অসুস্থ বাবার মৃত্যুর পর যেভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করবেন মোহাম্মদ বিন সালমান

গত ৬৮ বছর ধরে সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠাতা বাদশাহ আবদুল আজিজ বিন আবদুল রহমান আল-সৌদের সন্তানেরা দেশটি শাসন করে করে এসেছেন।
আবদুল আজিজের ৩৪ পুত্রের মধ্যে সর্বশেষ পুত্র হিসেবে বর্তমানে ক্ষমতায় আছেন বাদশাহ সালমান। ২০১৭ সালে তিনি নিজ পুত্র মোহাম্মদ বিন সালমানকে উত্তরাধিকারী হিসেবে বেছে নেন।
এরপর নামের আদ্যক্ষর অনুযায়ী এমবিএস (MBS) নামে পরিচিত ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদই দেশটির প্রকৃত নেতা হয়ে উঠেন। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর তার বাদশাহ হওয়ার পথে সম্ভাব্য সব প্রতিবন্ধকতাকেই দূর করেন তিনি। কারারুদ্ধ করেন আব্দুল আজিজের একমাত্র বেঁচে থাকা পুত্র যুবরাজ আহমেদকে।
এদিকে, সিংহাসন গ্রহণ করার পর থেকেই বাদশাহ সালমানের মৃত্যুর মৃত্যুর গুজব ছড়াতে শুরু করে কূটনীতিক এবং বিশ্লেষকদের মাঝে।
বাদশাহ ঠিক কতটা অসুস্থ, তা বাইরের কেউ জানেন না। তবে করোনা মহামারির প্রায় পুরোটুকু সময়ই মরুভূমির প্রাসাদে কাটানো ৮৬ বছর বয়সী সালমান এরমধ্যে যে দু-একবার জনসম্মুখে এসেছেন, তখন তাকে বেশ দুর্বল দেখিয়েছে।
সালমানের চেয়ে তার সন্তানের ক্ষমতাগ্রহণ অন্যরকম হবে। পূর্বের যেকোনো বাদশাহর চেয়েই এই ক্ষমতাগ্রহণ আলাদা হবে। কারণ বলা বাহুল্য, ৩৬ বয়সী এমবিএসের সিংহাসন-যাত্রা হবে বেশ দীর্ঘ।
সৌদি আরবের সাম্প্রতিক ইতিহাসে এমবিএসের মতো অল্প বয়সে কেউ ক্ষমতা গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত হয়নি।
চলুন জেনে নেওয়া যাক, কীভাবে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হতে যাচ্ছেন এমবিএস এবং তার অভিষেককে কীভাবে গ্রহণ করবে বিশ্ব।
তাৎক্ষণিক দাফন এবং কবরস্থানের চারপাশে স্নাইপার মোতায়েন
একজন সৌদি শাসকের মৃত্যুর পর তার উত্তরাধিকারীর ক্ষমতাগ্রহণ সাধারণত বেশ দ্রুত ও নির্বিঘ্নেই হয়।
সালমানের মৃত্যুর পরও নিয়ম মেনে বেশ কিছু প্রটোকল পালন করা হবে। এরমধ্যে প্রথমে, রাষ্ট্রায়ত্ত সৌদি প্রেস এজেন্সি বাদশাহর মৃত্যু ঘোষণা করবে এবং শেষকৃত্যের সময় ও অবস্থান জানাবে। সৌদি টিভি চ্যানেলগুলো তাদের স্বাভাবিক অনুষ্ঠানমালা স্থগিত করে জানাজা ও এর সঙ্গে সংযুক্ত কার্যাবলী সম্প্রচার করবে।
শরিয়া অনুযায়ী ব্যক্তির মৃত্যুর পর তাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দাফন করাটাই নিয়ম। সৌদি রাজপরিবারও এই আইনের ব্যত্যয় করে না।

২০১৫ সালের ২৩ জানুয়ারি যখন বাদশাহ আবদুল্লাহ মারা যান, তখন তার মৃতদেহ একটি সাধারণ কাপড়ে মুড়িয়ে স্ট্রেচারে শুইয়ে রাখা হয়। এবং সেদিনই ইমাম তুর্কি বিন আবদুল্লাহ মসজিদে তার জানাজা পড়ানো হয়।
২০০৫ সালে বাদশাহ ফাহাদ মারা যাওয়ার পর একই মসজিদের চারপাশের রাস্তাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। কড়া সামরিক প্রহরায় তাকে দাফন করা হয়।
আল-ওদ কবরস্থানের চারপাশেও স্নাইপার নিয়োগ করা হয়। সাধারণত রাজ পরিবারের সদস্যদের সমাধিস্থ করা হয় রিয়াদের এই কবরস্থানেই।
রীতি অনুযায়ী শেষকৃত্য ও সমাধিস্থলে কোনো নারী ও অমুসলিম থাকে না।
