১৯৭৪: দুই জার্মান দল যখন মুখোমুখি, তার অনুভূতি কেমন হয়!

[১৯২৭ সালে পোল্যান্ডের ডানজিগ শহরে (বর্তমানে গদানস্ক) জন্মগ্রহণ করেন গুন্টার গ্রাস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী জার্মানির নৈতিক দ্বন্দ্বগুলো নিয়ে লেখালেখি ও ব্যক্তিগত জীবনে চর্চার জন্য গ্রাস বিখ্যাত। ১৯৫৯ সালে 'দ্য টিন ড্রাম' লিখে জনপ্রিয়তা পান তিনি। দ্বিধাবিভক্ত পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানির 'নৈতিক কম্পাস' হিসেব অভিহিত করা হতো গুন্টার গ্রাসকে।
সাম্রাজ্যবাদের কট্টর বিরোধী ও প্রগতিশীল মননের গুন্টার গ্রাস জার্মানির সোশ্যাল ড্যামোক্র্যাটস দলের সদস্য ছিলেন। পশ্চিম জার্মানির চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্টের জন্য বক্তৃতা লেখার কাজও করেছিলেন তিনি। পুঁজিবাদ ও জাতীয়তাবাদ বিরোধী সমাবেশে নিয়মিত দেখা যেত তাকে। পশ্চিমা দেশগুলো বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করতেন প্রায়ই। বার্লিন দেওয়ালের পতন ঘটার পর তা নিয়েও সমালোচনাই করেছিলেন গুন্টার গ্রাস। তার মনে হয়েছিল, দেশ একত্রিত হয়ে গেলে তা আবার ক্ষমতাশালীদের স্বেচ্ছাচারিতায় ডুবে যাবে।
২০০৬ সালে গ্রাস প্রকাশ করেছিলেন তার জীবনের একটি কালো অধ্যায়ের কথা। আত্মজীবনী 'পিলিং দ্য অনিয়ন' প্রকাশের কিছুদিন আগে গ্রাস জানান, কৈশোরে হিটলারের কুখ্যাত ভাফেন-এসএস বাহিনীতে ট্যাংক গানার ছিলেন তিনি। এ খবরে চমকে গিয়েছিল পুরো ইউরোপ। অথচ তার ত্রয়ী উপন্যাস 'দ্য টিন ড্রাম', 'ক্যাট অ্যান্ড মাউস' (১৯৬১), ও 'ডগ ইয়ার্স' (১৯৬৩)-এ তিনি জাদুবাস্তবতার ছোঁয়ায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন নাৎসি জার্মানির আসল রূপ। নাৎসিদের শাসনামালে যাপিত জীবনের ট্রমা নিয়ে কাজ করার জন্য ১৯৯৯ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার পান গুন্টার গ্রাস। ২০১৫ সালের ১৩ এপ্রিল মারা যান শক্তিশালী এ সাহিত্যিক।
১৯৭৪ সালের ২২ জুন হামবুর্গে ফুটবল বিশ্বকাপে মুখোমুখি হয়েছিল পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানি। সেবার জার্মানরা যেন নিজেদের একক 'আমি'কে দুটি সত্তা হয়ে যেতে দেখলেন। সেই ম্যাচে ইয়ুর্গেন স্পারভাসারের গোলে ১-০-তে জিতেছিল জার্মান ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক তথা পূর্ব জার্মানি।
১৯৯৯ সালে সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী জার্মান সাহিত্যিক গুন্টার গ্রাস ফুটবলকে নিমিত্ত হিসেবে ধরে গিয়মের অস্তিত্বগত অবস্থানকে তুলে ধরেছেন তার '১৯৭৪' শীর্ষক এ লেখায়।
গিয়ম ছিলেন পশ্চিম জার্মানির চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্টের ব্যক্তিগত সহকারী। পূর্ব জার্মানির স্পাই হিসেবে ১৯৭৪ সালে ধরা পড়েন তিনি। ১৯৯৯ সালে গুন্টার গ্রাস 'মাই সেঞ্চুরি' লিখেছিলেন। ১৯০০ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত ১০০ বছরের ১০০টি গল্প নিয়ে গড়ে ওঠা গ্রাসের এ উপন্যাসের অংশ '১৯৭৪' শীর্ষক পরিচ্ছেদটি।]

টেলিভিশনের পর্দায় কেউ নিজেকে দেখলে কেমন অনুভব করে? আজীবন অন্যের কথা নির্দ্বিধায় মেনে চলা মানুষেরা নিজেদের 'আমি'কে দ্বিগুণ হয়ে যেতে দেখলে তাতে আক্ষেপের কিছু থাকার কথা নয়। বরং নিছক বিস্ময়ই আশা করা যায়। একজন ব্যক্তি কেবল কঠোর প্রশিক্ষণ থেকেই শেখেন না, বরং জীবনও তাকে শেখায় কীভাবে নিজের আর নিজের দ্বৈত হয়ে যাওয়া সত্তাকে মোকাবিলা করতে হয়।
