পোস্টকার্ড পূর্ববঙ্গ

আদি যুগ
জার্মান ডাক বিভাগের প্রবর্তক হেইনরিখ ফন স্টেফান ১৮৬৫ সালে প্রস্তাব দিলেন খামের বদলে খোলা চিঠির, তাঁর যুক্তি - খোলা চিঠি খরচ কমাবে। কিন্তু গোপনীয়তা তো রক্ষা হবে না! কাজেই প্রস্তাবটি প্রথম খুব একটা সাড়া পেল না। কিন্তু অস্ট্রিয়ার ইমানুয়েল হারমান ১৮৬৯ সালে যখন খানিকটা পরিবর্তিত আকারে এ প্রস্তাব করলেন তখন তা লুফে নিল অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্য। দাপ্তরিকভাবে পোস্টকার্ডের সূচনা করল অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ানরা- প্রথম দিককার ছবিবিহীন এ কার্ডের নাম হল করেস্পন্ডেন্স কার্ড৷ বাজারে আসবার মাত্র তিন মাসের মধ্যে পোস্ট করা হল তিন মিলিয়নের বেশি কার্ড। বছর ঘুরতেই ১৮৭০ সালে বিলেতে চালু হল করেস্পন্ডেন্স কার্ড। অবশ্য, করেস্পন্ডেন্স কার্ড চালুর বেশ আগে থেকেই স্যার হেনরি কোল নামে এক সরকারি অফিসার বিলেতে চালু করেছিলেন ক্রিসমাস কার্ড।
শুধুমাত্র বড়দিনের ছুটিতেই আদানপ্রদান চলত সেই ছবিসহ ক্রিসমাস কার্ডের। বলা বাহুল্য, কোল সাহেবের চেষ্টাতেই ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে বিলেতে প্রথম চালু হয় 'পেনি পোস্ট' যে কারণে নির্ধারিত এক পেনির একটি ডাকটিকিট লাগিয়ে সাধারণ মানুষ বিলেতের ভেতর যেকোনো দূরত্বে চিঠি পাঠাতে পারত। প্রথম ছাপানো ক্রিস্টমাস কার্ডের দাম ধরা হয়েছিল মাত্র ১ শিলিং আর ছাপানো হয়েছিল প্রায় দুই হাজার কার্ড। ক্রিস্টমাস কার্ডের সেই চল সাগর মহাসাগর পেরিয়ে পৌঁছেছিল খোদ ভারতেও। তাই, ১৮৬০-এর দশক থেকে ভারতে প্রবাসী ইংরেজদের মধ্যে সীমিত আকারে এর চর্চা দেখা যায়।

ব্রিটিশ ভারতে নিয়মিত যোগাযোগের লক্ষ্যে প্রথম পোস্টকার্ড চালু হয় ১৮৭৯ সালে। হলুদাভ এই কার্ডগুলোর একপাশে সংক্ষিপ্ত চিঠি লিখে অপরপাশে প্রাপকের ঠিকানা লিখতে হত। ১২২x৮৫ মিমি আকারের এই কার্ড মাত্র কোয়ার্টার আনায় ভারতবর্ষের যেকোনো প্রান্তে পৌঁছে যেত। বিশাল জনসংখ্যার কারণে জনপ্রিয়তা পেতে দেরি হয় না পোস্টকার্ডের। ১৮৮৩ সালের এক হিসাব একালে অবিশ্বাস্য ঠেকতে পারে- সেসময়ে এক বছরে কার্ড বিক্রির সংখ্যা ২৬ মিলিয়ন ছাড়িয়ে গিয়েছিল। প্রথম দিকের এই কার্ডে ছবির ব্যবহার ছিল না।
তবে কার্ডের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির সাথে এতে নানা পণ্যের বিজ্ঞাপন যুক্ত হতে থাকে; আর তখনই শুরু হয় একরঙা ছবির ব্যবহার। সে সময়কার বিখ্যাত তামাক আর মদের কোম্পানিগুলো তাদের পণ্যের বিজ্ঞাপন নিয়ে পোস্টকার্ড বের করে। এসময়ে বাজারে যোগ হয় ঝকঝকে ছাপায় চার রঙা পোস্টকার্ড। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই কার্ডগুলি ছাপা হত জার্মানি কিংবা অস্ট্রিয়ার কোনো ছাপাখানায়। ভারতে তোলা ছবি প্রথম পাঠানো হত ইউরোপের ছাপাখানায়, লিথোগ্রাফে খোদাই করা হত সেই ছবি, এরপর রঙ লাগিয়ে ছাপা হত ঝকঝকে সব পোস্টকার্ড।

