বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগকারীদের জন্য নতুন সংকট ব্যাংক গ্যারান্টি

চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেপজা) অর্থনৈতিক অঞ্চলে (ইজেড) চীন-ভিত্তিক তিনটি কারখানা এখন পণ্য রপ্তানি করছে। তবে এসব প্রতিষ্ঠানের আমদানি করা কাঁচামাল খালাস নিতে চট্টগ্রাম কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটে দিতে হচ্ছে ব্যাংক গ্যারান্টি। কাস্টম বন্ড কমিশনারেটের নতুন এই নিয়মে জটিলতার মুখে পড়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো।
দেশের অন্যান্য ইপিজেডে রপ্তানিমুখী কারখানাগুলোর কাঁচামাল আমদানিতে ব্যাংক গ্যারান্টি নেওয়ার এমন নিয়ম নেই। নতুন চালু হওয়া এই অর্থনৈতিক অঞ্চলে ব্যাংক গ্যারান্টির এ নিয়ম তাদেরকে নতুন করে সংকটে ফেলে দিয়েছে বলে জানান বিনিয়োগকারীরা। এতে করে পণ্য খালাসে বিলম্ব হওয়ার পাশাপাশি অতিরিক্ত টাকা গুনতে হচ্ছে তাদের।
বেপজার তথ্য মতে, চীনের বিনিয়োগকারী কাইজি লিঙ্গারি বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেড, ফেংকুন কম্পোজিট ম্যাটেরিয়াল কোম্পানি (বাংলাদেশ) লিমিটেড এবং কেপিএসটি শু'স (বাংলাদেশ) কোম্পানি লিমিটেড উৎপাদন ও রপ্তানি কার্যক্রম পরিচালনা করছে। গত বছরের নভেম্বর থেকে এই অর্থনৈতিক অঞ্চলে তাদের রপ্তানি কার্যক্রম শুরু হয়।
বেপজার তথ্য অনুযায়ী, আমদানি করা কাঁচামাল খালাস করতে গিয়ে চট্টগ্রাম কাস্টম বন্ড কমিশনারেটে তিন প্রতিষ্ঠান ১৫টি চালানে ২ কোটি ৫৫ লাখ ১৩ হাজার ৩৫০ টাকা ব্যাংক গ্যারান্টি দিয়েছে। এরমধ্যে কেপিএসটি শু'স (বাংলাদেশ) কোম্পানি লিমিটেড ৬টি চালানে দিয়েছে ৮২ লাখ ৩০ হাজার ৭৪১ টাকা, ফেংকুন কম্পোজিট ম্যাটেরিয়াল কোম্পানি (বাংলাদেশ) লিমিটেড ৬টি চালানে ৭৪ লাখ ২১ হাজার ২৩ টাকা এবং কাইজি লিঙ্গারি বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেড ৩টি চালানে ব্যাংক গ্যারান্টি দিয়েছে ৯৮ লাখ ৬১ হাজার ৫৮৬ টাকা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগরে বিনিয়োগকারীরা জানিয়েছেন— ডলার সংকট, ডলারের মূল্য বৃদ্ধি, বৈশ্বিক বাণিজ্য মন্দার প্রভাবে ইতোমধ্যেই আর্থিক ক্ষতির মুখে রয়েছেন তারা। শ্রমিকের আবাসান সুবিধা গড়ে না ওঠায় মাইকিং করেও শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। এরমধ্যে রয়েছে পানি, অন্যান্য ইউটিলিটি, বিভিন্ন জোনের সংযোগ সড়ক না হওয়া, সেন্ট্রাল ইটিপিসহ নানান সংকট। এসব সংকটের মধ্যে বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চলে কাঁচামাল খালাসে এমন জটিলতা এই সংকটকে আরও জটিল করে তুলছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, "নানান সংকটের পরও আমরা কারখানা নির্মাণ শেষে ইতোমধ্যে উৎপাদন শুরু করেছি। যেখানে ৪,০০০ শ্রমিকের চাহিদা থাকলেও পেয়েছি মাত্র ১,০০০। শ্রমিক সংকটের কারণে পুরোদমে উৎপাদনে যেতে পারছিনা। যে কারণে লোকসানে কারখানা চালাতে হচ্ছে। এরমধ্যে ব্যাংক গ্যারান্টি জটিলতা আমাদের জন্য চরম অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।"
