ফ্যাশন ও পরাবাস্তববাদ: করোনাকালে সালভাদর দালির প্রভাব যেভাবে ফিরে এলো

স্প্যানিশ পরাবাস্তববাদী চিত্রশিল্পী সালভাদর দালি যখন একটি পোশাকে লবস্টার জুড়ে দিয়েছিলেন, তিনি চেয়েছিলেন, সেই ফ্যাশন যেন আলোচিত হয়। তা সেটি হয়েছিল। ১৯৩৭ সালে 'নিয়মভাঙা'র ইতালিয়ান ফ্যাশন ডিজাইনার এলসা শিয়াপারেল্লির সঙ্গে তার কর্ম-সহযোগ বেশ বিদ্রূপের জন্মও দিয়েছিল।
সিল্কের যে অর্গাঞ্জা এ-লাইন গাউন তারা দুজন তৈরি করেছিলেন, সেটি পরনে আমেরিকান সমাজসেবী ওয়ালিস সিম্পসনের ছবি ভোগ ম্যাগাজিনে ছাপা হওয়ার পর অভিজাত শ্রেণি হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। এ নিয়ে ফ্যাশন জগতে ব্যাপক হই-চই হয়েছিল তখন।

অবশ্য, দালি নিজেও খানিকটা বিমর্ষ হয়েছিলেন। তার মনে হয়েছিল, পোশাকটিতে কিছু একটার ঘাটতি রয়েছে: মেয়োনিজের হয়তো একটা ড্যাশের!
পোশাকে লবস্টার জুড়ে দেওয়া নিয়ে এত আলোচনা-সমালোচনা হতে পারে, সে কথা আজকের দুনিয়ায় ভাবা বেশ কঠিন। এ ধরনের প্রিন্টের পোশাক আপনি প্রায় সর্বত্রই দেখতে পাবেন। যেমন ধরুন, ডেনিশ ফ্যাশন ডিজাইনার হেনরিক ভিবস্কোভের স্প্রিং-সামার ২০২০ কালেকশনে গোলাপি ও লাল ক্রাস্টেসিয়ানের দেখা পাবেন প্রচুর; আবার ফ্যাশন কোম্পানি লুইস ভুইটনের অটাম-উইন্টার ২০২০ মেনসওয়ার শো'তে ওভারসাইজড ও তুলনামূলক বিলাসবহুল লবস্টারে সাজানো সাদা ফ্লাফি কোট পরে মডেলদের ক্যাটওয়াক করতে দেখা গেছে।

আজকের দিনে এমনতর ডিজাইনের হরদম দেখা পাওয়ার জন্য বিংশ শতকের একটি আভা-গার্দ শিল্প-আন্দোলনকে আমরা ধন্যবাদ দিতেই পারি: পরাবাস্তববাদ। স্বপ্নের অব্যক্ত শক্তির ওপর জোর দিয়ে এবং স্বতঃস্ফূর্ত, অনভ্যস্ত লেখালেখি আর শিল্পকর্মের স্বয়ংক্রিয়তা ও 'খাপছাড়া' ইমেজের সন্নিবেশের মতো টেকনিক ব্যবহারের মাধ্যমে কল্পনাপ্রসূত শিল্প সৃষ্টির প্ররোচনায় অবচেতন মনের প্রকাশ এবং কল্পরাজ্যের বিস্তার ঘটাতে পরাবাস্তববাদ কাজ করেছে। গুপ্ত কামনা ও অনুভূতি বিষয়ে সিগমুন্ড ফ্রয়েডের লেখালেখি এবং কার্ল মার্ক্স-সহ অন্যান্য মনস্তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক চিন্তাবিদের কাজ থেকে গভীরভাবে প্রেরণা নিয়েছিল এটি।

পরাবাস্তববাদ শব্দটির প্রথম ব্যবহার ঘটে ১৯১৭ সালে; তবে আন্দোলন হিসেবে এটি সামনে আসে ১৯২০-এর দশকে। ১৯৩০-এর দশকে ডিজাইনের প্রতি মনোযোগ দেন পরাবাস্তববাদের বেশ কয়েকজন শীর্ষ প্রবক্তা। তারা চমকপ্রদ উপাদান দিয়ে অসাধারণ সব শিল্পকর্ম সৃষ্টি করতে থাকেন। তাদের মধ্যে অল্প কয়েকজন নজর দেন ফ্যাশনের দিকেও। দালি ও তার সুইস সহযোদ্ধা মেরেত ওপেনহাইম- উভয়ের সঙ্গেই কাজ করেন শিয়াপারেল্লি। এর সঙ্গে যুক্ত হয় তার নিজের ক্যারিশমা। নির্বিঘ্নচিত্তে তিনি ফার ও ভেইনের সঙ্গে জুড়ে দেন গ্লাভস।