হাজার মাইল পেরিয়ে সেই ছাপানো কার্ড বিক্রির জন্য ফিরে আসতো ভারতে। পোস্টকার্ড সংগ্রাহক-গবেষক ওমর খান এবং রতনেশ মাথুর উভয়ের গবেষণায় দেখা যায় ভারতের ছবিযুক্ত পোস্টকার্ড প্রথম বাজারে আসে ১৮৯৬ সালে। এই কার্ডগুলো সিরিজ আকারে বেরিয়েছিল জার্মান একটি সংস্থা থেকে; সিরিজের নাম 'গ্রিটিংস ফ্রম ইন্ডিয়া'। এই সিরিজে পোস্টকার্ডের মূল বিষয় ছিল - তাজমহল, কুতুব মিনার ইত্যাদি স্থাপনা আর সেই সাথে শিকারের ছবি।
কলকাতার ছবি পোস্টকার্ডে প্রথম দেখা যায় ১৮৯৭-তে, ডব্লিউ রসলার নামে এক কোম্পানি এই উদ্যোগ নেয়। 'থ্যাকার্স ইন্ডিয়ান ডিরেক্টরি'তে ১৯০০-১৯১৪ পর্যন্ত রসলারের নাম পাওয়া যায়। রসলারের কার্ডগুলিতে ছবির পাশে কিছু স্থান চিঠি লেখার জন্য খালি রাখা হত, তবে পেছনের ভাগ পুরোটাই বরাদ্দ থাকত ঠিকানা লেখার জন্য। ক্যামেরা প্রযুক্তির উন্নতি এবং পোস্টকার্ড ব্যবসায় লাভের হাতছানি- এই দুই কারণে বহু ফটোগ্রাফার নিজেদের তোলা স্থাপত্য আর নগর জীবনের নানা ছবি পোস্টকার্ড আকারে ছাপাতে থাকেন। লাভজনক হওয়ায় প্রতিষ্ঠিত ফটোস্টুডিও যেমন- বোর্ন এন্ড শেফার্ড, জন্সটন এন্ড হফম্যান, ক্যাপ এন্ড কো নিজেদের তোলা ছবি পোস্টকার্ড আকারে ছাপাতে শুরু করে।

লন্ডনের 'রাফায়েল টাক অ্যান্ড সন্স' কিংবা 'থ্যাকার স্পিঙ্ক অ্যান্ড কোম্পানি'র তৈরি কলকাতা তথা ঔপনিবেশিক ভারতের ছবিওয়ালা পোস্টকার্ডও দারুণ জনপ্রিয় হয়। রাজভবন, এস্প্লেনেড, চৌরঙ্গী, ডালহৌসি স্কোয়্যার, গ্র্যান্ড হোটেল, গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল, থেকে কলকাতার জনজীবন, বিচিত্র পেশা, বাবু কালচার- কী নেই সেই সব পোস্টকার্ডে। প্রথমদিকে সাদাকালো হলেও পরে ক্রোমো-লিথোগ্রাফি পদ্ধতিতে চমৎকার সব কার্ড তৈরি হতে থাকে। এ সব কার্ডের দাম ছিল এক আনা/ দু'আনা। স্বাভাবিকভাবেই তা ছিল বাংলার সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। তাহলে, এগুলোর ক্রেতা কারা ছিলেন?
ব্রিটিশ শাসিত ভারতে তখন কর্ম ও ব্যবসা সূত্রে নানাদেশের লোকের বাস। তারা নিজ নিজ দেশে পরিবার ও বন্ধুদের সাথে যোগাযোগের জন্য বেছে নিলেন এই কার্ড। কার্ডগুলোতে তাই ছবি আকারে উঠে এলো ভারতবর্ষের বিচিত্র জীবনযাত্রা, পেশা, পোশাক-আশাক আর বিশেষভাবে হিমালয় ও সংলগ্ন এলাকার অপূর্ব ভূ-প্রকৃতি। ঔপনিবেশিক জীবনের নানা অনুষঙ্গও এসব কার্ডে স্থান পায়। অনেকেই সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বেশি বেশি কার্ড লেনদেন করতেন। ইংরেজ মহিলারা ছিলেন কার্ডের সব থেকে বড় সংগ্রাহক। পারিবারিক অ্যালবামে ছবির মতন খাপে খাপে এ সংগ্রহ তারা সাজিয়ে রাখতেন। ফলে সামগ্রিক ভাবে পোস্টকার্ডের বিক্রি অনেক বেড়ে গেল। ১৯৩৮ সালের এক হিসেবে দেখা যায়, শুধুমাত্র ঐ বছরই সরকারি উদ্যোগে ২৭০ মিলিয়ন পোস্টকার্ড ছাপানো হয়। উল্লেখ্য এসময় বেসরকারি উদ্যোগের যে বিশাল পরিসংখ্যান তার কোনো রেকর্ড পাওয়া যায়নি।

