গুজব মোকাবেলায় কি পদক্ষেপ নিয়েছে পুলিশ?

‘পদ্মা সেতুর জন্য মানুষের মাথা লাগবে’ এমন গুজব থেকে কাউকে সন্দেহজনক মনে হলেই দেশজুড়ে নানা জায়গায় গণপিটুনির ঘটনা ঘটছে। এই গণপিটুনির কারণে বাড্ডার একটি স্কুলে ছেলের ভর্তির জন্য খোঁজ নিতে যাওয়া মহাখালীর বাসিন্দা জেসমিনসহ সারাদেশে অন্তত সাতজন নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন আরও অনেকে।
গুজব ছড়িয়ে গণপিটুনির এই আতঙ্কের মধ্যে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে তাই নতুন করে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে।
“নেত্রকোনায় সজিবের মাথাকাটার ঘটনাতে আপনারা গুজব বললেন। চুয়াডাঙ্গার একটি পুকুর থেকে মাদ্রাসা শিক্ষাথী আবির হোসাইনের কাটা মাথা উদ্ধারের ঘটনাকে কি আপনারা গুজব বলবেন?” মোহাম্মদ মারুফ হোসেন নামের এক ফেসবুক ব্যবহারকারী আইডি থেকে বৃহস্পতিবার এই ‘গুজবটি’ ছড়ানো হয়। ফেসবুকে এই গুজবটি পোস্ট করার আধাঘন্টার মধ্যে সেটা নজরে আসে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের সাইবার ক্রাইম বিভাগের।
পুলিশের বিশেষজ্ঞ টিম আইডিটি শনাক্ত করে তা ব্লক করার কাজ শুরু করেন। কিন্তু এই অল্প সময়ের মধ্যে মারুফের দেয়া পোস্টটি ১২০ জন শেয়ার করেছেন। আড়াই’শ ফেসবুক আইডি থেকে সেখানে কমেন্ট এসেছে। আর লাইকের সংখ্যা অসংখ্য। এভাবেই অসংখ্য আইডি, ইউটিউব চ্যানেল ও অনলাইন নিউজপোর্টাল থেকে গুজব ছড়ানো হচ্ছে । গুজব ছড়ানো এসব আইডি, চ্যানেল ও পোর্টাল বন্ধে বিশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করছে পুলিশের সাইবার ক্রাইম বিভাগ। সাইবার ক্রাইমের ‘ ওপেন সোর্স ইন্টিলিজেন্ট’ ল্যাবে ইতোমধ্যে কয়েক শ আইডি, ইউটিউব চ্যানেল ও নিউজপোর্টাল শনাক্ত করা হয়েছে। ফেসবুকের সিঙ্গাপুর ও গুগলের ভারত আঞ্চলিক অফিসের মাধ্যমে এগুলো বন্ধের চেষ্টা করছে পুলিশ।
সাইবার ক্রাইম বিভাগের ভারপ্রাপ্ত উপ-কমিশনার (ডিসি) আ ফ ম আল কিবরিয়া দ্য বিজনেস স্ট্যার্ডাডকে বলেন, “অসংখ্য ফেসবুক আইডি, ইউটিউব চ্যানেলসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। ওপেন সোর্স ইন্টিলিজেন্স এর মাধ্যমে এগুলো শনাক্ত করে ইতোমধ্যে ৬০টি ফেসবুক পেজ, ২৫ ইউটিউব চ্যানেল ও ১০ নিউজপোর্টাল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।”
তিনি বলেন, “গুজবের বিরুদ্ধে আমরা যুদ্ধ ঘোষণা করেছি।”
সাইবার ক্রাইম ইউনিটের সূত্রগুলো বলছে, ওপেন সোর্স ইন্টিলিজেন্স একটি বিশেষ প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে হ্যাশ ট্যাগ দিয়ে কল্লাকাটা, পদ্মাসেতু, ছেলেধরা লিখে সার্চ দিলেই অসংখ্য ফেববুক আইডি, পেজ, ইউটিউব চ্যানেল ও নিউজপোর্টাল পাওয়া যায়। অনলাইনে এখন এ ধরনের গুজবের হাজারো কন্টেন্ট রয়েছে।
তারা আরও বলছে, দেশের পাশাপাশি সিঙ্গাপুর, মালেয়শিয়া, দুবাই, কাতার ও সৌদি আরব থেকে পদ্মা সেতুর ইস্যুতে গুজব ছড়ানো হয়েছে। তাদের আইপি নম্বর পাওয়া গেছে। জড়িতদের আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে।
এদিকে, গুজব মোকাবেলায় সাইবার টহল দিচ্ছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। গুজব ছড়ানো হচ্ছে এমন অর্ধশতাধিক আইডি তারা শনাক্ত করেছে। এসব আইডি বন্ধের চেষ্টা চলছে।
সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলাম বলেন, “যারা গুজব ছড়িয়েছে তাদের তথ্য সংগ্রহ করছি। কাদের ইন্ধনে তারা এসব গুজব ছড়াচ্ছে, সেই সব মাস্টারমাইন্ডদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছি।”
র্যাব সূত্রে জানা গেছে, গুজব ছড়ানোর অপরাধে র্যাব দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে এখন পর্যন্ত ৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতরা জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে জানিয়েছে র্যাব।
গুজব প্রতিরোধে ‘গুজব বিরোধী সচেতন সপ্তাহ’ শুরু করেছে পুলিশ। প্রথম দিন বৃহস্পতিবার প্রতিটি মেট্রোপলিটন এলাকা, জেলা ও থানায় নানা সচেতনামূলক কার্যকম পরিচালনা করেছে পুলিশ। স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় লিফলেট বিতরণ ও আলোচনা সভার মাধ্যমে সবাইকে সচেতন করা হচ্ছে। পাশাপাশি গুজবে কান দিয়ে কেউ যাতে আইন হাতে তুলে না নেয়, সে বিষয়েও সতর্ক করা হচ্ছে।
রাাজশাহী জেলার পুলিশ সুপার শহিদুল ইসলাম বলেন, দেশকে অস্থিতিশীল করতে একটি মহল গুজব ছড়াচ্ছে। মানুষকে সচেতন করতে মাইকিং, স্কুল, কলেজে গিয়ে শিক্ষার্থীদেও সঙ্গে কথা বলে তাদের সচেতন করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, “সচেতনতামূলক কার্যক্রমের পাশাপাশি গুজব রটনাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। রাজশাহীর বাগমারায় জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা গুজবকে কেন্দ্র করে একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করছিল। পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলে গিয়ে জড়িতদের গ্রেফতার করেছে।”
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) সোহেল রানা বলেন, “গুজব বিরোধী ব্যাপক প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে সকল শ্রেণী পেশার মানুষকে সচেতন করে তুলা হচ্ছে। কিছু সুফলও পাওয়া যাচ্ছে।”
সচেতনতার পাশাপাশি জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।