অন্যদিকে, প্রসিদ্ধ ব্যালে কোম্পানি ব্যালে রুশের জন্য উজ্জ্বল রঙের পোশাক ডিজাইন করে দেন স্প্যানিশ চিত্রশিল্পী হোয়ান মিরো। ব্রিটিশ পেইন্টার ইলিন অ্যাগার ফুরফুরে মেজাজে করতে থাকেন তার ১৯৩৬ সালের বিখ্যাত 'সিরিমনিয়াল হ্যাট ফর ইটিং বউইলাবাইস'-এর মতো আনন্দমুখর ডিজাইনগুলো। ওই ডিজাইনে তিনি একটি লবস্টারের লেজ ও একটি মাছ ধরার জাল-সহ সমুদ্রতটের বিভিন্ন 'আবর্জনা' ব্যবহার করেছিলেন।
চিত্রশিল্প ও ফ্যাশনের মধ্যে এই অব্যাহত লেনদেনের সম্পর্কের বিস্তার আরও নানাভাবে ঘটেছে। ম্যান রে ও লি মিলার-সহ বেশ কিছু ফটোগ্রাফার তাদের ফ্যাশন ফটোগ্রাফিতে একটি পরাবাস্তববাদী ভঙ্গিমা জাহির করেছেন; অন্যদিকে, লিওনোর ফিনির মতো চিত্রশিল্পীরা 'আপত্তিকর' পোশাকের বিকাশ ঘটিয়ে কুড়িয়েছেন খ্যাতি।

নিজেদের কাজে মূলধারার ফ্যাশনের সঙ্গে একটি সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন তাদের অনেকেই। ১৯৩৮ সালে এলসা শিয়াপারেল্লি একটি কংকাল-পোশাক ডিজাইন করেছিলেন। সেটির অনুপ্রেরণায় ডিজাইন হয়েছে প্রচুর। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, ব্রিটিশ ডিজাইনার আলেক্সান্ডার ম্যাককুইনের স্প্রিং-সামার ১৯৯৮ স্পাইন কর্সেটে স্বদেশি অলংকার ডিজাইনার শন লিনের সঙ্গে হাড়, মেরুদণ্ড, হৃৎপিণ্ড-সহ ত্বকের আড়ালে থাকা বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ফুটিয়ে তোলা পোশাকগুলো।
অন্যদিকে, 'স্বাভাবিক' ডিজাইনের সমাপ্তি টানার আকাঙ্ক্ষায় ওই আন্দোলন আরও অনেক কাজে ফেলেছে প্রভাব। যেমন ধরুন, ব্রিটিশ-তুর্কি ডিজাইনার হুসেইন চালায়ানের অটাম-উইন্টার ২০০০ ক্যাটওয়াকে টেবিলকে স্কার্টে এবং ফ্যাশন কোম্পানি ভিক্টর অ্যান্ড রোলফের স্প্রিং-সামার ২০১০ কালেকশনে সূক্ষ্ম পাতলা কাপড়ের বল-গাউনের মধ্যে বড় বড় ছিদ্র করে দেওয়ার নজির আমরা দেখেছি।

অতি সাম্প্রতিককালে, শিল্প আন্দোলনটির প্রতি একটি নবায়িত শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের নজির দেখাচ্ছেন ডিজাইনাররা। গত বছর বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান পরাবাস্তববাদী শিল্পীদেরকে বড় ধরনের রেফারেন্স পয়েন্ট হিসেবে গণ্য করেছেন। আইরিশ ডিজাইনার সিমোন রোচার অটাম-উইন্টার ২০১৯ শো'তে নারী-দেহের প্রতি আমেরিকান-ফরাসি শিল্পী লুই বুর্জোয়ার নির্ভীক মনোভাবের প্রতিফলন ঘটেছে। একই বছর ওই ডিজাইনার হাইজার অ্যান্ড বার্থ আর্ট গ্যালারিতে কাজ করেছেন, যার ফল সে বছর তার প্রকাশ করা একগুছ কানের দুলের ডিজাইনে ছিল বুর্জোয়ার ফ্যাব্রিক স্কাল্পচারগুলোর সরাসরি প্রভাব।
তার সমসাময়িক ডিজাইনার এডন চোই ও রোল্যান্ড মরেটও মেরেত ওপেনহাইম ও লি মিলারের শিল্পকর্মকে নিজেদের অটাম-উইন্টার ২০১৯ শোগুলোর প্রধান অনুপ্রেরণাদায়ী হিসেবে ব্যবহার করেছেন।