পোস্টকার্ডে পূর্ববঙ্গ
সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার কথা বিবেচনায় রেখে সরকারি সকল ডাকঘরে সেসময়ে ছবিবিহীন করেস্পন্ডেন্স কার্ডগুলো ছিল সহজলভ্য। ছবিযুক্ত কার্ডে অবিভক্ত বাংলার বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের বহু বিচিত্র বিষয়ের ছবি স্থান পেলেও পূর্ববঙ্গ এসকল পোস্টকার্ডে প্রায় উপেক্ষিত বলা যায়। এরপরও অল্প কিছু কার্ডে পূর্ববঙ্গের নানা বিষয় জায়গা করে নিয়েছে। এই কার্ডগুলো ছাপা হয়েছিল ভিন্ন ভিন্ন উদ্যোগে। এখানে তার কিছু নমুনা উল্লেখ করছি। আগেই উল্লেখ করেছি যে পোস্টকার্ডের জনপ্রিয়তার সুযোগ নিতে বেশ কিছু প্রথিতযশা ফটো স্টুডিও এই ব্যবসায় নাম লিখিয়েছিল। পূর্ববঙ্গের প্রধান শহর ঢাকায় উনিশ শতকের শেষ কিংবা বিশ শতকের শুরুতে চালু হয় জার্মান ফটোগ্রাফার ফ্রিৎজ কাপের ফটো স্টুডিও।
ফ্রিৎজ কাপ নামটি অনেকের কাছেই পরিচিত। বিশ শতকের শুরুর ঢাকা কেমন ছিল? ঢাকার প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ কারা ছিলেন? কেমন ছিলেন তারা দেখতে? নগরবাসীর দৈনন্দিন জীবন, বিনোদনের ব্যবস্থাই বা কেমন ছিল? এসবের উত্তর যদি আলোকচিত্রের মাধ্যমে জানতে চাই তাহলে একটিমাত্র নামই বার বার ঘুরে ফিরে আসবে- ফ্রিৎজ কাপ। জার্মান এই ভদ্রলোকের স্টুডিও ছিল কলকাতা আর দার্জিলিং এ। ঢাকার নবাব খাজা আহসানউল্লাহর পৃষ্ঠপোষকতায় ফটোগ্রাফির সেই দুর্লভ যুগে ৮ নম্বর, ওয়াইজঘাট সড়কে কাপ গড়ে তুলেছিলেন নিজস্ব স্টুডিও।

খাজা আহসানউল্লাহর সাথে ফ্রিৎজ কাপের পরিচয় তাঁর নবাব হওয়ারও কয়েক বছর আগে, ১৮৮৯ সালে, কলকাতায়। খাজা আহসানউল্লাহ তখন কলকাতাকেন্দ্রিক ফটোগ্রাফিক সোসাইটি অব ইণ্ডিয়ার পরিচালকমণ্ডলীর মধ্যে একমাত্র ভারতীয়। ২৯, চৌরঙ্গী রোডে অবস্থিত ফ্রিৎজ কাপের স্টুডিও 'মেসার্স এফ কাপ এণ্ড কোম্পানি'র সৌজন্যে সোসাইটি তখন বিনা ভাড়ায় এর দু'টি কক্ষ ব্যবহার করত। সেই থেকেই ফ্রিৎজ কাপের সঙ্গে সখ্য গড়ে উঠে খাজা আহসানউল্লাহ এবং পুত্র খাজা সলিমুল্লাহর সাথে। ফটোগ্রাফির সেই প্রাথমিক যুগেই তিনি ছবি তোলা নিয়ে নানারকম পরীক্ষানিরীক্ষা করতে ভালবাসতেন।

