উইন্টার গেমসে নরওয়ের অভাবনীয় সাফল্যের রহস্য কী?

বরাবরের মতোই, চলমান উইন্টার অলিম্পিকের পদক তালিকায় সবার উপরে নরওয়ে।
বেইজিং উইন্টার অলিম্পিক ২০২২-এ তো তারা স্বর্ণপদক জয়ের এক নতুন রেকর্ডও করে ফেলেছে। বায়াথলেট জোহান থিংনেস বো যখন চলতি আসরে তার চতুর্থ সোনাটি জিতলেন, এর মাধ্যমে ১৫টি স্বর্ণপদক নিয়ে এক আসরে সর্বোচ্চ স্বর্ণজয়ের কীর্তি গড়ে নরওয়ে।
এই বিষয়টি অনেকের কাছেই বিস্ময়কর লাগতে পারে। কেননা, দেশটির জনসংখ্যা ৫০ লাখের সামান্য বেশি। বিশ্বের জনবহুল দেশের তালিকায় শীর্ষ ১০০-র মাঝেও নেই তারা। এবারের অলিম্পিকেও নরওয়ে থেকে অংশগ্রহণকারী অ্যাথলেটের সংখ্যা মাত্র ৮৪, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ২২৪! নরওয়ে ও যুক্তরাষ্ট্রের মাঝে রয়েছে আরও ১২টি দেশ বা দল : ফ্রান্স, ফিনল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র, সুইডেন, ইটালি, জাপান, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, চীন, রাশিয়ান অলিম্পিক অলিম্পিক কমিটি, কানাডা।
অথচ সেই নরওয়েই কিনা একটি বৈশ্বিক আসরে বড় ব্যবধানে পেছনে ফেলেছে বাকি সবাইকে!

স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে মনে, শীতকালীন অলিম্পিকে নরওয়ের অতীত ও বর্তমান সাফল্যের পেছনের রহস্যটা আসলে কী?
মূলত দুটি বিষয়।
প্রথম বিষয়টি, সম্ভবত আন্দাজ করে ফেলেছেন ইতোমধ্যেই, নরওয়ের আবহাওয়া। বিশ্বব্যাংকের তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী, বার্ষিক গড় তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস নিয়ে নরওয়ে বিশ্বের সবচেয়ে শীতল পাঁচ দেশের একটি।
এ ব্যাপারটি নিঃসন্দেহে একটি বড় কারণ নরওয়ের সাফল্যের পেছনে। দুই-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া, সাধারণত যে দেশের গড় তাপমাত্রা যত কম হয়, শীতকালীন অলিম্পিকে তাদের সাফল্যের সম্ভাবনা যায় তত বেড়ে!
এমন হওয়ার কারণ, অনুকূল আবহাওয়ার ফলে শীতপ্রধান দেশগুলোয় উইন্টার গেমস পৃথিবীর বাকি অঞ্চলগুলোর চেয়ে বেশি জনপ্রিয়। তুলনা করা যেতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেই। ক্রস কান্ট্রি স্কিয়িং কিংবা বায়াথলনের মতো খেলাগুলোর জনপ্রিয়তা সেখানে একেবারে তলানিতে। ক্রিকেট-ফুটবলের ভিড়ে আমাদের দেশে অন্যান্য খেলার যে হাল, সেরকম আরকি!
অথচ নর্ডিক দেশগুলোতে এগুলোর তুমুল জনপ্রিয়তা। টেলিভিশনে নিয়মিত প্রচার হয়। ফলে এসব খেলা খেলে সহজেই পাওয়া যায় দেশজোড়া খ্যাতি, এবং জুটে যায় অনেক স্পন্সরও।

