কলকাতা ফুটবলের জাদুকরের ভালোবাসায় ডুবেছিল, আবার ভালোবাসা উবেও গিয়েছিল, কেন!

আপনাকে মহামান্য হিসেবে সম্বোধন করাটা আপনি পছন্দ করেন, মিস্টার পেলে? ৪৫ বছর আগে নিউ ইয়র্ক কসমস-এর হয়ে কলকাতায় খেলার জন্য তিন দিনের ভ্রমণে এসে এক সাংবাদিকের কাছ থেকে এ প্রশ্নটা শুনেছিলেন পেলে।
১৯৭৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর দ্য হিন্দুস্তান টাইমস লিখেছিল, এমন প্রশ্ন শুনে হাসিতে ফেটে পড়েন পেলে। তার পরদিনই মোহনবাগানের বিরুদ্ধে খেলে পেলের ক্লাব।
কলকাতার মানুষ তখন আকুল হয়ে আছেন ইডেন গার্ডেনে পেলের ভারতে প্রথম ম্যাচ দেখার জন্য। সেসময় স্টেডিয়ামটিতে ৬০,০০০-এর বেশি দর্শকের জায়গা হতো।
হিন্দুস্তান টাইমস জানায়, পেলে আর তার চটকদার মার্কিন ক্লাবটিকে কলকাতায় খেলানোর জন্য ১৭ লাখ রুপির মতো খরচ করেছিল মোহনবাগান। উত্তেজিত দর্শকদের সামলানোর জন্য মোতায়েন করা হয়েছিল প্রায় ৩৫,০০০ পুলিশ সদস্য। টিকিটের দাম ছিল পাঁচ থেকে ৬০ রুপি।
পত্রিকাগুলো পেলেকে 'রাজা পেলে' ও 'সম্রাট' হিসেবে ডাকা শুরু করল। হিন্দুস্তান টাইমস লিখল: 'অসার ও অহংকারী তো দূরে থাক, এমনকি দুর্বিনীত না হয়েও পেলে নিজেকে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি ও বিথোভেনের মতো ইতিহাসের সর্বকালের সেরাদের সঙ্গে তুলনা করতে পারেন। ফুটবলের সমঝদারদের কাছে পেলের খেলা মোনালিসা বা নাইন্থ সিম্ফোনির মতোই সুন্দর।'
কলকাতার একটি পত্রিকা প্রথম পাতায় গ্রাফিকসের মাধ্যমে পেলের খেলা ব্যাখ্যা করল। স্বাস্থ্যকর পানীয়ের বিজ্ঞাপনে পেলের নাম দেখা গেল। লটারি ক্যুপন কেনার জন্য ভক্তরা লাইন ধরলেন। এক বেরসিক জ্যোতিষী গণনা করে বললেন, পেলে অসুস্থ হয়ে যাবেন এবং পুরোটা সময় খেলতে পারবেন না।
এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানে চড়ে পেলে যখন টোকিও থেকে এলেন - কসমস ক্লাব তখন এশিয়ায় এর দুসপ্তাহের শুভেচ্ছা সফর শেষ করছিল। ক্লাবটি জাপান ও চীনেও থেমেছিল। পেলের আগমনের দিন, ২২ সেপ্টেম্বর, বিমানবন্দরে সে এক কাণ্ড। পুরো শহরে যেন মাস হিস্টিরিয়া শুরু হলো।
খবরের কাগজের বরাতে জানা গেছে, সেদিন বিমানবন্দরের বাইরে আর ভেতরে ঢল নেমেছিল উত্তেজিত দর্শকের। সবাই চেঁচাচ্ছিলেন, 'পেলে জিন্দাবাদ'। আনন্দবাজার পত্রিকার এক প্রতিবেদক লিখলেন, 'রাতের বেলা এ সময়ে বিমানবন্দরের বাইরে আমি এরকম ভিড় আগে কখনো দেখিনি।'

