পাকিস্তানের অর্থনীতির দুর্দশার নেপথ্যে

আকারে ও জনসংখ্যায় দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহৎ রাষ্ট্র পাকিস্তানের অর্থনৈতিক দূরাবস্থা চরমে। দিন দিন পতনের মুখে এগিয়ে চলেছে দেশটির অর্থনীতি।
বেলগ্রেডে অবস্থিত পাকিস্তান দূতাবাসের এক কর্মকর্তা লিখেছেন, নাভিশ্বাস ওঠানো মূল্যস্ফীতি চলমান থাকলেও গত তিন মাস সরকারি কর্মচারীরা কোনো বেতন পাননি। এটাই প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের প্রতিশ্রুত 'নয়া পাকিস্তান' কিনা! ব্যঙ্গভরে এমন প্রশ্ন রাখেন তিনি। তবে এ টুইটকে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলে জানিয়েছে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
ভিত্তিহীন হলেও- পাকিস্তানের অর্থনীতির দশা আসলেই শনির কবলে। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশটির অর্থনীতি ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে বলে আভাস দেওয়া হয়েছে। এই অর্জন হলে- তা হবে গত ৪ বছরের ভেতর সর্বোচ্চ। কিন্তু, একইসময়ে মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি এবং বিপুল অর্থ পরিশোধের ঘাটতি পাকিস্তানকে আরো অন্ধকার কোণে ঠেলে দিচ্ছে। সরকারি ব্যয় নির্বাহ করতে এখন বিদেশি ঋণ সহায়তাই শেষ ভরসা।
দীর্ঘদিন ধরেই সামস্টিক অর্থনীতির নানান রকম সংকট মোকাবিলা করছে পাকিস্তান: লাগামহীন মূল্যস্ফীতি, চলতি হিসাব ও বাণিজ্য ঘাটতি, প্রায় তলানিতে ঠেকা বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ এবং মুদ্রার অবমূল্যায়ন। এবার সব সংকট একসাথে মোকাবিলায় প্রাণান্তকর দশা কর্তৃপক্ষের। ত্রাহিমাম দশা জনতার।
বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের কথাই বলা যাক। গত বৃহস্পতিবার স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের (এসবিপি) প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, গত ২৬ নভেম্বর নাগাদ রিজার্ভ ছিল ১ হাজার ৬১০ কোটি ডলার। যা এক সপ্তাহে কমেছে ২৪৪ মিলিয়ন ডলার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকটি এর কোনো ব্যাখ্যা না দিলেও বিশেষজ্ঞদের ধারণা, বিদেশি ঋণের সুদ মেটাতেই এই অবনতি।
রিজার্ভের পতন স্পষ্ট হয় আরো কিছু তথ্যে। যেমন গত ১৯ নভেম্বরে সমাপ্ত সপ্তাহে পাকিস্তানের মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ২ হাজার ২৭৭ কোটি ডলার। এরমধ্যে এসবিপির কাছে ছিল ১ হাজার ৬২৫ কোটি ডলার। বৈদেশিক মুদ্রার বাকি অংশ ছিল বাণিজ্যিক ব্যাংকের হাতে। ১৯ নভেম্বরের আগে পুরো সপ্তাহে এসবিপির রিজার্ভ কমেছিল ৬৯ কোটি ১০ লাখ ডলার।
অপরদিকে, সময়ের সাথে যেন পাল্লা দিয়ে কমছে অর্থনীতির উৎপাদনশীলতা। বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুসারে, ২০১৮ সালে দেশটির মোট দেশজ উৎপাদন প্রবৃদ্ধি ছিল ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। একবছর পরই যা দশমিক ৯৯ শতাংশ হ্রাস পায়। ২০২০ সালে তা আরো দশমিক ৫৩ শতাংশ কমেছে।
দেশজ উৎপাদন কমার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে আমদানি নির্ভরশীলতা। ফলে বৈদেশিক বাণিজ্যের চলতি হিসাবের ব্যালেন্সে আঁতকে ওঠার মতো ঘাটতি এখন নয়া-স্বাভাবিকতা। চলতি হিসাব একটি দেশের আমদানির ব্যয়ের সাথে রপ্তানি আয় ব্যবধানের নির্দেশক। তবে নির্দিষ্ট মেয়াদে পাওয়া বৈদেশিক সহায়তাও এর আওতায় আসে।