রাইনবাখের মতো সংশোধনাগারে বছর চারেক কাটিয়ে আর অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে কয়েদখানার বড়কর্তাদের বুঝিয়ে-শুনিয়ে নিজের একটা টেলিভিশন রিসিভারের ব্যবস্থা করতে পারা আমি এখন স্পষ্ট বুঝতে পারি, দুটো আলাদা সত্তার মধ্যে বাস করার প্রভাবগুলো কী কী। অথচ ১৯৭৪ সালে আমি তখনো কলোন-ওসেনড্রফ কারাগারে বিচারের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। বিশ্বকাপ ফুটবল উপলক্ষে যখন আমার কারাকক্ষে একটা টেলিভিশন রিসিভার লাগানোর অনুমতি পাওয়া গেল, তখন ওই টিভির পর্দার অনেক দৃশ্যাবলি আমার অন্তরের সত্তাকে নানাভাবে উসকে দিয়েছিল।
পোলিশরা যখন বৃষ্টির বাধা উপেক্ষা করেও দুর্দান্ত খেলেছিল, অস্ট্রেলিয়া যে ম্যাচে হেরে গিয়েছিল, অথবা যে ম্যাচটিতে চিলির খেলা ড্র হয়েছিল—তখনো আমার মধ্যে অনুভূতির কোনো উদ্বেল ঘটেনি। যেটা ঘটার তা হলো, যখন জার্মানি জার্মানির বিরুদ্ধে খেলতে নেমেছিল। কোন দলের পক্ষে কোন সত্তাটা ছিল? আমি বা আমি কোন জার্মানিকে সমর্থন করেছিলাম? কাদের জন্য উল্লাস করার কথা ছিল আমার? স্পারভাসার যখন তার গোলটা করল, তখন আমার মনের ভেতর দিয়ে কোন ঝড় বয়ে গেছিল? কোন শক্তি আমাকে পেয়ে বসেছিল?
আমাদের পক্ষে? আমাদের বিরুদ্ধে? যেহেতু প্রতি সকালে আমাকে বাড গোডেসবুর্গে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যাওয়া হতো, তাই ইনভেস্টিগেশন ব্যুরো জানত দৈনিক এ রুটিনটি আমার কাছে নিতান্ত অপরিচিত কিছু ছিল না। অবশ্য ওই জিজ্ঞাসাবাদের ব্যাপারগুলো জার্মান রাষ্ট্রব্যবস্থার দ্বৈততার মতোই একটি আচরণগত ছন্দ বই আর কিছুই ছিল না। মানে আমি একটা দ্বৈত দায়বদ্ধতা পূর্ণ করছিলাম। যতক্ষণ চ্যান্সেলরের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সহযোগী হিসেবে আমার দায়িত্ব ছিল, তার দ্বিমুখী মননের আলাপগুলোর অংশ ছিলাম—ততক্ষণ আমি চাপ সামলাতে পারতাম। চাপ তখন আমার কাছে দ্বন্দ্ব হিসেবে মনে হতো না; বিশেষত চ্যান্সেলর যেহেতু আমার কাজকর্মে পুরোপুরি সন্তুষ্ট ছিলেন এবং বার্লিন অফিসের বড়কর্তারাও আমার প্রশংসা করছিলেন। নিজেকে 'চ্যান্সেলর অব পিস' হিসেবে দেখা চ্যান্সেলর আর 'স্পাই অব পিস' মিশন নিয়ে নামা আমির মধ্যে একধরনের সমন্বয় তৈরি ও রক্ষা করাটাই ছিল মূলকথা। আমার দুজনেই আমাদের কাজটাকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছিলাম।
কিন্তু হামবুর্গের ভকসপার্ক স্টেডিয়ামে ৬০ হাজার দর্শকের সামনে রেফারি যখন জার্মান ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক ও ফেডারেল রিপাবলিক অব জার্মানির খেলার বাঁশি বাজালেন, আমার ভেতরটা আগাগোড়া ভেঙেচুরে গেল। খেলার প্রথমার্ধে কোনো দলই গোল করতে পারেনি। কিন্তু ৪০ মিনিটের মাথায় যখন ক্ষিপ্রগতির মুলার ফেডারেল রিপাবলিককে ১-০-তে প্রায় এগিয়ে দিচ্ছিল, আমি তখন 'গোল! গোল! গো-ও-ও-ল!' বলে প্রায় চেঁচিয়ে উঠছিলাম। পশ্চিমের বিচ্ছিন্ন করা দলটির খেলায় এগিয়ে যাওয়াটা আমি যেমন উদ্যাপন করতাম, তেমনিভাবে যখন ওভারাথকে পাশ কাটিয়ে লক প্রায় ফেডারেল রিপাবলিকের জালে বল প্রবেশ করাচ্ছিল, তখনো আমি তার বাঁধভাঙা উদ্যাপনের জন্য প্রস্তুত ছিলাম।