"ব্যাংক গ্যারান্টি জটিলতায় বন্দর থেকে পণ্য খালাস করতে বিলম্ব হওয়ায় উৎপাদন শুরু করতেও বিলম্ব হয়েছে। এতে সার্বিকভাবে বিদেশি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানসমূহকে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে," বলেন তিনি।
বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চলের প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ আনামুল হক টিবিএসকে বলেন, "এই অর্থনৈতিক অঞ্চলের প্রতিষ্ঠানগুলোর গ্যারান্টার বেপজা। সিকিউরিটি মানি দিয়েই প্রতিষ্ঠানগুলো বেপজা ইকোনোমিক জোনে বিনিয়োগ করেছে। সেখানে কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক বিভাগের ব্যাংক গ্যরান্টি নেওয়া, অহেতুক ঝামেলা সৃষ্টি করা ছাড়া আর কিছুই নয়।"
তিনি বলেন, "শত শত কোটি টাকা বিনিয়োগ করে এসব প্রতিষ্ঠান শুল্ক ফাঁকি দেবে কাস্টমসের এমন চিন্তা অযৌক্তিক। আমি বিষয়টি নিয়ে একাধিকবার কাস্টমসের সাথে কথা বলেছি। বিনিয়োগকারীরা যাতে নিরুৎসাহিত না হয়, সেজন্য এই নিয়মটি অবশ্যই তুলে দেওয়া উচিত।"
এদিকে, কাঁচামাল আমদানিতে ব্যাংক গ্যারান্টির এমন নিয়মের বাতিল চেয়ে বেপজা ইকোনোমিক জোনের উৎপাদনে থাকা তিনটি প্রতিষ্ঠান, বেপজাসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে চিঠি দিয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে অর্থনৈতিক অঞ্চলে প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ড সুবিধায় (শুল্ক মুক্ত সুবিধায়) আমদানি করলেও কী কারণে ব্যাংক গ্যারান্টি দিতে হয়েছে, বেপজার কাছে এই তথ্য জানতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
এনবিআরের দ্বিতীয় সচিব (কাস্টমস: রপ্তানি ও বন্ড শাখা) এইচ এম আহসানুল কবীর সম্প্রতি বেপজার নির্বাহী পরিচালক (এন্টারপ্রাইজ সার্ভিস) বরাবর চিঠি দিয়েছেন।
বেপজার নির্বাহী পরিচালক (এন্টারপ্রাইজ সার্ভিস) মো. খোরশেদ আলম টিবিএসকে বলেন, "বেপজা ইকোনোমিক জোনে উৎপাদনে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংক গ্যারান্টি দিয়ে মাল খালাসে অসুবিধার কথা আমাদের লিখিতভাবে জানিয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমরা এনবিআরকে জানিয়েছি, বিনিয়োগকারীদের যাতে অসুবিধা না হয়, সেজন্য এই নিয়মটি যেন বাতিল করা হয়। আমরা কারাখানা মালিকদের থেকে তথ্য নিয়ে আগামী সপ্তাহে এ বিষয়ে এনবিআরকে জানাবো।"
"যেহেতু এই নিয়ম অন্য কোনো ইপিজেডে নেই এবং এখানে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যাতে আগ্রহ না হারিয়ে ফেলে, সেজন্য এনবিআর কারখানা মালিকদের এই দাবি বিবেচনা করবে বলে আমাদের প্রত্যাশা," যোগ করেন তিনি।
শতভাগ রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানগুলো কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক মুক্ত সুবিধা (বন্ড সুবিধা) পান। এই সুবিধায় পণ্য আমদানিতে কোনো শুল্ক দিতে হয় না। আমদানিকরা কাঁচামাল দিয়ে পণ্য তৈরি করে সেগুলো পুনরায় রপ্তানি করে। প্রতিষ্ঠানগুলোর পণ্য উৎপাদনের ধরন, সম্ভাব্য কাঁচামাল, পরিমাণ নির্ধারণ করে কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট এইচএস কোড উল্লেখ করে প্রাপ্যতা নির্ধারণ করে।