স্টুডিওটির বিজ্ঞাপনে ফ্রিৎজ কাপ নিজেকে "Travelling photographer" হিসেবে উল্লেখ করেন। তবে ঢাকায় তাঁর স্টুডিওর ফটোগ্রাফি সীমিত ছিল মূলত ঢাকাস্থ য়ুরোপীয় অধিবাসী আর স্থানীয় জমিদার ও অবস্থাপন্ন পরিবারের ভেতরে। ঢাকার নবাবের পারিবারিক ফটোগ্রাফার হওয়ার সুবাদে ফ্রিৎজ কাপ আহসান মঞ্জিল ও এর অধিবাসীদের প্রচুর ছবি যেমন তুলেছেন তেমনি এ অঞ্চলের বহু গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান এবং ঘটনাও তাঁর ক্যামেরাবন্দী করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- লর্ড কার্জনের ঢাকা আগমন, বঙ্গভঙ্গ ও এর রদ, ১৮৯৭ এর ভূমিকম্প, আসাম-বেঙ্গল রেললাইন স্থাপন ইত্যাদি।
বোঝা যায়, ফ্রিৎজ কাপ ছিলেন উদ্যমী এক ফটোগ্রাফার। আর এই ফ্রিৎজ কাপের উদ্যোগেই ১৯০০ সালে ছাপানো হয় এক পোস্টকার্ড, যা এখনো পর্যন্ত ঢাকার ছবিযুক্ত পোস্টকার্ডের প্রাচীনতম নিদর্শন। পোস্টকার্ডে ঢেঁকিতে ধানভানার ছবিটি ক্যামেরাবন্দী করেছিলেন ফ্রিৎজ কাপ। ছবির নীচে তাঁর স্বাক্ষরও দেখা যায়। কার্ডটি তৎকালীন বোম্বে বন্দর থেকে পোস্ট করা হয়েছিল বিলাতের উদ্দেশ্যে। বর্তমানে এটি ব্রিটিশ লাইব্রেরির সাবেক কর্মকর্তা জনাব গ্রাহাম শ'এর ব্যক্তিগত সংগ্রহে আছে।

পূর্ববঙ্গের মূল জনগোষ্ঠী তখনও কৃষিকাজের সাথে যুক্ত। যে কারনে ব্রিটিশ ভারতে অল্প যে কয়টি পোস্টকার্ডে পূর্ববঙ্গ স্থান পেয়েছে সেখানে মূল বিষয় হিসেবে ঠাঁই পেয়েছে এখানকার কৃষিজীবী মানুষেরা, বিশেষত চা এবং পাটচাষীরা। ফ্রিৎজ কাপের পাশাপাশি কৃষিভিত্তিক জনজীবনের কিছু ছবি তুলেছিলেন কলকাতা ভিত্তিক ফটোস্টুডিও জন্সটন এন্ড হফম্যান। তাদের তোলা ছবি নিয়ে বেরিয়েছিল বেশ কিছু পোস্টকার্ড।
ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান রাফায়েল টাক এণ্ড সন্স ১৯২৪ সালে তাদের পোস্টকার্ডে ছাপিয়েছিল ঢাকার হস্তশিল্পের এক অনবদ্য নমুনা – আহসান মঞ্জিলের ফিলিগ্রি অনুকৃতি। ওয়েম্বলির ব্রিটিশ এম্পায়ার প্রদর্শনীতে বেঙ্গল প্যাভিলিয়নের জন্য ৬টি কার্ডের একটি সেট প্রকাশ করা হয়, এই কার্ডটি সেগুলোরই একটি। আহসান মঞ্জিলের এই ফিলিগ্রি অনুকৃতিটিরও একটি আকর্ষণীয় কাহিনী আছে। ১৮৭০ সালে এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে পারস্যদেশ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। সেসময় আরও অনেক বিশ্বনেতার পাশাপাশি এগিয়ে আসেন ঢাকার নবাব আব্দুল গনি। দুর্দশাগ্রস্ত অধিবাসীদের জন্য ৩০০০টাকা অনুদান পাঠিয়ে দেন। পারস্যবাসী সুদূর ঢাকার নবাবের এই বদান্যতায় মুগ্ধ হয়। এরপর থেকে নবাব পরিবারের সাথে পারস্যরাজের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল।

