জীবন পাল্টে দিয়েছে নিবিড় পদ্ধতিতে মাছ চাষ

নিবিড় পদ্ধতিতে শিং মাছ চাষে আগ্রহ বেড়েছে ময়মনসিংহ অঞ্চলের মাছ চাষীদের। কম জমিতে অধিক ঘনত্বে মাছ চাষে বেশি লাভ হওয়ায় দিন দিন বাড়ছে চাষির সংখ্যা। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের (বিএফআরআই) বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত ৬০টিরও বেশি মৎস্য চাষ প্রযুক্তি রয়েছে। এর মধ্যে নিবিড় পদ্ধতিতে মাছ চাষ পদ্ধতি চাষিদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে।
কম জমিতে অধিক ঘনত্বে মাছ চাষে বেশি লাভ হওয়ায় এ অঞ্চলে দিন দিন বাড়ছে চাষীর সংখ্যা। আগে সনাতন পদ্ধতিতে মাছ চাষ করে প্রায় প্রতি বছরের লোকসান গুণতে হতো। বর্তমানে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে নিবিড় পদ্ধতি মাছ চাষ করে সেই ক্ষতি পুষিয়ে লাভের মুখ দেখছেন তারা।
ময়মনসিংহ সদর উপজেলার দাপুনিয়া এলাকার এমনই এক মাছ চাষি এম এ রায়হান। ইচ্ছে ছিল লেখাপড়া শেষ করে চাকরি করবেন। যোগও দিয়েছিলেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। কিন্তু বছর পার করতে পারেনি সেখানে। ফিরে এসে বাবার ছোট একটি পুকুরে শুরু করেন মাছ চাষ। মনোসেক্স তেলাপিয়া মাছ দিয়ে চাষ শুরু করলেও তেমন সফল হতে পারেননি। হতাশ হয়ে যোগাযোগ করেন বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটে। অংশ নেন নিবিড় পদ্ধতিতে শিং মাছ চাষ প্রকল্পে। সেখানে ছিলেন প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এইচ এম কোহিনর। তার পরামর্শে শুরু করেন নিবিড় পদ্ধতিতে শিং মাছ চাষ প্রকল্প।
রায়হান বলেন, আমার ৩২ শতাংশের একটি পুকুরে প্রথম বছরে গুলশা আর দ্বিতীয় বছরে পাবদা মাছ চাষ করে প্রতি বছর ৪/৫ লাখ টাকা লোকসান হয়। পুঁজি খাটিয়ে বছর শেষে আসল টাকাই উঠিয়ে আনতেই পারিনি। দুই বছর লোকসানের পর চলতি বছরের জুন মাসে ৩২ শতাংশের একটি পুকুরে ৩ থেকে ৪ গ্রাম ওজনের এক লাখ ৬০ হাজার শিং মাছের চাষ শুরু করি। পোনা ক্রয় বাবদ খরচ হয়েছে দুই লাখ ৪০ হাজার টাকা। জুনের শুরু থেকে অক্টোবরের শেষ পর্যন্ত পাঁচ মাসে খাবার লাগে প্রায় ১৪ টন। যার বাজার মূল্য সাড়ে দশ লাখ টাকা। বাজারজাত করা পর্যন্ত প্রতিটি মাছের গড় ওজন ছিল ৫০ থেকে ৬০ গ্রাম।
তিনি আরও বলেন, সব মিলিয়ে আমার মোট উৎপাদন ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৪ লাখ টাকা। উৎপাদিত মাছের পরিমান প্রায় ৯ হাজার কেজি। বর্তমান বাজার দর হিসেবে প্রতি কেজি মাছের পাইকারি মূল্য গড়ে ২৮০ টাকা। সেই হিসাবে আমার উৎপাদিত মাছ বিক্রি হয়েছে ২৫ লাখ টাকারও বেশি। উৎপাদন খরচ বাদ দিলে ৩২ শতাংশের এই পুকুর থেকে ৫ মাসে আমার মোট লাভ হয়েছে ১১ লাখ টাকা।

একই এলাকার মাঝিহাটি গ্রামের চাষি আব্দুল্লাহ হেল কাফি জানান, বর্তমান বাজারে অন্যান্য মাছের তুলনায় শিং মাছের চাহিদা বেশি থাকায় এবং নিবিড় পদ্ধতিতে মাছ চাষ লাভবান হওয়ায় অনেকেই এ চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। দুই বছর দেশি মাছ চাষ করে লাখ টাকা লোকসানে পড়ি। পরের বছর পাঙ্গাস মাছ চাষ করি। সেখানেও প্রায় পাঁচ লাখ টাকা বিনোয়োগ করি। হঠাৎ করে বাজারে পাঙ্গাস মাছের দাম পড়ে যাওয়ায় আবারও এক লাখ টাকা লোকসানে পড়ি। এরপর বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মৎস্য বিজ্ঞানীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের পরামর্শে নিবিড়ি পদ্ধতিতে শিং ও পাবদা মাছ চাষ শুরু করি।
আব্দুল্লাহ হেল কাফি আরও জানান, আমার ৮০ শতাংশের পুকুরে নিবিড় পদ্ধতিতে পাবদা মাছ চাষ শুরু করি। ৬ মাস চাষের পর আমার মাছ বিক্রির উপযোগী হয়। বিক্রি উপযোগী করতে সর্বমোট খরচ হয়েছে ৬ লাখ টাকা। আর বিক্রি হয়েছে ১১ লাখ টাকার উপরে। এক সময় আমার কিছুই ছিল না। আজ আমার বাড়ি-গাড়ি সব হয়েছে।
একই এলাকার যুবক পারভেজ জানান, ‘‘আগে ছিলাম কৃষক, আর এখন মাছ চাষি। প্রতি বছর ধান চাষ করে আমাদের লোকসানে পড়তে হতো। ধানের উৎপাদন খরচের সঙ্গে বাজার দরের মিল না থাকায় অনেকটা বাধ্য হয়ে ধান চাষ ছেড়ে মাছ চাষে এসেছি।’’
ওই এলাকায় অনেক চাষি অভিযোগ করে বলেন, গ্রামটি সদর উপজেলার একেবারে শেষ প্রান্তে হওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই খারাপ। দুই কিলোমিটার কাঁচা রাস্তার কারণেই আমাদের যত দূর্ভোগ। খারাপ রাস্তার জন্য আমাদের উৎপাদন খরচ বেড়ে যায় এবং বিক্রির ক্ষেত্রেও ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হই।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এইচ এম কোহিনুর জানান, প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়া মাছ চাষ বর্তমান সময়ে একেবারেই অসম্ভব। আর যারা প্রশিক্ষণ ছাড়া মাছ চাষে আসছেন তারাই লোকসানে পড়েছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভাবিত প্রযুক্তির মধ্যে নিবিড় পদ্ধতিতে মাছ চাষে প্রায় সবাই সাফল্য পেয়েছে। আমাদের ইনস্টিটিউটের কারিগরি সহযোগিতায় চলতি বছরে ৪০ জনের বেশি চাষি এই পদ্ধতি অনুসরণ করে মাছ চাষ করেছে।