যে কারণে মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটলো

মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক রূপান্তরের প্রক্রিয়া মাত্রই অগ্রসর হচ্ছিলো। অতিমারীর সময়েই অনুষ্ঠিত ২০২০-এর নির্বাচনের ফলাফল অং সান সূচির নেতৃত্বাধীন এনএলডির কাছে দেশে সাংবিধানিক সংস্কারের পক্ষে জনতার দেওয়া ম্যান্ডেট হিসেবে প্রতিভাত হচ্ছিল। এবং এই ম্যান্ডেটের মাধ্যমে এনএলডি সেদেশের সরকার এবং রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর গুরুত্ব বা প্রভাব হ্রাস করার কথা ভাবছিল।
আর ঠিক এমন সময়েই কিনা মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সোমবার (১লা ফেব্রুয়ারি) একটি ক্যু'দেতা বা সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করলো। এবং মিয়ানমারের সদ্য নির্বাচিত সংসদের একটি নির্ধারিত বৈঠকের ঠিক আগে আগে এটা করা হলো।
মিয়ানমার থেকে প্রাপ্ত সংবাদ সূত্রগুলো অনুযায়ী, ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি)-র নেত্রী যিনি কিনা ২০২০-এর নির্বাচনে তাঁর দলের ভূমিধ্বস বিজয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং একইসাথে মিয়ানমারের সদ্য ক্ষমতাচ্যুত সরকারের মূল ব্যক্তি অং সান সু চি বন্দি হয়েছেন। বন্দি হয়েছেন রাষ্ট্রপতি উইন মিন্টও।
সোমবার সকালে সেনাবাহিনী তার নিয়ন্ত্রণাধীন নিজস্ব টেলিভিশনে আগামী এক বছরের জন্য দেশ জুড়ে জরুরি অবস্থা জারি করেছে। মূলত: মিয়ানমারে নব নির্বাচিত সংসদের নিম্ন কক্ষের নির্ধারিত অধিবেশন সূচনার আগে গত এক সপ্তাহ জুড়ে দেশব্যপী নানা গুজব ও পূর্বানুমানের পরপরই সেনাবাহিনী এই অভ্যুত্থান ঘটালো।
উত্তুঙ্গ বেসামরিক ও সামরিক উত্তেজনার ভেতরে এবং জাতিসংনঘের মহাসচিব ও মিয়ানমার-ভিত্তিক বেশ কিছু পশ্চিমা রাষ্ট্রের দূতাবাসের বিবৃতি প্রদানের পর তাতমাদাও বা মিয়ানমার সেনাবাহিনী গত শনিবার এক বিবৃতিতে বলেছিল যে তারা দেশের সংবিধানকে রক্ষা করবে এবং সংবিধানের কথা অনুযায়ীই চলবে।
যে কারণে এই অভ্যুত্থান ঘটলো
সামরিক বাহিনী অবশ্য ২০২০-এর নভেম্বরের নির্বাচন সম্পর্কে অভিযোগ তুলেছিল যে এই নির্বাচন অনিয়মে ভরা এবং কাজেই এনএলডির পক্ষে এই ফলাফল বৈধ নয়। নির্বাচনে মিয়ানমারের জনগণের দেয়া ৯০ লক্ষ ভোটের যথার্থতা বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছে সেদেশের সেনাবাহিনী।
সেনাবাহিনী এর আগে দাবি তুলেছিল যে মিয়ানমারের ঐক্যবদ্ধ নির্বাচন পরিষদ (ইউনাইটেড ইলেকশন্স কমিশন-ইউইসি) বা যে সংস্থা কিনা নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করে অথবা সরকার কিম্বা বিদায়ী সংসদ সদস্যদের ১লা ফেব্রুয়ারি নতুন সংসদ শুরু হবার আগে একটি বিশেষ অধিবেশনে যেন প্রমাণ করে যে নির্বাচন নিরপেক্ষ হয়েছিল। সেনাবাহিনীর এই দাবি প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল।