১৮৯৯ সালে পারস্যের বাদশা মোজাফফর উদ্দিন কাজার, নবাব আহসানউল্লাহর কাছে ঢাকার ঐতিহাসিক হোসেনি দালানের একটি আলোকচিত্র পাঠাতে অনুরোধ করেন। আলোকচিত্র ততদিনে বেশ সহজলভ্য। নবাবের পৃষ্ঠপোষকতায় তখন ঢাকায় নিয়মিত ছবি তুলছেন জার্মান আলোকচিত্রী ফ্রিটজ কাপ। কিন্তু দূরদেশে শুধুমাত্র একটি আলোকচিত্র পাঠাতে তার মন চাইলো না। ঢাকার সোনা-রূপার কাজ, বিশেষত ফিলিগ্রিকাজের তখন খুব নাম-ডাক। নবাব আহসানউল্লাহ সেসময়কার সেরা এক কর্মকার আনন্দ হরিকে হোসেনি দালানের একটি অনুকৃতি বা রেপ্লিকা তৈরির দায়িত্ব দিলেন। আনন্দ হরি কর্মকার তার সুনিপুণ হাতের কাজে তৈরি করলেন দুইটি অনুকৃতি - একটি নবাবের নির্দেশ অনুযায়ী হোসেনি দালানের, অপরটি নবাবকে উপহার দেবার জন্য বানালেন আহসান মঞ্জিলের অনুকৃতি। আহসান মঞ্জিলের সেই অনুকৃতিটিই স্থান পেয়েছে টাক এন্ড সন্সের কার্ডে। বোঝা যায়, ঢাকার এই ফিলিগ্রি কাজ সে সময় বেশ আলোড়ন তুলেছিল।
ফটো স্টুডিও এবং প্রথাগত পোস্টকার্ড ব্যবসায়ির পাশাপাশি আরো একটি উদ্যোগে পুর্ববঙ্গে পোস্টকার্ড বেরিয়েছিল, সেই উদ্যোক্তা হলেন খ্রিস্টান মিশনারিরা। উনিশ শতকের শেষভাগ জুড়ে বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ধর্ম প্রচারের সুবিধার্থে মিশনারিরা দু'টি প্রযুক্তি বেশ ব্যবহার করতেন- তার একটি ম্যাজিক লণ্ঠন, অপরটি ক্যামেরা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এগুলো দান সূত্রে সংগৃহিত হত, নিজেদের পত্রিকাতে সে দান স্বীকারও করতেন। প্রথম দিকে নিজেদের কার্যক্রমের রেকর্ড রাখবার তাগিদে ক্যামেরা ব্যবহার করলেও পরবর্তীতে তাঁরা ক্যামেরায় তোলা ছবি পোস্টকার্ডে ব্যবহার করে তহবিল সংগ্রহ করেছেন। এরকম বেশ কিছু পোস্টকার্ডে উঠে এসেছে ফরিদপুর, নওগাঁ, ময়মনসিংহ এলাকার সাধারণ জনগোষ্ঠীর প্রাত্যহিক জীবনের ছবি।

বিশ শতকের বাঙালি সমাজে যোগাযোগের মাধ্যমরূপে অল্প সময়েই তুমুল জনপ্রিয়তা পায় পোস্টকার্ড। বাংলার কর্মজীবি মানুষের একটা বড় অংশের কর্মস্থল ছিল কলকাতা আর ঢাকা। কর্মক্ষেত্র থেকে দূরদূরান্তে নিজ নিজ পরিবারের সাথে যোগাযোগ রাখতে তাঁরা ব্যবহার করতে শুরু করেন পোস্টকার্ড। এমনও দেখা যেতো যে পরিবারের কর্তা যখন বাড়ি যেতেন, সাথে নিতেন রানি ভিক্টোরিয়ার ছবি ছাপানো অনেকগুলো খালি পোস্টকার্ড। কাজে ফেরার আগে ওগুলোতে নিজের কর্মস্থলের নির্ভুল ঠিকানা লিখে রেখে আসতেন, যাতে বাড়ির লোকজনের সাথে যোগাযোগে কোনো সমস্যা না হয়। অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষেরা এক পয়সার বিনিময়ে পেশাদার পত্রলেখককে দিয়ে পোস্টকার্ড লিখিয়েও নিতেন।
বাড়ির স্ত্রীলোকেরা অবশ্য কারো কাছে গিয়ে লেখানোর চেয়ে নিজেই গোটা গোটা অক্ষরে পোস্টকার্ড ভরিয়ে তুলতেন; আপন মানুষটির কাছে অভাব-অভিযোগের সব কথা উজাড় করে দিতেন। এরকম বহু পোস্টকার্ডের কথা ছড়িয়ে আছে সেকালের গল্প উপন্যাসের পাতায় পাতায়।

