১২ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে জ্বালানি নেন শ্রীলঙ্কার নারী অটোচালক

কলম্বোর কাছেই শহরতলীতে অটো রিকশা চালান ৪৩ বছর বয়সী নারী লাসান্দা দীপ্তি। আকাশী নীল তিন চাকার অটোতে যাত্রী তোলার আগে দেখে নেন কতটুকু জ্বালানি বাকি আছে। ওই জ্বালানিতে গন্তব্যে পৌঁছানো সম্ভব হলে তবে যাত্রী তুলেন।
দীপ্তির সারাদিনের পরিকল্পনাই এখন শুরু হয় জ্বালানির লাইনে অপেক্ষা ঘিরে। জ্বালানি যখন প্রায় খালি হবে তখন অটো নিয়ে গ্যাস স্টেশনের বাইরের দীর্ঘ লাইনে দাঁড়ান। কখনো কখনো সারারাত অপেক্ষার পর পেট্রোল পাওয়া যায়। তাও আট মাস আগে যে দামে কিনতেন, তার চেয়ে আড়াই গুণ বেশি দাম দিয়ে কিনতে হয়।
দীপ্তির মতোই কঠিন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দিন পার করছে শ্রীলঙ্কার সাধারণ মানুষ। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতার পর থেকে দেশটি সবচেয়ে খারাপ অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে রয়েছে। আয় কমে যাওয়ার পাশাপাশি দ্রুতগতিতে বাড়ছে মুদ্রাস্ফীতি। জ্বালানি থেকে শুরু ওষুধের মতো প্রয়োজনীয় অনেক পণ্যেই দেখা দিয়েছে ঘাটতি।
২২ মিলিয়ন জনগোষ্ঠীর দক্ষিণ এশীয় দ্বীপরাষ্ট্রটিতে সাধারণত নারী অটো রিকশা চালকের দেখা মিলে না।
কিন্তু দীপ্তি পাঁচ সদস্যের পরিবার চালাতে গত সাত বছর ধরে এই কাজটিই করে আসছেন। স্থানীয় রাইড-শেয়ারিং অ্যাপ পিকমি ব্যবহার করে তিনি যাত্রীবহন করেন।
অর্থনৈতিক সংকট শুরুর পর থকে আগের চেয়ে রাইডও কম পাচ্ছেন। পেট্রোলের জন্যও তাকে প্রচুর ছোটাছুটি করতে হচ্ছে।

আগে দীপ্তির মাসিক আয় ছিল শ্রীলঙ্কান মুদ্রায় ৫০ হাজার রুপি (১৩৮ ইউএস ডলার বা প্রায় ১২ হাজার টাকা)। জানুয়ারি থেকে কমতে শুরু করে তার উপার্জন। আগে যা কামাতেন এখন তার অর্ধেকেরও কম পান।
"অন্য যেকোনো কাজের চেয়ে আমি এখন পেট্রোলের লাইনে বেশি সময় ধরে অপেক্ষা করি," বলেন দীপ্তি। "কখনও কখনও বিকাল ৩টায় লাইনে দাঁড়িয়ে তেল ভরতে ভরতে ১২ ঘণ্টা পার হয়ে যায়"।
"অনেকবার এমন হয়েছে যে আমি দীর্ঘসময় ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে শুনি জ্বালানি ফুরিয়ে গেছে", কলম্বোর উপকণ্ঠে ছোট শহর গোনাপোলায় দুই বেডরুমের ভাড়া বাসায় চা বানাতে বানাতে বলছিলেন দীপ্তি। মা ও ছোট তিন ভাইয়ের সঙ্গে এই বাড়িতে থাকেন তিনি। স্বামীর সঙ্গে আগেই বিচ্ছেদ হয়েছে তার। একমাত্র মেয়ে বিয়ের পর আলাদা থাকছে।
মে মাসের মাঝামাঝি একদিন জ্বালানির লাইনে প্রায় আড়াইদিন ধরে অপেক্ষা করতে হয় দীপ্তিকে। সেদিন ভাইদের একজন তাকে সঙ্গ দেয়।
"এটা যে কী ভয়াবহ তা বর্ণনা করার মতো শব্দও আমার কাছে নেই। রাতে আমি প্রায়ই নিরাপদ বোধ করি না, কিন্তু এখন অন্য কিছুও করার নেই," বলেন তিনি।

সকালে উঠে জলের বোতল ভরে অটো রিকশা পরিষ্কার করে গাড়িতে ওঠার আগে ধূপকাঠি জ্বালিয়ে নিলেন দীপ্তি।
বেশিরভাগ দিনের মতো আজও তার প্রধান কাজ পেট্রোলের সন্ধান করা যার দাম ২০২১ সালের অক্টোবরের তুলনায় ২৫৯ শতাংশ বেড়েছে। সরকার ভর্তুকি কমিয়ে অর্থনীতি স্থিতিশীল করার চেষ্টা করায় এই পরিণতি।
শ্রীলঙ্কার বর্তমান সংকটের শুরু কোভিড-১৯ মহামারির সময়। লকডাউনে দেশটির লাভজনক পর্যটন শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একইসঙ্গে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সও হ্রাস পায়।
প্রভাবশালী রাজাপাকসে পরিবারের অব্যবস্থাপনায় সৃষ্ট অর্থনৈতিক দুরবস্থায় বিক্ষুদ্ধ শ্রীলঙ্কানরা সাম্প্রতিক সময়ে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করে।
নতুন প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমসিংহকে গত সপ্তাহে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি ছয় সপ্তাহের মধ্যে একটি বাজেট পেশ করার পরিকল্পনা করছেন। ব্যয়ভার কমিয়ে দুই বছরের কল্যাণমূলক কর্মসূচির পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকে জরুরি ঋণ লাভের আলোচনাকেও বিক্রমসিংহের নীতি এগিয়ে নিতে সাহায্য করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

কিন্তু দীপ্তি হতাশ।
তিনি টাকা জমিয়ে যে গাড়িটি কিনেছিলেন তা গতবছর লিজ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে বিক্রি করতে হয়।
দ্বিতীয় আরেকটি অটো তার ভাইদের একজন চালায়, যেটা মেরামত করা দরকার। কিন্তু পরিবারটির কাছে সেই অর্থও নেই। মহামারির আগে দীপ্তি একখণ্ড জমি কিনেছিলেন, কিন্তু এখনও ঋণের এক লাখ রুপি পরিশোধ করা বাকি।
দীপ্তি তার তিন মাস বয়সী নাতনিকেও দেখতে চান। কিন্তু পেশার নার্স তার মেয়ে থাকে আরও ১৭০ কিলোমিটার দূরের সমুদ্রতীরবর্তী শহর মাতারায়। এতদূর কীভাবে যাবেন তা জানেন না।
"পরিবারের জন্য পর্যাপ্ত চাল আর সবজি যোগাড় করতেই হিমশিম খাচ্ছি। মায়ের জন্য ওষুধ পাচ্ছি না। আগামী মাসে কীভাবে বাঁচব? ভবিষ্যতে কী আছে জানি না," বলেন তিনি।
- সূত্র: রয়টার্স