এদিকে, রিয়াদে সরকারি কার্যালয়গুলো যথারীতি খোলা থাকে এবং পতাকাও নামানো হয় না। নতুন বাদশাহর প্রতি সমবেদনা জানিয়ে বায়াত শুরু হয়। বায়াত হচ্ছে নতুন সম্রাটের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের অনুষ্ঠান, যেখানে শুভাকাঙ্ক্ষীরা তার হাত বা ডান কাঁধে চুমো দিয়ে অভিবাদন জানায়।
রাষ্ট্রীয় আইন অনুসারে, ৩৪ সদস্যের রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা কাউন্সিলের (যেখানে আব্দুল আজিজের ৩৪ সন্তানের পরিবার প্রতিনিধিত্ব করে) আনুগত্য পেলেই আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেয়ে যান নতুন বাদশাহ।
২০১৭ সালে ক্রাউন প্রিন্স ঘোষিত হওয়ার পর ৩৪ জনের মধ্যে ৩১ জনেরই ভোট পেয়েছিলেন এমবিএস। তবে সেসময় আনুগত্য আদায়ের জন্য নিরাপত্তা কাউন্সিলের অনেক সদস্যকেই হুমকি-ধামকি দিয়েছিলেন তিনি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই পাঁচ বছরে রাজ পরিবারের উপর বেশ ভালোভাবেই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছেন এমবিএস। তাই নিরাপত্তা কাউন্সিলের পক্ষ থেকে সবুজ বাতি পাওয়াটা শুধু সময়ের ব্যাপার বলেই মনে করছেন তারা।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে?

ইতিহাস বলছে, নতুন সৌদি বাদশাহর অভিষেক ঘটলে আঞ্চলিক ও বিশ্ব নেতারা তাকে অভিবাদন জানাতে রিয়াদেই উড়ে আসেন।
২০১৫ সালে বাদশাহ আবদুল্লাহর মৃত্যুর খবর শুনেই তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তার ভারত সফর সংক্ষিপ্ত করে সৌদি আরবের দিকে রওনা হন। তার সফরসঙ্গী হন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি, সিনেটর জন ম্যাককেইন এবং সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী কন্ডোলিজা রাইস।
একইভাবে সৌদি আরবের আরেক পশ্চিমা মিত্র যুক্তরাজ্য প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন, প্রিন্স চার্লস এবং সাবেক রাষ্ট্রদূত জেনকিন্সসহ একটি প্রতিনিধি দলকে পাঠায় রিয়াদে।
তবে এমবিএসের বেলায় যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো পশ্চিমা দেশগুলো এমন উষ্ণ অভিবাদন জানানোর সম্ভাবনা বেশ কম।
২০১৮ সালে সৌদি যুবরাজের নির্দেশে হওয়া জামাল খাসোগজি হত্যাকাণ্ডের তীব্র সমালোচনা করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও। ২০২০ সালের নির্বাচনী প্রচারণায় বাইডেন সৌদি আরবকে 'একঘরে' করে দিবেন বলেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
বাইডেন প্রশাসন গত এক বছরে সৌদি আরবের সঙ্গে কূটনৈতিক উষ্ণতা কিছুটা কমিয়েও এনেছে। তবে দীর্ঘদিনের মিত্রের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার মতো অবস্থায় নেই যুক্তরাষ্ট্র।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাদশাহ সালমানের মৃত্যু ওয়াশিংটনকে কিছুটা বেকায়দাতেই ফেলে দিবে।
তবে যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তুত থাকবে। প্রস্তুত থাকবে এমবিএস প্রশাসনও। আঞ্চলিক মিত্রদের থেকে শুরু করে পশ্চিমা মিত্র, সবার সঙ্গেই সম্পর্ক জোরদার করার চেষ্টা চালাবে রিয়াদ।
বাদশাহ মোহাম্মাদের ক্রাউন প্রিন্স কে হবেন?