জীবনানন্দ দাশের উপন্যাস 'নিরূপমযাত্রা'র প্রভাত গ্রামের বাড়ি থেকে স্ত্রী কমলার এরকমই এক পোস্টকার্ড পায়, যার ছত্রে ছত্রে হাজার অনুযোগ- "এতদিনেও কেন সে চাকরি জোগাড় করে উঠতে পারল না? বিয়েই-বা করেছিল কেন?" ইত্যাদি।
প্রভাত কলকাতার এক মেসে থাকে, সাথে থাকে আরও ত্রিশ-পয়ত্রিশ জন মানুষ। পিয়ন এসে যেভাবে খোলা টিনের বাক্সের উপর পোস্টকার্ডটা ফেলে রেখে যায়, তাতে "যে খুশি যখন খুশি চিঠি নেড়েচেড়ে দেখে—কার্ড পড়ার অভ্যাস অনেকেরই আছে"। প্রভাত বিব্রত বোধ করে। তাঁর মনের গহীন কোণেও অনুযোগের সুর- "একখানা খামে লিখতে পারত কমলা" কোথায় যেন সবটুকু লেখা মিলে যায় জীবনানন্দের বিষন্ন, নিঃসঙ্গ জীবনের সাথে, যেখান স্ত্রী লাবণ্য দাসের ক্রমাগত অনুযোগ তাঁকে বিদ্ধ করে চলে।
শুধু কি ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখই উঠে আসে ঐ কার্ডগুলোয়? নাহ, পোস্টকার্ড ধারণ করে সেকালের সমাজটাকেও। জীবনানন্দের গল্প 'কারুবাসনা' থেকে- "ভেবেছিলাম সন্তান প্রসবের পর একটা টেলিগ্রাম আসবে, আসতও, কিন্তু মেয়ে হয়েছে বলে বাড়ির লোকেরা টেলিগ্রাম করলে না আর। বিলম্ব করে, অবহেলা করে একখানা পোস্টকার্ড লিখে সংবাদটা জানাল আমাকে। টিকটিকির মতো মেরুদণ্ডসার এই মেয়েটি বিধাতা ও মানুষের এতই উপেক্ষার জিনিশ? সুস্থ, সুগোল, সুন্দর শিশুকেই শুধু সম্ভব করতে হবে।" কালের অবধারিত অনুষঙ্গ হিসেবে সাহিত্যে পোস্টকার্ডের প্রসঙ্গ ঘুরে ফিরে আসবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে মজার বিষয় হল পোস্টকার্ডের কল্যাণে বাংলা পেয়েছে অমর এক সাহিত্যিক প্রেমেন্দ্র মিত্রকে।

সময়টা ১৯২২ সাল। প্রেমেন্দ্র মিত্র তখন ঢাকার জগন্নাথ কলেজের ছাত্র। একবার কলেজের টানা ছুটিতে গেলেন কলকাতা। উঠলেন যথারীতি ২৮ নম্বর গোবিন্দ ঘোষাল লেনের এক সস্তার মেস। শনিবার রাত হওয়াতে বোর্ডার তেমন নেই বললেই চলে। সারা সপ্তাহ চাকরি করে তাদের প্রায় সবাই বাড়ি গিয়েছেন। অনেক রাত পর্যন্ত ফাঁকা মেসবাড়িতে শুয়ে একটা ইংরেজি বই পড়ছিলেন। শুতে যাবার আগে চোখ পড়ল জানালার মাথায় কুলুঙ্গিতে রাখা এক কাগজের বান্ডিলের ওপরে। ধুলোভরা সেই বান্ডিলটা অনেক খানি ঝুলে পড়েছে, মনে হল আরেকটু হলেই মাথায় পড়বে। ঠেলা দিতে যেতেই অনেকখানি ধুলো ময়লা এসে পড়ল তাঁর চোখেমুখে; আর মেঝেতে উড়ে গিয়ে পড়ল একটা পোস্টকার্ড।
মেয়েলি বড় বড় অক্ষরে লেখা পোস্টকার্ড। কৌতুহল বেড়ে গেল প্রেমেন্দ্র মিত্রের। চিঠিতে কোনো সম্বোধন নেই। তবে বোঝা যায় নববধূ লিখেছেন তার স্বামীকে- আগের সপ্তাহে বাড়ি না আসার অনু্যোগ, সাথে কিছু সাংসারিক খবর আর দু'চারটি ফরমায়েশ। কার্ডে কোনো তারিখ উল্লেখ নেই। হয়তো এই সিটেরই পুরানো কোনো বোর্ডার তার কাগজপত্রের সাথে এই পোস্টকার্ডটিও অপ্রয়োজনীয় বোধ করে ফেলে গেছেন।