সেনাবাহিনী প্রধানের বক্তব্য
ইরাবতী নিউজ ওয়েব-সাইটের ভাষ্যমতে, তাতমাদাও বা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক (কমান্ডার-ইন-চীফ) জেনারেল মিন অং হ্লাইং বলেছেন যে দেশের 'সেনাবাহিনীকে সংবিধান মেনে চলতে হবে যেহেতু সংবিধানই হলো দেশে বিদ্যমান সব আইনের জননী।'
সেনাপ্রধান এক ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজের অফিসারদের মিয়ানমারের প্রচলিত সব আইন মেনে চলতে পারেন। তবে, এই আইনগুলোর ভেতরে শুধুমাত্র ২০০৮ সালের সংবিধান মেনে চলে এমন আইনগুলোই গণ্য হবে।
সেনাবাহিনীর সংবিধান
মিয়ানমার সেনাবাহিনীই ২০০৮ সালের সংবিধানের খসড়া রচনা করেছিল এবং সেবছরই এপ্রিল মাসে অনুষ্ঠিত একটি প্রশ্নবিদ্ধ গণভোটের মাধ্যমে সংবিধানটি তারা পাশ করিয়ে নেয়। সূচির নেতৃত্বাধীন এনএলডি ঐ গণভোটে অংশ নেয়নি। এনএলডি ২০১০ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনেও অংশ নেয়। উল্লেখ্য যে ২০১০ সালের নির্বাচন ২০০৮ সালের সেনাবাহিনী প্রণীত সংবিধানের আওতায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
এই সংবিধান ছিল মিয়ানমার সেনাবাহিনীর তথাকথিত গণতন্ত্রের পথে যাত্রার মানচিত্র। একদিক থেকে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর দেয়া অব্যাহত চাপ এবং খানিকটা সেনাবাহিনীর নিজস্ব বোধোদয় যে বহির্বিশ্বের কাছে মিয়ানমারের নিজের রুদ্ধ দ্বার খুলে দেয়া আর শুধুমাত্র কোনো ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয় নয় বরং অর্থনীতির স্বার্থেই খুব জরুরি- এমন দুই কারণেই ২০০৮ সালের সংবিধান প্রণীত হয়। তবে একইসাথে সেনাবাহিনী এই সংবিধানে দেশের সব কর্মকান্ডে নিজস্ব ভূমিকা ও শ্রেষ্ঠত্ব রক্ষার বিষয়টিও নিশ্চিত করেছিল।
মূলত: ২০০৮ সালের সংবিধানের আওতায়ই সেনাবাহিনী মিয়ানমার সংসদের উভয়কক্ষে বাহিনীর সদস্যদের জন্য ২৫ শতাংশ আসন সংরক্ষিত রেখেছিল যেখানে কিনা সেনা সদস্যদেরই মনোনয়ন দেয়া হতো। এছাড়াও সেনাবাহিনীর তাঁবেদার এক রাজনৈতিক দল সেনাবাহিনীর প্রতিনিধি হিসেবেও নির্বাচনে প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে। ২০২০-এর নির্বাচনে এনএলডির বিপুল বিজয়ে সেনাবাহিনীর তাঁবেদার দলটির আসন সংখ্যার হার আরো কমে যায়।
সেনাবাহিনীর অভিযোগ
এক সেনা মুখপাত্রের মতে গত সপ্তাহে তাতমাদাও বা মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাষ্ট্রের সব প্রদেশ ও অঞ্চলের মোট ৩১৪টি নির্দিষ্ট এলাকায় ৮ লক্ষ ৬০ হাজার অনিয়মের অভিযোগ পেয়েছেন। এবং এতেই আভাস মেলে যে মানুষ সেখানে "একবারের বেশি ভোট দিয়েছে' বা অন্য কিছু "ভোট দান সংক্রান্ত অনিয়মে' লিপ্ত হয়েছে।