তবে কাস্টমস কর্তৃপক্ষও জানিয়েছে, অন্য ইপিজেডে এ ধরনের ব্যাংক গ্যারান্টি নেওয়া হয়না। কারণ সেখানে বন্ড কমিশনারেটের দপ্তর বা নজরদারি রয়েছে। মিরসরাইয়ে বন্ড কমিশনারেটের কোনো দপ্তর এবং নজরদারি না থাকায় ব্যাংক গ্যারান্টি নেওয়া হচ্ছে।
চট্টগ্রাম কাস্টম বন্ড কমিশনারেটের জয়েন্ট কমিশনার মিজানুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "বেপজা ইকোনোমিক জোনে এখনো কাস্টমস কর্মকর্তাদের অফিস বসানোর মতো পরিস্থিতি হয়নি। ফলে আমদানিকৃত কাঁচামালগুলো খোলা বাজারে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে কিনা তা নজরদারীর মধ্যে আনা সম্ভব নয়। সে কারণে আমদানি করা কাঁচামালের বিপরীতে যে পরিমাণ শুল্ক আসে, সেই পরিমাণ টাকা ব্যাংক গ্যারান্টি নেওয়া হয়েছে।"
সেখানে কাস্টমস কর্মকর্তাদের অফিস সেটআপ হয়ে গেলে এই শঙ্কা আর থাকবে না বলে জানান তিনি।
বেপজার তথ্য অনুযায়ী, বেপজা ইকোনোমিক জোনে বিনিয়োগ এবং কারখানা নির্মাণের জন্য এখন পর্যন্ত ৩০টি প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি হয়েছে। এরমধ্যে ২টি দেশীয় এবং বাকি ২৮টি বিদেশি প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠান প্রায় ৭০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে। ইতোমধ্যে ৩টি প্রতিষ্ঠান উৎপাদন শুরু এবং রপ্তানি কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
৯টি প্রতিষ্ঠানে কারখানা নির্মাণ কাজ চলছে। ১১টি প্রতিষ্ঠান কারখানা নির্মাণের জন্য ড্রইং ডিজাইন প্রস্তুত করছে। শীঘ্রই নির্মাণ কাজ শুরু হবে। এই ৩০টি কারখানায় ২ লক্ষাধিক শ্রমিকের কর্মংস্থান হবে।
বেজার তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামের মিরসরাই, সীতাকুণ্ড, এবং ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার ৫০ হাজার একরজুড়ে গড়ে উঠছে দেশের বৃহৎ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর। এই শিল্পনগরে এখন পর্য়ন্ত অনুমোদিত বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ১৫২টি। যাদেরকে ৫ হাজার ২৫১ একরের বেশি জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ১,২৩০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হয়েছে সেখানে। বাকি প্রস্তাবিত বিনিয়োগ ১৮,৫৫৭ মিলিয়ন ডলার এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রস্তাবিত কর্মসংস্থান ৭,৭৫,২২৮টি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগরের মধ্যে গড়ে উঠছে বেজপা ইকোনোমিক জোন। অঞ্চলটি ৫৩৯টি শিল্প প্লটসহ ১,১৩৮.৫৫ একর জায়গা নিয়ে বিস্তৃত। আশা করা হচ্ছে, বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগসহ প্রায় ২.৭০ বিলিয়ন ডলার এখানে বিনিয়োগ হবে।
বেপজা ইকোনোমিক জোনের তিনটি কারখানা এবং শিল্প নগরে বিভিন্ন শিল্প গ্রুপের ছয়টি কারখানাসহ মোট ৯টি কারখানায় বর্তমানে কাজ করছে প্রায় দুই হাজার শ্রমিক।