তবে প্রেমেন্দ্র মিত্রের চোখে যেন পুরো দৃশ্যটা ভেসে উঠল- তিনি স্পষ্ট দেখতে পেলেন দ্বিতীয় ভাগ পাশ করে গ্রামের এক কিশোরী বধূ, যিনি ঘোমটার ভেতরে স্নিগ্ধ সলজ্জ চোখে শহরে কর্মরত স্বামীর জন্যে অপেক্ষার দিন গুনছেন। ধুলোমাখা ঐ পোস্টকার্ডে মুগ্ধ প্রেমেন্দ্র মিত্র কি মনে করে সেই রাতেই দুটো গল্প লিখে ফেললেন- 'শুধু কেরাণী' আর 'গোপনচারিণী'। পরদিন সকালে পোস্ট অফিসে গিয়ে 'প্রবাসী'র ঠিকানায় সে গল্পগুলো পাঠিয়েও দিলেন। ঢাকায় ফিরে মাসের পর মাস লক্ষ্মীবাজারে অক্সফোর্ড মিশনের রিডিং রুমে নজর রাখতে থাকলেন 'প্রবাসী'র দিকে। কিন্তু নাহ, কোনো খোঁজ নেই! হঠাৎ এক দিন ডাইনিং হলে বন্ধু বিজয় বোস জানালেন, ''এ মাসের যে প্রবাসীটি আজ বিকেলে এসেছে, কাল সকালে রীডিং রুমে দেখো। একটা গল্পের লেখকের নাম হুবহু তোমার যা, তা-ই!'' জন্ম নিলেন লেখক প্রেমেন্দ্র মিত্র।
পোস্টকার্ডপ্রেমী আরেক বাঙালি শিল্পাচার্য নন্দলাল বসু। শান্তিনিকেতন থেকে অজস্র কার্ড তিনি লিখেছেন তাঁর আত্মীয়-বন্ধুদের। সেসব কার্ডের একপাশ জুড়ে আছে শান্তিনিকেতনের প্রকৃতি- গাছপালা থেকে খোয়াইয়ের ভূ-প্রকৃতি, সাঁওতালি জীবন, এসব কিছু। আর ভ্রমণে সব সময় রাখতেন বান্ডিল করা পোস্টকার্ড। যেখানে যেতেন বন্ধুদের ছবি এঁকে এঁকে পোস্ট করতেন সব বৃত্তান্ত। ঢাকার বাসিন্দা বন্ধু রমেশ চরণ বসু মজুমদারের ঠিকানায় পোস্ট করা ১৯২১ সালের একটি পোস্টকার্ডে তিনি বাঘের ছবি এঁকেছেন, সাথে জুড়েছেন তার বর্ণনা। এরকম আরও অনেক পোস্টকার্ড ছড়িয়ে আছে তাঁর বন্ধু কিংবা ছাত্র-ছাত্রীদের সংগ্রহে।

