প্রহসন বলি বা কি স্যাটায়ারের খোঁজে

সত্যিই কি প্রহসন ভিন্ন কিছু করতে পারে? সবচেয়ে কার্যকর অবস্থায় প্রহসন শ্রোতাদের শুধু হাসায় না, বরং এই প্রক্রিয়ায় একটা কিছুও শেখায়ও। ভ্লাদিমির নবোকভ যেমন বলেছেন, 'প্রহসন হচ্ছে শিক্ষা, প্যারোডি হলো খেলা।' আজকের দিনে আমাদের সামনে আমাদের নিজস্ব কাজ এবং বিশ্বাস নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করবে এমন নাছোড় প্রহসনের চেয়ে বরং রাজনীতি নিয়ে কমেডিই চোখে পড়ে।
ক্ষমতাসীনদের নিয়ে রসিকতা করার এক ধরনের নিজস্ব গুরুত্ব আছে। এটা আজকে নয় বহুদিন ধরেই চলে আসছে। এটা আমাদের কথা বলার অধিকারেরও নিশ্চয়তাকে তুলে ধরে। আমরা আমাদের নেতৃবৃন্দকে নিয়ে রসিকতা করার সময় ওদের ভয় না করার বিষয়টিই দেখিয়ে দিই। এতে তারা সতর্ক থাকেন। যদিও এখন পরিস্থিতি এরকম নেই। জর্জ অরওয়েলের এ প্রসঙ্গে খুব জোরদার একটা কথা আছে: 'ফানি, বাট নট ভালগার' (১৯৪৫) এ তিনি লিখেছেন, 'প্রতিটি কৌতুকই ক্ষুদে বিপ্লব।'

একটা সময় এখানেও সেই স্বাধীনতা ছিল, সর্বশেষ স্বৈরশাসকের সময়ে ক্ষুরধার সব স্যাটায়ার, কার্টুন, রঙ্গব্যঙ্গ আমরা দেখেছি। কিন্তু তার সবই এখন তিরোহিত। শিশির ভট্টাচর্যের কার্টুন আমরা দেখি না যুগ পুরো হয়ে গেল বোধকরি। অথচ পত্রিকার পাতায়, আমাদের পর্দায় প্রচুর রাজনৈতিক রসিকতার অস্তিত্ব থাকা উচিত ছিল, তাহলে সেই বাস্তবতাকে আমরা উদযাপন করতে পারতাম। সভ্য দুনিয়ার বেশির ভাগ দেশেই এমনি প্রকাশ্য ঔদ্ধত্য অচিন্তনীয় নয়। আমাদের জন্য যতটা।
অথচ প্রহসন দারুণ উপভোগ্য, আমরা সিরিয়াস গুরুগম্ভীর লেখার চেয়ে প্রহসন থেকে অনেক বেশি কিছু আশা করি, উপভোগ করি। প্রহসনের দৃষ্টিভঙ্গি বা এমনকি ঘটনাপ্রবাহ পাল্টে দেওয়ার ক্ষমতায় বিশ্বাস করি বলেই আমরা এজন্যে লড়াই করি। অতীতকাল থেকেই প্রহসনকে বেশ কিছু উল্লেখযোগ সাফ্যল্যের কৃতিত্ব দিয়ে আসা হয়েছে। স্বৈরশাসনামলের কথা বললেই হলো। দৃষ্টি আরও প্রসারিত করলে দেখা যায়, ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং অসহিষ্ণুতার প্রতি ভল্টেয়ারের পরিহাস আলোকনকে রূপ দিতে সাহায্য করেছে। মঞ্চ নাটক বিয়ন্ড দ্য ফ্রিঞ্জ ১৯৫০-র দশকে ব্রিটেনকে তুলে ধরা কর্তৃপক্ষের প্রতি শর্তহীন বিপুল সমীহকে ফাঁপা প্রমাণ করেছে। বর্ণবাদ এবং মিশরীয় প্রেসিডেন্ট মুরসির পতনে পিয়েটার-ডির্ক ইউইস এবং বাসসেম ইউসেফের মতো প্রহসন রচয়িতারা যার যার ভূমিকা রেখেছেন।