এ হিসাবের ব্যালেন্সে টানা ঘাটতি লেগে থাকলে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় বাজারে স্থানীয় মুদ্রার অতিরিক্ত সরবরাহ তৈরি হয়। যা শেষমেশ মুদ্রার মানে ঋণাত্মক প্রভাব ফেলে। ঠিক একারণেই মূল্যপতনের ঘূর্ণাবর্তে পড়েছে পাকিস্তানী রুপি।
আইএমএফ এর দেউলিয়াত্ব প্যাকেজ:
প্রবৃদ্ধির পতন এবং বিপুল দেনা পরিশোধের পাহাড়সম চাপের মুখে; অতীতের মতোই আবারো ব্যাল্যান্স অব পেমেন্ট সংকটে পড়ে পাকিস্তান। আমদানি বিল এবং বৈদেশিক ঋণ মেটানোর যথেষ্ট অর্থ না থাকায় এ সংকটের সূত্রপাত।
তার ওপর মূল কিছু ভোগ্যপণ্য আমদানির মাধ্যমে স্থানীয় চাহিদাপূরণের নির্ভরশীলতা থাকায় সরকার পড়ে বিপাকে। তার সঙ্গে দেনা পরিশোধের অঙ্গীকারের ভার তো রয়েছেই।
এ অবস্থায় দেউলিয়াত্ব এড়াতে ২০১৯ সালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে বেইলআউট প্যাকেজের আওতায় ৬০০ কোটি ডলারের ঋণ চায় পাকিস্তান সরকার। গত চার দশকে দেশটি এভাবে ৬ বার বেইলআউট প্যাকেজের সহায়তা নিয়েছে।
ঋণের শর্ত হিসেবে অর্থনীতি সংস্কার ও সরকারি দেনা কমানোর প্রতিশ্রুতিও দেয় ইসলামাবাদ। তবে সেসব অঙ্গীকার পূরণে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি না দেখে, চলতি বছরের শুরুতে প্যাকেজের অর্থ ছাড়করণ বন্ধ করে আইএমএফ। এরপর গত ২২ নভেম্বর এক আলোচনায় একটি সমঝোতা হয়েছে।
বৈঠক শেষে সেদিন দেওয়া বিবৃতিতে আইএমএফ বলেছে, 'পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষের সাথে আইএমএফ এর কর্মকর্তা পর্যায়ের বৈঠকে নীতি ও সংস্কার নিয়ে ষষ্ঠ দফা পর্যালোচনার সিদ্ধান্ত হয়েছে।'
এই পর্যালোচনা শেষ হলেই মূল ঋণের আরো ৭৫ কোটি ডলার পাবে পাকিস্তান। ফলে এপর্যন্ত পাওয়া মোট ঋণ দাঁড়াবে ৩০০ কোটি ডলারে।
অবস্থা এতটাই শোচনীয় যে, আইএমএফ এর সাথে সমঝোতার খবর প্রকাশ হলে- পাকিস্তানের সরকারি বন্ডের মূল্য ১ ডলার ৩ সেন্ট - ২ ডলার ৮ সেন্ট পর্যন্ত বাড়ে। বার্তাসংস্থা রয়টার্সের তথ্যানুসারে, যা ছিল এক বছরের মধ্যে বন্ড মূল্যের সবচেয়ে সুদিন।
সৌদি আরবের সাথে ঋণচুক্তি:
২০১৮ সালের নভেম্বরে সৌদি আরবের সাথে ৩০০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি করে পাকিস্তান। ইতোমধ্যেই এ ঋণের ১০০ কোটি ডলার ছাড় করেছে সৌদি সরকার।
চুক্তি অনুসারে ৩০০ কোটি ডলার এক বছরের জন্য এসবিপি'র সেফ ডিপোজিটে রাখতে সম্মত হয় সৌদি সরকার।
তবে জ্বালানি তেলের বকেয়া মূল্য শোধে ১২০ কোটি ডলার, ৩০০ কোটি ডলার ডিপোজিট এবং জ্বালানি কিনতে ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের ৮০ কোটি ডলার অর্থায়নসহ পাকিস্তান মোট ৭০০ কোটি ডলার ঋণ পাওয়ার লক্ষ্য নিয়েছিল।
মার্কিন ডলারের বাড়তি এই সরবরাহ ব্যাল্যান্স অব পেমেন্ট সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য যথেষ্ট হবে বলে আশাপ্রকাশ করেছিলেন পাকিস্তানী কর্মকর্তারা।
তবে অত্যন্ত কড়া শর্তে- প্রায় ৪ শতাংশের মতো উচ্চসুদে ঋণ দেয় সৌদি আরব। চুক্তির শর্ত ছিল সম্পূর্ণ কতৃত্ববাদী; যার অধীনে সৌদি দাবির বিপক্ষে কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগও পাকিস্তানকে দেওয়া হয়নি।
মূল্যস্ফীতির জোয়ার:
একদিকে রুপির দরপতন, আরেকদিকে আমদানি ব্যয় মেটাতে তহবিল ঘাটতি। দুইয়ে মিলে চরমে নিত্যপণ্যের দাম। প্রতিনিয়ত তাই নতুন রেকর্ড গড়ছে মূল্যস্ফীতি। সংবাদের শিরোনাম জুড়ে শুধু জনমানুষের ভোগান্তির খবর। অক্টোবরের ৯ দশমিক ২ শতাংশ থেকে গেল নভেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ১১ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত হয়।
