দাম বাড়লেও ভোজ্যতেল শূন্য বাজার!

শুক্রবার সকালে কিছুক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে ঢাকার একটি পাইকারি দোকান থেকে দুই লিটারের রক বোতল সয়াবিন তেল কিনতে পেরে দিনমজুর মাসুদ আলম মহাখুশি।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, "ঈদের ছুটি শেষ করে ঢাকায় এসে বাসায় তেল না থাকায় সারা বাজার খুঁজেও এক লিটার তেল পেলাম না।"
"এখন দুই লিটার কিনতে পেরেছি ১৬০ টাকা লিটার দরে, এতেই খুশি। আগে যেখানে এক সপ্তাহ যেত দুই লিটারে, এখন সেখানে না হয় দুই সপ্তাহ চালাতে হবে", যোগ করেন মাসুদ।
মাসুদ জানতেন, ঈদের আগে থেকেই ভোজ্যতেলের সরবরাহ বন্ধ হয়েছে বাজারে। তবে তিনি যা জানতেন না তা হল, সর্বশেষ দাম বৃদ্ধির কারণেই এটি এখন বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না।
বৃহস্পতিবার সরকার ভোজ্য তেলের দাম বাড়ালেও শুক্রবার পর্যন্ত বাজারে তেল পাওয়া যায়নি।
আরেক ক্রেতা মফিদুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "তেলের দাম এভাবে হুট করে ৩৮ টাকা বেড়ে গিয়েও পুরো বাজার খুঁজে তেল পেলাম না। এখন কি আমাদের তেল ছাড়া তরকারি রান্নার কথা ভাবতে হবে?"
"সবকিছুর দাম বাড়লেও আমাদের বেতন তো বাড়ছে না। এভাবে ঢাকায় থেকে সংসার চালানো সম্ভব হয় কিনা সেটাই প্রশ্ন", যোগ করেন তিনি।
রাজধানীর হোটেল ও রেস্তোরাঁগুলোও দৈনন্দিন ব্যবসা চালাতে হিমশিম খাচ্ছে। তাই খাবারের দাম বাড়ানোর কথা ভাবছে তারা।
বসুন্ধরা শপিং সেন্টারে কর্মরত প্রায় ৪০০ কর্মচারীর খাবার রান্না করে স্বল্প মূল্যে সরবরাহ করেন আব্দুস সবুর। শুক্রবার রাতের রান্নার তেল কিনতে শুক্রবার বিকালেই কারওয়ান বাজারে যান তিনি। খুচরা দোকানগুলোর কোনো দোকানেই সয়াবিন তেল না পেয়ে তিনি পাইকারি মার্কেটের ডিলারের কাছে তেল কিনতে যান। তবে সেখানেও প্রায় এক ঘন্টা অপেক্ষা করে মাত্র ৪ লিটার সয়াবিন তেল কিনতে পারেন সবুর।
আব্দুস সবুর টিবিএসকে বলেন, "আমাদের প্রতিদিন তিন বেলাতেই প্রায় ৪০০ জন মানুষের জন্য রান্না করতে হয় সেখানে মাত্র ৪ লিটার তেল দিয়ে কি হবে?"
"কারওয়ানবাজারসহ আশপাশের কোনো বাজারেই সয়াবিন তেল পাইনি। এখানে এসে একমাত্র পুষ্টি সয়াবিন তেলের ডিলার আঁখি এন্টারপ্রাইজ থেকে ১৬০ টাকা দরে ৪ লিটার তেল কিনতে পারলাম। অন্যকোনো ডিলারের কাছেও সয়াবিন তেল নেই। তেলের দাম বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বাজার থেকে তেল উধাও!"