বিলাসদ্রব্যের কোম্পানি ডিওর'ও পরাবাস্তববাদী ইতিহাসের কাছে বারবার পাতে হাত; এর প্রধান ডিজাইনার মারিয়া গ্রাজিয়া চিউরি নিয়মিতই ওই শিল্পীদের কাজের ওপর নজর বোলান এবং সাম্প্রতিক মৌসুমগুলোতে লিওনোর ফেনি, লিওনোরা ক্যারিংটন ও ডোরা মারের মতো পরাবাস্তববাদী ফটোগ্রাফারদের প্রতি জানিয়েছেন সম্মাননা।
এই পুনরাবির্ভূত আগ্রহের কিছু অংশের সন্ধান অনেকটা সুনিশ্চিতভাবেই পরাবাস্তববাদী নারীদের কাজের প্রতি শিল্প দুনিয়ার নতুন করে দৃষ্টিপাতের মধ্যে খুঁজে পাওয়া সম্ভব; তাদের অনেককেই দেওয়া হচ্ছে রেট্রোস্পেকটিভ; আবার অনেকের কাজ সুদীর্ঘকাল অবহেলায় পড়ে থাকার পর সেগুলোর করা হচ্ছে প্রদর্শনী। করোনাভাইরাসের কারণে সবিশেষ টালমাটাল এ বছরের প্রেক্ষাপটে এইসব পরাবাস্তববাদী কাজগুলো যেন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি সময়োপযোগী হয়ে উঠেছে।
এই গ্রীষ্মে ডিওরের অটাম-উইন্টার ২০২০ কুচার কালেকশন সম্পন্ন করা হয়েছে ফটোগ্রাফার ব্রিজিত নেইদারমায়ারের তোলা বিদেহী হাত ও চোখের মতো পরাবাস্তববাদী প্রধান মোটিফগুলোর একটি ফটোগ্রাফিক ক্যাম্পেইন শট সহকারে; অন্যদিকে, ভালেন্তিনো-সহ অন্য ব্র্যান্ডগুলো গাউনের স্বপ্নতুল্য ইমেজের প্রস্তাবনা রেখেছে ব্যাপক মাত্রায়।
এই মুহূর্তে ভিক্টোরিয়া বেকহ্যাম ও প্রাডার মতো ব্র্যান্ডগুলো ফ্রি-ফ্লোটিং লিপসে ভরা শার্ট বিক্রি করছে, যা আমাদের আমেরিকান ভিজুয়াল আর্টিস্ট ম্যান রে'র মাল্টিমিডিয়া ইমেজগুলো এবং ১৯৪৯ সালে করা সালভাদর দালির রত্নখচিত লিপস ব্রোচের কথা মনে করিয়ে দেয়।
সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত স্প্রিং-সামার ২০২১ শোগুলোতে বেশ কিছু কালেকশনে পরাবাস্তববাদের উপস্থিতি দেখা গেছে: সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে দেখা গেছে শিয়াপারেল্লির হাউসের কাজে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই ফ্যাশন হাউস নিজ ঐহিত্যের প্রতি নজর ফিরিয়ে, প্রয়াত শিয়াপারেল্লির প্রধান থিম ও পোশাকগুলোকে সমকালীন দর্শক ও ক্রেতাদের কাছে ফিরিয়ে আনতে কাজ করছে।

এই মৌসুমে হাউসটির বর্তমান শিল্প পরিচালক ড্যানিয়েল রোজবেরির নিজস্ব অন্তর্দৃষ্টি বিস্তারের দেখা আমরা পাই ভৌতিক সাদা অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ঢাকা গোলাপি স্যুট, স্তন আঁকা শার্ট এবং নখ, নাক ও দাঁত আকৃতির অলংকারের মধ্যে।
বলা হয়ে থাকে, ফ্যাশন হলো সময়ের একটি প্রতিবিম্ব। এই চলমান বিস্ময়কর সংকটকালে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এ বছর কংক্রিট অথবা ফ্যান্টাস্টিক্যাল বিষয়ে ফোকাস করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অনেক ব্র্যান্ড; অবশ্য পৃথিবী যখন প্রচুরসংখ্যক সংকটময় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, এমন বাস্তবতায় শুধু প্রাসঙ্গিক নয়, বরং প্রয়োজনের বিষয়টিও বের করার চেষ্টা করছে তারা।
এ রকম পরিস্থিতিতে বাস্তবতাকে ফুটিয়ে তুলতে অনেকেই যে পরাবাস্তববাদের দ্বারস্থ হবে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আর সে কাজ শুধু ডিজাইনাররাই করছেন না; এই মুহূর্তে অনেক খুচরা বিক্রেতারাও বড় স্লিভ, সাহসী নকশা আর অস্বাভাবিক ডিটেইলসের পোশাক বিক্রি করছেন।

সালভাদর দালি একবার বলেছিলেন, 'আমি সবকিছুকে ফ্যান্টাস্টিক্যাল করে তোলার, ম্যাজিক্যাল করে তোলার, একটা স্বপ্নের মতো করে তোলার চেষ্টা করি।' এই মুহূর্তে, আমাদের সামগ্রিক মন-মানসিকতা সম্ভবত এভাবে এক কথায় প্রকাশ করা যেতে পারে: আমরা এখন যে নতুন ও অনেকটাই অনিশ্চিত ঢুকে ঢুকে পড়েছি, পলায়নবাদের সোজা রাস্তাই শুধু নয়, অনেকটা স্বপ্নের মতো নতুন রাস্তাগুলো প্রতিনিয়তই খুঁজে নেওয়াও আমাদের দরকার।
- সিএনএন থেকে অনুবাদ: রুদ্র আরিফ