স্পন্সরশিপের সূত্র ধরেই এবার আমরা চলে আসতে পারি টাকার প্রসঙ্গে, যেটি নরওয়ের সাফল্যের দ্বিতীয় মুখ্য কারণ।
চিন্তা করে দেখুন, অলিম্পিকের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া কতটা কষ্টকর ও ব্যয়সাধ্য। স্পোর্টস গিয়ারগুলোর দাম হয়ে থাকে আকাশচুম্বী। তাই বাবা-মা যথেষ্ট ধনী না হলে, অধিকাংশ শিশুর পক্ষেই ছোট থেকে এসব খেলাধুলার সঙ্গে যুক্ত থাকা সম্ভব হয় না। তাছাড়া একটি দেশের অবকাঠামোগত অবস্থাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
এদিক থেকে নরওয়ে ভাগ্যবান। দেশটি বেশ ধনী ও সম্পদশালী। তাদের জিডিপি বিশ্বের সেরা ৩৫-এর মধ্যে রয়েছে। আর জনপ্রতি জিডিপি তো সেরা ১০-এর মধ্যেই!
তাছাড়া শুধু জিডিপিই তো নয়। জিডিপির বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা দূর করতে জাতিসংঘ গুরুত্বপূর্ণ কিছু অসাম্যের মধ্যে সমন্বয় করে প্রণয়ন করেছে মানব উন্নয়ন সূচক। সেখানে বিবেচনায় আনা হয়েছে শিক্ষা, প্রত্যাশিত গড় আয়ু ও অসাম্যের মতো বিষয়গুলো।
২০২২ সালের অলিম্পিকে একটি সোনা ও একটি ব্রোঞ্জ জয়ী বায়াথলন খেলোয়াড় ভেটলে সাস্তাদ ক্রিস্টিয়ানসেন জানান, চীনের প্রতিকূল আবহাওয়ায় টিকে থাকার জন্য তিনি ও তার সতীর্থরা কী ধরনের ব্যয়বহুল প্রযুক্তি ও কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন।
"বায়াথলন দলের জন্য এ বছর বেইজিং অলিম্পিক ছিল একটি অবিশ্বাস্য যাত্রা। আমরা খানিকটা ভয় পাচ্ছিলাম যে, হয়তো এখানকার প্রচণ্ড ঠান্ডা ও বাতাস বেশ কিছু বিস্ময় ও কাকতালীয় ফলের জন্ম দেবে। সে ধরনের কিছু যে আসলেই না হয়, তা নিশ্চিত করতে আমরা গত দুই-তিন বছর ধরে অনেক উঁচুতে, প্রচুর বাতাসের মধ্যে ট্রেনিং করেছি।
"আমাদের ওখানে সত্যিকারের বাতাস ছিল না। তাই আমাদেরকে উইন্ড মেশিন ব্যবহার করতে হয়েছে। আমরা মেশিনগুলোকে আমাদের পেছনে বসিয়েছিলাম যেন বাতাস বামদিক থেকে আসে। কারণ আমরা অতীতের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বুঝতে পেরেছিলাম, চীনে বাতাস সাধারণত বামদিক থেকে বেশি আসে। এখন খুব ভালো লাগছে দেখেছে যে আমাদের গত আড়াই বছরের কষ্টের যথাযথ মূল্যায়ন পাওয়া যাচ্ছে।"

যে দেশে জ্ঞান সহজেই সবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, এবং যে দেশের সিংহভাগ অংশেরই যেকোনো প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল পাওয়ার সুযোগ রয়েছে, সে দেশ খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রচুর পরিমাণ অ্যাথলেটের জন্ম দেবে—এমন থিওরিই দেওয়া হয়েছে সাইমন কুপার ও স্টেফান জিমানস্কির 'সকারনোমিকস' বইয়ে।
তো, জানতে চান, জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন সূচকে নরওয়ের অবস্থায় কোথায়? একদম প্রথমে।
সুতরাং এমন ধনী ও উন্নত একটি দেশ — যে দেশের আবহাওয়া আবার প্রচণ্ড ঠান্ডাও বটে — উইন্টার গেমসে আধিপত্য বিস্তার করবে, সেটিই কি স্বাভাবিক নয়!
কিছু কিছু ইভেন্টে নরওয়েজিয়ান অ্যাথলেটদের আধিপত্যের মাত্রা এতটাই ব্যাপক যে, তাদের ধারেকাছেও নেই অন্যরা। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীরা তাই খেলা শুরুর আগেই হার মেনে নিচ্ছে নরওয়েজিয়ানদের কাছে। তাদের কাছে স্বর্ণপদক সঁপে দিয়ে, অন্যরা মাঠে নামছে বাকি দুইটি পদক জয়ের লক্ষ্যে!
- সূত্র: সিএনএন, এনপিআর, ইনসাইডার।