ড্যাপ সংশোধন পিছিয়ে যাচ্ছে, সমন্বয় হবে ভবনের উচ্চতা

উপদেষ্টাদের মতানৈক্যের কারণে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) সংশোধন পিছিয়ে যাচ্ছে।
গতকাল বুধবার (১৯ মার্চ) ড্যাপের সংশোধনী চূড়ান্ত করতে উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির একটি সভা অনুষ্ঠিত হলেও সেখানে এ সংশোধনের বিষয়ে একমত হতে পারেননি সবাই। ফলে ৭ সদস্যের কমিটি ওইদিনের বৈঠকে ড্যাপ পুনরায় পর্যালোচনার সিদ্ধান্ত নেয়।
যদিও ঢাকার অধিকাংশ এলাকায় ভবনের উচ্চতা দুই থেকে চার তলা পর্যন্ত বাড়ানোর অনুমতি দিয়ে এদিন পরিকল্পনাটি চূড়ান্ত করার কথা ছিল বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
বুধবার উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির সভায় উপস্থিত এক সদস্য দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "বৈঠকে কয়েকজন উপদেষ্টা ভবনের উচ্চতা শিথিলের বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এছাড়া, ড্যাপ সংশোধনের ক্ষেত্রে নগর পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতিদের মতামত ও পরামর্শকে কেন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি, তা নিয়েও আলোচনা হয়েছে।"
সভায় সভাপতিত্ব করেন অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার।
আইন, গৃহায়ন, জ্বালানি, সড়ক পরিবহন, পরিবেশ ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সদস্যদের নিয়ে গঠিত কমিটি আসন্ন ঈদুল ফিতরের পর বিষয়টি নিয়ে আবার সভা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
বিষয়টিকে ইতিবাচক দেখছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। সংশোধনীতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার ভবনের উচ্চতা তিন থেকে চার তলা পর্যন্ত বাড়ার যে প্রস্তাবনা দিয়েছিলো সেই প্রস্তাবনার সাথে কমিটির সদস্যরা একমত হয়নি বলে জানা যায়।
নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, আবাসন খাতের ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর চাপে সরকার ভবনের উচ্চতা বাড়ানোর পায়তারা হয়েছিলো। এখন যেন নগর পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতিদের সাথে সমন্বয় করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
রাজউক বলছে, ২০২২ এর গেজেটেড ড্যাপে উল্লেখিত ফ্লোর এরিয়া রেশিও (এফএআর) এর মান নিয়ে বিভিন্ন মহলের আপত্তি থাকায় সে বিষয়ে সংশোধনসহ বেশকিছু বিষয়ে সংশোধনের জন্য যে প্রস্তাবনা তোলা হয়েছিলো সেগুলোর পর্যালোচনা করতে আরও কিছু সময় নিবে উপদেষ্ঠারা।
রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ড্যাপের সংশোধনের বিষয়গুলো নিয়ে ঈদের পরে গৃহায়ন ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল এবং পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান আবার বসবেন। তারা পরিকল্পনাবিদ এবং স্থপতিদের পরামর্শ নিতে তাদের সাথে বৈঠকের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আশাকরি সংশোধনীর কিছু বিষয়ে পরিবর্তন আসতে পারে।"
বিষয়টিকে ইতিবাচক দেখছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি)-এর সভাপতি আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, "ড্যাপ সংশোধনের বিষয়ে পরিকল্পনাবিদদের শুরুর দিকে ডাকার পরে আমরা কিছু প্রস্তাবনা দিয়েছিলাম। কিন্তু সংশোধনীতে আমাদের প্রস্তাবনার কিছুই রাখা হয়নি। পরবর্তীতে আমাদের আর কোনো মিটিংয়েও ডাকা হয়নি।"
তিনি বলেন, "তারা পরিকল্পনাবিদদের এড়িয়ে আবাসন ব্যবসায়ীদের খুশি করতে একটি সংশোধন আনতে চেয়েছিলেন। এখন সেটি আটকে গেছে, যা আমাদের আশান্বিত করে। আমাদের প্রস্তাবনার পরে আরও যদি পরামর্শ চায়, তাহলে আমরা সে বিষয়ে মতামত দিতে সবসময় প্রস্তুত।"
"আমাদের যেকোনো পরিকল্পনা করতেই শহরের পরিবেশ ও প্রতিবেশের বিষয়ে মাথায় রাখতে হবে। এ শহর শুধু ভবন আর কনক্রিটের নয়, প্রতিটি জীবেরও সেটাও আমাদের পরিকল্পনার সময় গুরুত্ব দিতে হবে," যোগ করেন এই পরিকল্পনাবিদ।
এর আগে, একটি প্রতিবেদনে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রাজউক কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছিল, চূড়ান্ত হতে যাওয়া ড্যাপ সংশোধনে রাজধানীর 'অধিকাংশ এলাকায়' ভবনের উচ্চতা দুই থেকে চার তলা পর্যন্ত বাড়ানোর পাশাপাশি ভবনের ইউনিট ও ফ্লোর স্পেস বৃদ্ধির অনুমতি মিলবে।
রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) ড্যাপ সংশোধনের পক্ষে থাকলেও নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, আবাসন খাতের ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর চাপে সরকার ভবনের উচ্চতা বাড়িয়ে ঢাকার বাসযোগ্যতা আরও তলানিতে নামাতে ড্যাপ সংশোধন করছে। এতে নগরবাসীর কোনো মতামত এবং নগর পরিকল্পনাবিদদের পরামর্শ মানা হয়নি।
রাজউক কর্মকর্তাও বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, "যদিও রাজউকের এ সকল সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে নগর পরিকল্পনাবিদ ও নগরবাসীর চাওয়াকে প্রাধান্য দেওয়ার কথা, কিন্তু এক্ষেত্রে কিছুটা কম দেওয়া হচ্ছে।"
রাজউক জানিয়েছে, ২০২২ সালের গেজেটভুক্ত ড্যাপে উল্লিখিত ফ্লোর এরিয়া রেশিও (এফএআর) নিয়ে বিভিন্ন মহলের আপত্তির কারণে সংশোধন আনা হচ্ছে। সংশোধিত ড্যাপে কিছু এলাকায় জমির মালিকরা আগের চেয়ে দেড় থেকে দ্বিগুণ উচ্চতার ভবন নির্মাণের অনুমতি পাবেন।
যেমন—মিরপুরে যেখানে সর্বোচ্চ ৫তলা ভবনের অনুমতি ছিল, এখন সেখানে ৭তলা পর্যন্ত আবাসিক ভবন নির্মাণ করা যাবে। উত্তরা তৃতীয় পর্বে ৬তলার পরিবর্তে ১০তলা, মোহাম্মদপুরে ৫তলার পরিবর্তে ৭তলা, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ৬তলার পরিবর্তে ৮তলা এবং গুলশান-বনানীতে সর্বোচ্চ ১১তলার পরিবর্তে ১২তলা ভবনের অনুমোদন দেওয়া হবে।
এছাড়া, নতুন সংশোধনীতে জলাধারের শ্রেণিবিভাগ না রেখে এককভাবে জলাধার হিসেবেই চিহ্নিত করা হবে এবং জলাধার ভরাটের কোনো সুযোগ থাকবে না। একইভাবে, কৃষিজমির বিভিন্ন শ্রেণিবিভাগ না করে শুধুমাত্র কৃষিজমি হিসেবে উল্লেখ করা হবে, এবং এই জমি সংরক্ষণে বিধিনিষেধ কঠোরভাবে পালন করার নির্দেশনা থাকবে।