একজনকে ক্রাউন প্রিন্স ঘোষণা করেই সাধারণত সৌদি বাদশাহ তার রাজকার্য শুরু করেন।
এমবিএস হতে যাচ্ছেন রাজ পরিবারের নতুন প্রজন্মের প্রথম বাদশাহ। তাই তিনি উত্তরাধিকারী হিসেবে কাকে ঘোষণা করবেন, তার উপর বাড়তি আকর্ষণ থাকছেই।
নিজের ছয় ভাইয়ের মধ্যে কাউকে ঘোষণা করতে পারেন, কিংবা ঘোষণা করতে পারেন রাজ পরিবারের অন্য অংশের কোনো মিত্রকে।

এমবিএসের শিশু সন্তানও আছে কয়েকজন। তবে তাদেরকে ক্রাউন প্রিন্স বানাতে পারবেন না তিনি।
২০১৭ সালে যখন এমবিএসকে ক্রাউন প্রিন্স করা হয়, তখন সৌদি রাজপরিবারের অনেক সদস্যই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। এতদিন সিংহাসন ভ্রাতা-সূত্রে পরিবর্তিত হতে থাকলেও, সামনে এটি উত্তরাধিকার সূত্রে পরিবর্তিত হতে শুরু করবে উদ্বেগ প্রকাশ করেন তারা।
যে কারণে বাদশাহ সালমান নতুন এক আইন জারি করেন, যেটি অনুযায়ী এমবিএস তার সন্তানদের ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে ঘোষণা করতে পারবেন না।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এমবিএস কোনো ক্রাউন প্রিন্স ঘোষণা নাও করতে পারেন। কিংবা পরিবর্তন করে ফেলতে পারেন বর্তমান আইন।
এটি খুবই প্রত্যাশিত, ক্ষমতা গ্রহণের পর এমবিএস তার অনুগতদের নিয়ে কেবিনেট সাজাবেন, বসাবেন গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় পদগুলোয়। বাদশাহ সালমানও তাই করেছিলেন।
ক্ষমতা গ্রহণের সাথে সাথে সাবেক বাদশাহ আবদুল্লাহর দুই ছেলে, তুর্কি ও মিশালকে তাদের প্রাদেশিক সরকারের ভূমিকা থেকে সরিয়ে দেন সালমান। এবং তার ভাই যুবরাজ
মুকরিনকে নিযুক্ত করেন ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে।
২০১৫ সালে মুকরিনকে সরিয়ে মোহাম্মদ বিন নায়েফকে ক্রাউন প্রিন্সের পদ প্রদান করেন সালমান। কেন এই পরিবর্তন আনা হয়েছিল, তা জানা যায়নি।
২০১৭ সালে নায়েফকে সরিয়েই ক্রাউন প্রিন্স হন এমবিএস। এরপর থেকেই নায়েফকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, তাকে কেন্দ্র করেই তৈরি হতে পারে এমবিএস-বিরোধী আন্দোলন।
ক্রাউন প্রিন্স হওয়ার পর থেকেই এমবিএস তার পথের কাঁটা সরাতে শুরু করেন এবং সহযোগীদের নিয়ে জোট গঠন করতে শুরু করেন। তাই ক্ষমতায় আরোহণ করার জন্য এমবিএস এখন বেশ ভালোভাবেই প্রস্তুত বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
- সূত্র- ইনসাইডার