টারমাকের ওপর পেলেকে বহনকারী বোয়িং ৭০৭ বিমানটি দাঁড়ানো—নিরাপত্তারক্ষীদের বেষ্টনী পেরিয়ে উন্মাদ ভক্তরা ফুলের মালা নিয়ে সেখানে পৌঁছে গেল।
পেলে বের হলেন দরজা দিয়ে, আঙুলে তার বিখ্যাত ভি চিহ্ন দেখিয়ে। কিন্তু এত হল্লা দেখে আবার ভেতরে ঢুকে যান তিনি। পুলিশ ভিড় সামলানোর পর স্ত্রী রোজমেরি, ও দলের বাকি সদস্যদের নিয়ে বেরিয়ে আসেন পেলে।
সেই দলটিতে আরও ছিলেন ব্রাজিলের বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্য কার্লোস আরবার্টো টরেস, ইতালিয়ান খেলোয়াড় জিওর্জিও খিনাইয়া প্রমুখ। সবাই বিমানবন্দরের টার্মিনাল ভবনে যাওয়ার পর পেলে অপেক্ষারত সাংবাদিকদের বলেছিলেন, 'আমি ক্লান্ত, মাঠে দেখা হবে।'
তখন সাংবাদিকেরা পেলেকে নিয়ে জানতে তার জাপানি সহযাত্রীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। কিন্তু তিনিও বেশি তথ্য দিতে পারলেন না, জানালেন পেলে বিমানে ঘুমিয়েই সময় কাটিয়েছেন।
বাইরে তখনো উত্তেজনা চরমে। পেলেকে একপলক দেখতে গ্লাস ভেঙে ফেলেছিলেন কিছু দর্শক। তাদের ওপর ব্যাটন চার্জ করল পুলিশ। কয়েক হাজার দর্শক গাড়ি পার্কিং এলাকায় জড়ো হয়েছিলেন। মাঝেমধ্যে গলা উঠতো ভিড়ের মধ্যে, 'পেলে বেরোচ্ছেন, চলে যাচ্ছেন'। তখন দিকবিদিকশুন্য হয়ে চারদিকে তার গাড়ির খোঁজে ছুটে যেতেন সবাই।
পেলে ও কসমসের খেলোয়াড়দের একটি বাসে চড়িয়ে দ্রুত বের করে নিল পুলিশ। গন্তব্য কলকাতার কেন্দ্রস্থলে একটি হোটেলে। হোটেলের লবিতে গিয়েও জড়ো হলেন ভক্তরা।
বিভিন্ন পত্রিকার খবর অনুযায়ী, পরের দুইদিন পেলে আর তার স্ত্রী বেশিরভাগ সময় হোটেলকক্ষে কাটিয়েছিলেন, পাশের কক্ষে ছিলেন তার 'বিশালদেহী দেহরক্ষী'।
মার্কিন কনস্যুলেট ও মোহনবাগানের দুটো সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন পেলে। সেখানে এক সাংবাদিকদের রোজমেরি বলেন, 'আমরা এ ভালোবাসার দুর্গে আটকে আছি।'
স্থানীয় পত্রিকাগুলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, খেলার দিন আবহাওয়া খারাপ ছিল। মাঠও ছিল ভেজা আর কর্দমাক্ত। পেলে প্রতিজ্ঞা করেন তিনি পুরো ৯০ মিনিট খেলবেন।
তবে বেয়ারফুট টু বুটস: দ্য মেনি লাইভস অব ইন্ডিয়ান ফুটবল গ্রন্থে লেখব নোভি কাপাডিয়া ভিন্ন কথা লিখেছেন। 'মাঠ পিচ্ছিল থাকার কারণে পেলে খেলতে প্রায় প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তখন পুলিশ কর্মকর্তারা পেলেকে বলেন, তিনি না খেললে উপস্থিত জনতা মোহনবাগানের কর্মকর্তাদের গণপিটুনি দেবে। শেষে রাজি হন পেলে, তবে সারাম্যাচজুড়ে সতর্ক ছিলেন।'