এই চাপ কোনোভাবেই সামলে উঠতে পারছে না ইমরান খানের সরকার। সরকার গণ-আন্দোলনের ঝুঁকি নিয়েও শঙ্কিত।
২০১৯ সালের মাঝামাঝি পাকিস্তানের খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কে পৌঁছায়, ২০২০ সালের জানুয়ারিতে তা আরো বেড়ে হয় ২৩ দশমিক ৬ শতাংশ। এরপর জুলাইয়ে কিছুটা কমে ১৭ দশমিক ৮ শতাংশ এবং ২০২১ সালের এপ্রিলে হয়েছে ১৫ দশমিক ৯ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, গেল নভেম্বরে ফের দুই ডিজিটে পৌঁছে মূল্যস্ফীতি নতুন শক্তিতে আঘাত করেছে পাকিস্তানীদের ক্রয় ক্ষমতায়।
পাকিস্তানের ভোক্তা সমিতির চেয়ারপার্সন কাউকাব ইকবাল বলেছেন, 'খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি হচ্ছে ব্যাপক আকারে। বিশেষত- টাটকা ফল, দুধ ও মুরগীর মতো পণ্যের দাম বেড়ে চলায় সর্বস্তরের মানুষের জীবনমান ও পুষ্টি চাহিদা পূরণ ব্যাহত হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি কষ্টে আছেন দরিদ্ররা। মূল্যের চাপে অনেক আগেই তাদের নাগালের বাইরে চলে গেছে আমিষ ও ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার।'
বিশ্ববাজারের পরিস্থিতিও পাকিস্তানকে চাপে রেখেছে। মূল্যস্ফীতির চাপ কমবেশি সব দেশেই ভোক্তাদের ওপর পড়েছে। জ্বালানির চড়া দামও ফেলছে নেতিবাচক ভূমিকা। আন্তর্জাতিক বাজারে নিত্যপণ্যের মূল্য অস্থিতিশীলতার অর্থ, পাকিস্তানের ক্ষয়িষ্ণু রিজার্ভের ওপর আরেকদফা মরণ কামড়।
সরকার দিশেহারা। নীতি সহায়তায় একদিক সামাল দিলে, দেখা দিচ্ছে আরেকদিকে বেসামাল অবস্থা।
যেমন- স্থানীয় বাজারে চিনি ও আটার দাম কমাতে আখ ও গম চাষে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে উচ্চমূল্যের পণ্য উৎপাদন নিরুৎসাহিত করা হয়। যার বিরূপ প্রভাব পড়ে দুধ ও দুগ্ধজাত এবং তুলা উৎপাদনে। তাই বিপুল পশুসম্পদ থাকার পরও ডেইরি পণ্যের চাহিদা মেটাতে এখন আমদানি নির্ভর হয়ে পড়েছে দেশটি। স্থানীয় পোশাক শিল্পের চাহিদা মেটাতে উচ্চদামে তুলাও কিনতে হচ্ছে।
যেকারণে গেল সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে পাকিস্তানের চলতি হিসাবের ঘাটতি পূর্বানুমানের চেয়ে অনেক বেশি হয়েছে।
দেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মূল্য পরিশোধের এই চাপ পড়ছে রুপির ওপর। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতিতে তাই এখন প্রবৃদ্ধি অর্জনের চেয়ে, মূল্যস্ফীতি মোকাবিলাকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে।
আশার আলো নেই নিকট ভবিষ্যতেও:
পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর রেজা বাকির ২০২১-২২ অর্থবছরে ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির আশাপ্রকাশ করলেও, বৈশ্বিক সংস্থাগুলো তার সাথে একমত নয়।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ও রেটিং সংস্থা- ফিচ সলিউশন্স ৪ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির আভাস দিয়েছে। এমনকি খোদ পাকিস্তান সরকারও ৪ দশমিক ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির অনুমান করছে।
অর্থাৎ, আগামীদিনেও থাকবে কম উৎপাদনশীলতার সংকট। যা ইসলামাবাদের চলতি হিসাবের ঘাটতিকে দিতে পারে নতুনমাত্রা। মহামারিকালে দরিদ্র ও সীমিত আয়ের পাকিস্তানীদের জীবন-জীবিকা তছনছ করে দিতেই থাকবে এই পরিস্থিতি। যার আশু সমাধানের লক্ষণও আপাতত দেখা যাচ্ছে না।
- সূত্র: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, দ্য ডন, দ্য ট্রিবিউন