দেড়শত বছর পেরিয়ে
পোস্টকার্ড প্রথম প্রচলনের দেড়শত বছর পূর্ণ হয়েছে ২০১৯ সালে। এর মাঝে বদলেছে সময়, বদলেছে দেশের নাম, তার সীমারেখা। পাকিস্তান আমলে ছাপানো পোস্টকার্ডে বিষয়তালিকায় যুক্ত হয় লালবাগ কেল্লা, তারা মসজিদসহ সে সময়কার কিছু নতুন নির্মিত স্থাপনা যেমন বায়তুল মোকাররম মসজিদ, ডি.আই.টি.ভবন, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ইত্যাদি। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি আরো যেসব প্রতিষ্ঠান থেকে এই কার্ডগুলো ছাপানো হত তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল পিআইএ এবং হোটেল শাহবাগ। চট্টগ্রামের স্টেশন রোডের ওয়াহিদি'স ফটোগ্রাফার এই অঞ্চলের মানুষের পেশা আর বিভিন্ন প্রাকৃতিক দৃশ্য নিয়ে ৬৪টি পোস্টকার্ডের একটি জনপ্রিয় সিরিজ বের করে। এর ভেতরে বেশ অনেকগুলোরই বিষয় ছিল দেশের নানা প্রত্নসম্পদ, স্থাপনা ও নদনদীকেন্দ্রিক জীবন। স্বাধীন বাংলাদেশে পোস্টকার্ড ব্যবসার তুঙ্গে ছিল ইসলাম প্রোডাক্টস, আইডিয়াল প্রোডাক্টস এবং আজাদ প্রোডাক্টস। ঢাকার যে দু'টো ল্যান্ডমার্ক স্বাধীন বাংলাদেশে ছাপানো পোস্টকার্ডে বার বার এসেছে তার একটি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, অপরটি জাতীয় সংসদ ভবন।
এছাড়া বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদসহ অন্যান্য প্রাচীন মসজিদ, দুর্গ, পাহারপুর বৌদ্ধ বিহার, আর পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের বৈচিত্র্যময় জীবন এসব পোস্টকার্ডে নিয়মিত স্থান পায়।

ব্রিটিশ ভারতে তো বটেই, এই কয়েক দশক আগেও আত্মীয়স্বজনদের খবরাখবর নেওয়ার জন্য পোস্টকার্ড আদান প্রদান ছিল এক নিয়মিত রীতি। বিশেষ ভাবে ঈদ, পূজা আর নববর্ষে যোগাযোগের সস্তা এই মাধ্যমটির চাহিদা থাকত তুঙ্গে। বাড়ির কর্তাব্যক্তিরা রীতিমতন বান্ডিল ধরে পোস্টকার্ড কিনে আনতেন। এরপর শুরু হত শুভেচ্ছা আর আশীর্বাদ বাণী লিখে পোস্ট করার কাজ। সেকালের শিশুকিশোরদের দেশ বিদেশের ডাকটিকেট সংগ্রহের পাশাপাশি বিভিন্ন ছবির পোস্টকার্ড জমানোর একটা শখ ছিল। ১৯৯০এর দশকেও ঢাকার কিশোর তরুণদের মাঝে ভিউকার্ড নামে পোস্টকার্ড সংগ্রহের ব্যাপক জনপ্রিয়তা ছিল। সে সময়তো ল্যান্ডফোনের প্রসার ছিল সীমিত। যুগ বদলাল, বদলে গেল প্রযুক্তি।
মোবাইল, স্মার্টফোন আর এসএমএসএর যুগে যোগাযোগের বিকল্প তো অগণিত! সবকিছুতে চাই ক্ষীপ্র গতি! ব্যক্তিগত চিঠিপত্র আর পোস্টকার্ডের ব্যবহার তাই সীমিত থেকে সীমিততর হয়ে গেছে। পোস্টম্যানের হাত থেকে পোস্টকার্ড নেয়ার দিনগুলি হারিয়ে গেছে একদম। শুধুমাত্র স্যুভেনির হিসেবে টিকে থাকার জন্য অবিক্রিত পোস্টকার্ড পড়ে থেকেছে বহুদিন। চিঠি লেখার চর্চা প্রায় লুপ্ত কলা। আমাদের চিঠি লেখার মানুষগুলোও তো এক এক করে অতীত হয়ে গেল, যাচ্ছে, আর সে সাথে নিজেদের অজান্তেই আমরা হারিয়ে ফেললাম "শ্রদ্ধাস্পদেষু, "শ্রীচরণেষু', "প্রিয়তমেষু", "প্রীতিভাজনেষু" এর মতন মাতৃভাষার অপূর্ব সব সম্বোধন!
-
সহায়ক সূত্র: ঢাকার ইতিহাস (১ম খণ্ড) - যতীন্দ্রমোহন রায়, ১৯১২
ছবি তোলা বাঙালির ফটোগ্রাফি চর্চা- সিদ্ধার্থ ঘোষ, আনন্দ পাবলিশার্স, ১৯৮৮
Picturesque India A journey in Early Picture Postacrds (1896-1947) by Sangeeta and Ratnesh Mathur, 2018