৌরভ ছিলেন তার পরিবারের জন্য গর্ব ও আনন্দের উৎস। তার বাবা একটি ছোট্ট দোকান চালান। নিজের জমানো সব টাকা তিনি এই সন্তানের পড়াশোনায় ব্যয় করেছেন।
"গোরাখপুরের প্রায় সব হাসপাতালেই আমরা ধর্ণা দিয়েছি। বড় হাসপাতালগুলো সব পূর্ণ। বাকিগুলো আমাদের বলেছে, 'যদি নিজেরা অক্সিজেনের ব্যবস্থা করতে পারেন, তাহলে আপনাদের রোগীকে ভর্তি নেব'," বলেন আদিত্য।

হোয়াটসঅ্যাপের সাহায্যে তার পরিবার একটি অক্সিজেন সিলিন্ডারের ব্যবস্থা করতে পেরেছিল ঠিকই, কিন্তু সেটি কাজে লাগানোর জন্য কনসেনট্রেটরের দরকার ছিল। শুক্রবার সেটি ছিল আউট-অব-স্টক; তবে এক সরবরাহকারী তাদের একটি দেওয়ার ব্যাপারে নিশ্চয়তা দিয়েছিল। কিন্তু ভীষণ প্রয়োজনীয় সেই ডিভাইস আর আসেনি; সৌরভকেও ভর্তি করানো যায়নি কোনো হাসপাতালে।
রোববার আদিত্য বললেন, 'গতকাল সকালে তাকে আমরা হারিয়েছি। তিনি তার বাবা-মায়ের চোখের সামনেই মরে গেছেন!'
-
বিবিসি থেকে অনুবাদ: রুদ্র আরিফ