তবে সাংবাদিকদের উপস্থিতি টের পাওয়ার পরেই ১৬০ টাকা লিটার দরে তেল বিক্রি করেছে আঁখি এন্টারপ্রাইজ, অন্যথায় আরও বেশি দামে ডিলাররা তেল বিক্রি করেন বলেও অভিযোগ করেন বেশ কয়েকজন ক্রেতা।
শুধু আব্দুস সবুর নন, তেল কিনতে গিয়ে এমন অভিজ্ঞতার শিকার হচ্ছেন অধিকাংশই। যেসব দোকানে সয়াবিন তেল পাওয়া যাচ্ছে সেখানেও রাখা হচ্ছে বাড়তি দাম।
ঈদের আগে থেকেই দেশের বাজারে সয়াবিন তেলের সংকট চলছে। বৃহস্পতিবার সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ৩৮ টাকা বাড়িয়ে ১৯৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এখন থেকে বোতলজাত প্রতি লিটার সয়াবিন তেল খুচরা পর্যায়ে বিক্রি হবে ১৯৮ টাকায়। আর ৫ লিটারের বোতলের দাম হবে ৯৮৫ টাকা। এছাড়া, খোলা সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১৮০ টাকা এবং খোলা পাম তেল প্রতি লিটার ১৭২ টাকায় বিক্রির দাম নির্ধারণ হয়েছে। সয়াবিন তেলের বাড়তি দাম নির্ধারণের পরেও রাজধানীর অধিকাংশ বাজারই ভোজ্য তেলশূণ্য।
শুক্রবার রাজধানীর কারওয়ান বাজার, বাংলামোটর, ফার্মগেট, আগারগাঁও, শেওড়াপাড়া, আগারগাঁও তালতলা বাজারের অন্তত ৪০ টি খুচরা ও পাইকারি দোকান ঘুরে দেখা যায়, একমাত্র একটি পাইকারি ডিলার ছাড়া সবাই বলছেন কারও দোকানে সয়াবিন তেল নেই। এছাড়া, কারওয়ানবাজারের একটি খুচরা দোকানে এক লিটারের তেলের বোতল ২২০ টাকা মূল্যে বিক্রি হচ্ছে; তাও পরিচিত ক্রেতা ব্যতীত কাউকে দিচ্ছে না তারা।
কারওয়ান বাজারের তেলের ডিলার আঁখি এন্টারপ্রাইজে কেবল পুষ্টি সয়াবিন তেল এবং খোলা তেল রয়েছে। তবে যা রয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম বলে জানায় সিদ্দিক এন্টারপ্রাইজের সিদ্দিক হোসেন।
সিদ্দিক হোসেন টিবিএসকে বলেন, "আমাদের এ মার্কেটে আমরা ৬/৭ জন রয়েছি তেলের ডিলার। কিন্তু ঈদের আগ থেকেই বাজারে তেলের সংকট।"
"আমার এখান থেকে প্রতিদিন ২ হাজার কার্টুনের বেশি তেল খুচরা দোকানে যায়, কিন্তু সেখানে শুক্রবার তেল এসেছে মাত্র ২০০ কার্টুন। অন্য ডিলাররা তেল দিতে পারছে না বলে সবাই দোকান বন্ধ করে রাখছে। আমি দোকানে সরবরাহ তো করতেই পারছি না খুচরা যারা আসছেন তাদের দুই লিটারের বেশি দিতে পারছি না", যোগ করেন সিদ্দিক।
তবে তিনি খোলা সয়াবিন তেলের কেজিও ২০০ টাকা করে বিক্রি করছেন, আর পাম তেল বিক্রি করছেন ১৯৮ টাকা কেজিতে। দাম বাড়ার পরে নতুন তেল আসেনি তার দোকানে, এরপরেও তিনি খোলা তেল বিক্রি করছেন বাড়তি দামে।
এ বিষয়ে তিনি টিবিএসকে বলেন, "বাজারে নতুন তেল আসতে আরও ২/৩ দিন লাগতে পারে, কিন্তু খোলা তেল তো আর লেবেল করা নেই তাই খোলাটা নতুন দামেই বিক্রি করছি।"
পাইকারি তেল বিক্রেতা সোনালী ট্রেডার্সের শরিফুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "ঈদের আগ থেকেই তেল পাই না। কোনো ডিলারই বাজারে তেল দিচ্ছে না। এখন দাম বেড়েছে, হয়তো ২/৩ দিন পরে নতুন তেল পাবো।"