তবে এদেশে, এবং অন্যত্রও শক্তিমানকে হেয় করাকে এখন আর বৈপ্লবিক কিছু নয়, বরং গতানুগতিকই মনে হয়। আমাদের রাজনীতিকরা সবার আগে নিজেদের সম্মানিত মনে করেন, তারা কোনো রকম প্রহসন, ব্যঙ্গচরিত্র হতে যারপরনাই অপছন্দ করেন। দেশে এখন তাই রাজনীতিবিদদের নিয়ে কদাচিৎ কোনো কার্টুন প্রকাশিত হয়। প্রশ্ন দাঁড়ায়, তাহলে রাজনীতিকদের প্রতি আমাদের সমীহ সত্যিই আরও নিম্নগামী হয়েছে? না কি! উত্তর আমাদের সবারই জানা।
স্বাধীনতার আগে পরে, অতীতের ফলপ্রসু নানা প্রহসনের কথা মনে পড়তে পারে, মনে পড়তে পারে স্মৃতিতে এখনও তরতাজা হয়ে থাকা স্বৈরাচার বিরোধী বিখ্যাত সব ব্যঙ্গচিত্র, যা নব্বইয়ের স্বৈরশাসকের পতনকে আমাদের জন্য বেশ উপাদেয় করে তুলেছিল, ফলে কামরুল হাসানের মতো কিছু গুণী চিত্রকরের কথা চকিতে মনেও আসতে পারে, এবং গভীর বিস্ময়ের সঙ্গে মনে এ প্রশ্নও জাগতে পারে সেই কঠোর স্বৈরশাসকের সময়েও প্রহসন, ব্যঙ্গচিত্রের মতো কিছু লেখা হয়েছে, আঁকা হয়েছে, তখন প্রায় অবাধেই রাজনীতিকদের নিয়ে রঙতামাশা করা গেছে, তাতে রাজনীতিবিদরা খুব যে গোস্বা হয়েছেন তাও না। তাহলে এখন কি হলো! প্রহসন, ব্যঙ্গচিত্র সব কিছু আমরা ভুলে গেছি!

মার্কিন পরিচালক স্ট্যানলি কুব্রিকের একটা চলচ্চিত্রের কথা খুব মনে পড়ছে: 'ডক্টর স্ট্রেঞ্জলাভ'-এ ছবিতে মার্কিন প্রশাসনের উপর আস্থা রাখায় জনগণের উদ্দেশ্যেও কঠোর রসিকতা করা হয়েছে।
এখনও নেটফ্লিক্স স্ট্যান্ডআপ শো 'হিউম্যানিটি'তে ট্রাম্প বা ব্রেক্সিটের পক্ষে ভোটদাতাদের নিয়ে প্রচুর রসিকতা করা হয়, হচ্ছে, উদার সৎ মানুষদের নিয়েও কম তামাশা হয় না! কিন্তু তাই বলে কেউ হারে-রে-রে বলে তেড়ে আসেন না।
প্রহসন তো শুধু অন্যের সমালোচনা না। জীবনের সকল স্তরের লোকদের প্রতি সমান আচরণ করার মুহূর্তে কোনো একটা পর্যায়ে আমরা নিজেদেরও প্রহসনের নিশানা হতে দেখি। প্রহসনের চরিত্রটিও যে আমি নিজেই।

সুইডিশ পরিচালক রুবেন অস্টলান্ড খোদ আর্টহাউস ফিল্মের দর্শকদের প্রহসনের পাত্রে পরিণত করা আর্টহাউস চলচিত্র দ্য স্কয়ারের কথা বলি একটু। ছবিটিকে কানে পাম দ'র পুরস্কারে ভূষিত করার সময় সম্ভবত জুরিদের কারও কারও মধ্যে ছবিটির বিভিন্ন চরিত্রের উঁচু হাবভাব এবং নীচতা, কিংবা কাপুরুষোচিত প্রবৃত্তির মাঝে তারা নিজেদেরও দেখেছেন।
পরিচালক অস্টলান্ড যেমন বলেছেন, 'আমি অন্য কারও তুলনায় ক্রিশ্চিয়ানকে [মূল চরিত্র] বেশি কপট হিসাবে দেখিনি। ওকে আমি আমার নিজের মতো দেখেছি, কারণ প্রায়শ আমরা নিজেদের মধ্যে ভালো দিকে স্থাপন করি। সবসময়, সব সমেই, সব সময়ই এটা করি আমরা। এ ছবি দিয়ে আমি একটি সামাজিক পরীক্ষা চালাতে চেয়েছি যেখানে ব্যর্থতার সময় নিজেদের শনাক্ত করতে পারব।'

আবার অরওয়েলের কথায় ফিরে আসি, তিনি: সবসময় দৃশ্যত 'উপশহরের গল্ফ কোর্সের লাউঞ্জে আধঘণ্টা সময় কাটানো কোনও পয়সাঅলা স্টকব্রোকারকে' লক্ষ্য করে রচিত তার আমলের প্রহসনকে বেশি শোভন এবং উদার ভেবেছিলেন। আর তখন থেকেই বহু প্রহসন রচয়িতা তার পরামর্শ মেনে ক্ষমতাবানদের আক্রমণের উদ্দেশ্যে পেন্সিল চোখা করে আসছেন। বাইরের দুনিয়ায় তারা ঠিকই এটা চালিয়ে যাবেন, যাচ্ছেন। কিন্তু আমাদের পেন্সিল ভোতা হয়ে গেছে। অথচ আজ আমরা নিজেদের চেয়ে বরং অন্যদের নিয়ে হাসতেই বেশি নিপুণ হয়ে উঠেছি, নিজেদের বুদ্বুদ ভেঙে নিজেদের ব্যর্থতা নিয়ে তাই ভাবতে বাধ্য করার মতো আরও বেশি প্রহসন এখন বড় দরকার। নয়তো আমরা ক্রমশ একেকজন গোমড়ামুখো হাস্যরসিকতাহীন জড়ব্যক্তিতে পরিণত হচ্ছি।

[কৃতজ্ঞতা: সাইমন ওয়েলস, টাইম লিটারেরি সাপ্লিমেন্টের লেখক ও পরামর্শক]