খেলা চলল। কখনো এর দিকে, কখনো ওর দিকে বল গড়াল। উরুগুয়ের রেফারির সিদ্ধান্ত, উদ্দেশ্যমূলক ধারাভাষ্য এসব নিয়েও কখনো আমার ভেতরের একজন, আবার কখনো অপরজন—দুজনেই বেজার হলো। আমার মনে হলো, আমার ভেতরে আর কোনো শৃঙ্খলা অবশিষ্ট নেই, ভেতর থেকেই আমি দ্বিধাবিভক্ত। তারপরও সেদিন সকালে প্রধান ডিটেকটিভ ফেডর যখন আমাকে পরীক্ষা করছিলেন, আমি নিত্যকার পরীক্ষাগুলো উতরে যেতে সক্ষম হলাম। সেদিন আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল, সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির উগ্রপন্থী হেসেন-সুড শাখার সঙ্গে আমার কোনো যোগসাজশ আছে কি না। হেসেন-সুডের সদস্যরা আমাকে পরিশ্রমী অথচ রক্ষণশীল কমরেড হিসেবেই দেখেছিল সব সময়। কারা কর্তৃপক্ষ আমাকে পার্টির সবচেয়ে বাস্তববাদী ও ডানপন্থী দলের অংশ ভাবছে দেখতেই আমার ভালো লাগছিল।
কিন্তু এরপর আমার ছবি তোলার ডার্করুমের যন্ত্রপাতি সহযোগে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা শুরু হলো। সেগুলো সব তারা আগেই জব্দ করেছিল। এ রকম পরিস্থিতিতে যা করা উচিত, তা হলো অপর পক্ষ যেটা দাবি করবে, সেটাকেই বোকা-বোকা হিসেবে উড়িয়ে দেওয়া। আমার এক সত্তা দাবি করল যে আমি একজন পেশাদার ফটোগ্রাফার। ফটোগ্রাফি যে শখ, তা দেখানোর জন্য ছুটির দিনে তোলা ছবিগুলোও বের করে দেখাল। কিন্তু তারপর জিজ্ঞাসাবাদকারী একটা সুপার-৮ ক্যামেরা ও খুব দ্রুতগতির দুই রোল ফিল্ম বের করে দাবি করল, ওগুলো 'আন্ডারকাভার অপারেশনের জন্য দারুণভাবে উপযুক্ত'। আমি সেগুলোকে 'সার্কমস্ট্যানসিয়াল এভিডেন্স' হিসেবে খারিজ করে দিলাম। আমি নিশ্চিত ছিলাম আমার কোনো কথাই পরস্পরবিরোধী হয়ে যায়নি। তাই কখন নিজের কক্ষে ফিরে গিয়ে খেলা দেখতে পারব কেবল সেটাই ভাবছিলাম।
এখানে অথবা ওখানে কেউউ টের পায়নি আমি ফুটবলের ভক্ত ছিলাম। আমার নিজেরও কোনো ধারণা ছিল না যে ইয়ুর্গেন স্পারভাসার আমাদের একান্ত নিজস্ব দল মাগদাবুর্গের হয়ে দীর্ঘ কয়েক বছর খেলেছিল। এখন আমার চোখ তার ওপরেই আটকে আছে। হামান তাকে বলটা পাস করে দিল। মাথা দিয়ে বলকে সামলে নিয়ে পায়ের ওপর ফেলল স্পারভাসার। এরপর বল নিয়ে ফোগট ও হটগিসকে পাশ কাটিয়ে শেষ বাধা মায়ারকে পরাজিত করে ঝড়ের বেগে জালের মধ্যে সঁপে দিল বলটাকে।

১-০ গোল নিয়ে এগিয়ে গেল জার্মানি! কিন্তু কোন জার্মানি? আমার নাকি আমার? হ্যাঁ, হয়তো কারাকক্ষের ভেতর আমি 'গোল! গোল! গো-ও-ও-ল!' বলে চেঁচিয়ে উঠেছিলাম, কিন্তু একই সময়ে অন্য জার্মানির পিছিয়ে পড়াতেও বেদনাবিধুর হয়েছিলাম। এরপর দেখলাম বেকেনবাওয়ার পাল্টা আক্রমণের জন্য দলকে প্রস্তুত করাচ্ছে। পশ্চিম জার্মানি একাদশের হয়ে হর্ষধ্বনি করলাম এবার।
আমার চ্যান্সেলরকে (যার পতনে আমার কোনো হাত ছিল না। বরং তার জন্য আমি নোলকে দায়ি করব হয়তো এবং সবচেয়ে বেশি ভেনার ও গ্রেনশারকে) আমি একটা পোস্টকার্ড পাঠালাম। ছুটির দিনে ও জন্মদিনেও কার্ড পাঠাতাম। ১৮ ডিসেম্বরের জন্মদিনের কার্ডগুলোতে আমি আফসোস করতাম জার্মানির হারার ঘটনা নিয়ে। তিনি কখনো উত্তর দেননি। তবে নিশ্চিত করেই বলা যায়, স্পারভাসারের গোল নিয়ে তারও মিশ্র অনুভূতি হয়েছিল।