বেশিরভাগ বিবরণ অনুযায়ী ম্যাচটা একটু অ্যান্টি-ক্লাইম্যাক্স হয়ে উঠেছিল। গোলপোস্টে কয়েকটা ব্যর্থ শট নিয়েছিলেন পেলে, কিন্তু তাকে ছাপিয়ে গিয়েছিল মোহনবাগানের খেলা। সে সপ্তাহের বৃষ্টিতে মাঠ তখন কাদাটে হয়ে গেছে।
সেদিনের ম্যাচ ২-২ গোলে ড্র হলো। পত্রিকাগুলো লেখা থেকে জানা যায়, পেলে যখন মাঠ ছাড়লেন, তখন পুরো স্টেডিয়ামে সমীহের নীরবতা। আর মোহনবাগানের খেলোয়াড়েরা মাঠ থেকে বের হওয়ার সময় চারদিক তুমুল হাততালিতে ফেটে পড়ল।
পেলের প্রতি কলকাতার বদলে যাওয়া ভালোবাসা প্রকাশ পেতে শুরু করল। একটা পত্রিকার হেডলাইন ছিল: 'এটা স্পষ্ট পেলে বুড়িয়ে গেছেন।' স্থানীয় ফুটবলবোদ্ধারাও ছেড়ে কথা কইলেন না।
আনন্দবাজার পত্রিকায় বিখ্যাত ক্রীড়া সাংবাদিক মতি নন্দী লিখেছিলেন, 'কলকাতায় পেলেকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল যেন আমাদের তরুণ ফুটবলারেরা তার কাছ থেকে খেলাটি নিয়ে নতুন কিছু শিখতে পারে। নিদেনপক্ষে আয়োজকেরা সেটাই আমাদের বলেছিলেন। কিন্তু পেলে থেকে তারা আদতে যা শিখল তা হচ্ছে মাঠে কিছু না করে ৯০ মিনিট কীভাবে কাটানো যায়।'
পেলেকে নিয়ে উন্মাদনা দ্রুতই উবে গেল। তার হোটেলের বাইরে ভিড় পাতলা হতে শুরু করল। তখনকার ক্ষমতাশীল কম্যুনিস্ট সরকারের এক নেতাকে তেড়ে গিয়ে এক হতাশ ভক্ত বললেন, 'ভুয়া পেলেকে কলকাতায় নিয়ে এসেছে।' কম্যুনিস্ট এক এমপি মন্ত্রীকে বললেন, 'আপনাকে টিকিটের পয়সা ফেরত দিতে হবে।'
রোববার রাতে নিউ ইয়র্কের উদ্দেশ্যে রওনা দেন পেলে। বিমানবন্দরে তখন আর ভিড় নেই। 'মহারাজার বিষন্ন বিদায়,' একটি পত্রিকা হেডলাইনে লিখল। প্রবীণ সাংবাদিক সন্তোষ কুমার ঘোষ বললেন, পেলে আর কসমসের ওপর খরচ করা অর্থের সামান্য অংশ দিয়েও 'শহরের অনেক রাস্তার সৌন্দর্যবর্ধন করা যেত'।
সে সময়ের প্রখ্যাত ক্রীড়া বিশ্লেষক অরিজিৎ সেন কফিনের শেষ পেরেকটি ঠুকলেন। 'কসমসের খেলোয়াড়েরা তাদের সক্ষমতার ২৫ শতাংশের বেশি কাজে লাগায়নি। খেলাটা শেষ করে দিয়েই তারা খুশি ছিল,' তিনি লেখেন।
'উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। দরিদ্র ভারতীয়দের কষ্টার্জিত পয়সায় তাদের বাজি ফুলেফেঁপে উঠেছে।'
সূত্র: বিবিসি
ভাষান্তর: সুজন সেন গুপ্ত