কারওয়ান বাজারের খুচরা হাজী মিজান এন্টারপ্রাইজের বিক্রেতা মো. মাকসুদ টিবিএসকে বলেন, "বাজারে ঈদের আগ থেকেই তেলের সংকট। আমার এখানে আগের তেল (১৬০ টাকা লিটার) কিছু আছে সেগুলো ২২০ করে বিক্রি করছি, তাও নিয়মিত গ্রাহকদের দিচ্ছি।"
কেনো বাড়তি দাম নিচ্ছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "বাজারে তেলই নেই সেখানে এ দামে পাচ্ছে এটাই বেশি। আমাদেরই বেশি দামে কিনে রাখতে হয়েছে।"
জব্বার স্টোরের আজিজুল টিবিএসকে বলেন, "সকাল ১১ টার দিকে প্রতি দোকানে ১৬০ টাকা লিটারের ৩ কার্টুন করে তেল দিয়েছিল তা ২ মিনিটের মধ্যে বিক্রি হয়ে গেছে।"
মায়ের দোয়া স্টোরের রকি বলেন, "ঈদের আগ থেকেই তেল নেই বাজারে। কোনো কোম্পানিই এখন বাজারে তেল দিচ্ছে না। পাইকারি বাজার থেকে কিনে এনেও ক্রেতাদের তেল দিতে পারছি না।"
আগারগাঁও তালতলা বাজারের ভাই ভাই জেনারেল স্টোরের মো. ইয়াসিন টিবিএসকে বলেন, "গত এক সপ্তাহ ধরেই বাজারে তেল নেই। ঈদের বাজারে কোনো তেলই বিক্রি করতে পারিনি। ঈদের পর আজ দোকান খুললাম, কাল হয়তো কোম্পানি তেল দিতে পারে।"
ঈদের এক সপ্তাহ আগে থেকেই দেশের বাজারে সয়াবিন তেলের সংকট চলছে। কিন্তু ঈদের পর পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। বৃহস্পতিবার দাম বাড়ার পরও রাজধানীর বেশির ভাগ বাজারেই তেলের মজুদ শেষ।
বৃহস্পতিবার সরকার এক লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ২৩.৭৫ শতাংশ বাড়িয়ে ১৯৮ টাকা নির্ধারণ করেছে, যা আগে ছিল ১৬০ টাকা।
নতুন মূল্য অনুযায়ী, সয়াবিন তেলের ৫ লিটারের একটি বোতলের দাম পড়বে ৯৮৫ টাকা, যা আগে ছিল ৭৬০ টাকা।
দাম বাড়ছে হোটেল রেস্টুরেন্টের খাবারের
এদিকে তেল সংকট ও দাম বৃদ্ধিতে রাজধানীর রেস্টুরেন্টগুলোও হিমশিম খাচ্ছে তাদের ব্যবসা নিয়ে। অনেকেই খাবারের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে ভাবছেন, আবার কেউ কেউ ভাবছেন খাবারের পরিমান কমানোর বিষয়ে।
কারওয়ান বাজারের চারুলতা রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার সুজন খান টিবিএসকে বলেন, "আমাদের প্রতিদিন প্রায় ৩০ লিটার তেল লাগে। ঈদের আগে যা কেনা ছিল সেটা দিয়েই শুক্রবারে কাজ চালাবো। তবে সামনে কিনতে গিয়ে দাম বেড়ে গেলে আমাদের রেট বাড়ানো লাগতে পারে।"
"আমরা চাইলেই তো হুট করে দাম বাড়াতে পারি না। সবার সাথে সমন্বয় করেই বাড়াতে হবে। গত এক বছরে আমরা কোনো খাবারের দাম বাড়াইনি বরং সবকিছুরই দাম বেড়েছে", যোগ করেন সুজন।
বাংলামোটরে আল-রহমান রেস্তোরাঁর ম্যানেজার শাকিল আহমেদ টিবিএসকে বলেন, "আমাদের প্রতিদিন ২০ লিটারের মতো তেল লাগে। গতকাল অনেক দোকান ঘুরে ১৯৫ টাকা কেজি দরে সুপার তেল কিনেছি। আজকে বাজারে কোনো তেল পাচ্ছি না। গতকাল যা কেনা ছিল তা দিয়েই চলছি। ভাবছি কালকে তেল না পেলে রেস্টুরেন্টই বন্ধ রাখতে হবে।"
খাবারের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে তিনি বলেন, "এখন তো বাজারে সবকিছুরই দাম বেড়েছে। গত কয়েকমাস আগে খাবারের দাম বাড়িয়েছি, তবে এখন দাম না বাড়িয়ে পরিমানে কমানোর বিষয়টি ভাবছি।"