মিয়ানমারের নির্বাচনী সংস্থা ইউইসি অবশ্য জানায় যে তারা ভোট দানে কোন অনিয়ম বা জুয়াচুরির প্রমাণ পায়নি। সংস্থাটি আরো বলে যে প্রতিটি ভোটই "স্বচ্ছভাবে গণনা করা হয় এবং নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দী প্রার্থী, নির্বাচনী কর্মকর্তা, সংবাদ মাধ্যম, নির্বাচন পর্যবেক্ষক বা নিরীক্ষক এবং বিভিন্ন সুশীল সমাজ সংগঠনের প্রত্যক্ষ উপস্থিতিতেই ভোট দান প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।'
মিয়ানমারের সেনাবাহিনী প্রধান ২০০৮-এর সংবিধানকে কার্যকরী বলেছেন। এই সংবিধানের প্রতিটি অনুচ্ছেদেরই একটি উদ্দেশ্য এবং অর্থ রয়েছে বলে তিনি জানান এবং আরো বলেন যে কারোরই ইচ্ছা খুশি মতো সংবিধানের অনুচ্ছেদগুলোকে ব্যখ্যা করাটা উচিত হবে না।
"কারো নিজস্ব ভাবনা বা ধ্যান-ধারণা অনুযায়ী আইনকে ব্যবহার করাটা কার্যোপযোগী হবার চেয়ে বরং বেশি ক্ষতিকর হতে পারে,' ইরাবতীর সংবাদমাধ্যমে সেনাপ্রধানকে উদ্ধৃত করে এমনটা বলা হয়।
সেনাপ্রধান আরো বলেন যে কিভাবে সেনাবাহিনী অতীতে মিয়ানমারের আরো দু'টো পূর্ববর্তী সংবিধান বাতিল করেছে।
গণতান্ত্রিক রূপান্তরের পথ রুদ্ধ
সেনাপ্রধানের এই বক্তব্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন সহ ইয়াঙ্গুনের পনেরোটি দেশের দূতাবাস ও কূটনৈতিক মিশনগুলোকে একটি যৌথ বিবৃতির মাধ্যমে "নির্বাচনের ফলাফল বদলে দেয়া বা মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক রূপান্তরকে বাধা দেয়া'র বিপক্ষে মত দিয়েছেন।
মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের কাজ অব্যাহত রয়েছে। অতিমারীর ভেতরেই অনুষ্ঠিত ২০২০-এর নির্বাচনের ফলাফলকে এনএলডি দেখেছে সংবিধান সংশোধনে সেদেশের ভোটারদের দেয়া ম্যান্ডেট হিসেবে, যার মাধ্যমে এনএলডি সেদেশের সরকার এবং রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর গুরুত্ব বা প্রভাব হ্রাস করার কথা ভাবছিল। কিন্তু মিয়ানমারের সংবিধানে সংবিধান সংশোধনের বিষয়টি খুবই কঠোর ও দূরূহ একটি প্রক্রিয়া হিসেবে করে রাখা হয়েছে।
তবে ২০১১ সাল পর্যন্ত (যে বছর সু চি কে কুড়ি বছর গৃহান্তরীণ অবস্থার পর মুক্তি দেয়া হয়) মিয়ানমারে যে অবস্থা ছিল, তার থেকে বর্তমান দো-আঁশলা (সেনাবাহিনী ও এনএলডির সংমিশ্রিত সরকার) ব্যবস্থাটি অনেকটা বদলই ছিল বটে এবং গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শম্বুক গতিতে হলেও শুরু হয়েছিল।
সু চি অবশ্য সেনাবাহিনীর সাথে ঢের বেশি আপোষের রাস্তায় হেঁটেছেন যা কিনা তাঁর নিজের সমর্থকেরাও প্রত্যাশা করেনি। এতটাই আপোষ করেছেন যে রোহিঙ্গাদের উপর নৃশংসতার প্রশ্নে আন্তর্জাতিক আদালতে তিনি মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। সত্যি বলতে নির্বাচনের পর সেনাবাহিনীর সাথে তাঁর যা হলো সেটাই সু চি'র দু'দশক ব্যপী গৃহান্তরীণ দশা হতে মুক্তির পর থেকে সেনাবাহিনীর সাথে তাঁর প্রথম মুখোমুখি হওয়া।
- সূত্র: দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস
- মূল লেখক: নিরুপমা সুব্রাম্ম্যনীয়ম
- অনুবাদ: অদিতি ফাল্গুনী