আইএমএফের শর্ত বাস্তবায়নের ফলে বৈষম্য বাড়তে পারে: দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এর শর্ত বাস্তবায়ন করতে যেয়ে নানা পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে বৈষম্য বাড়তে পারে। সোমবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বিশ্লেষকরা এ কথা বলেন।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের(সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য বলেন, "আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল(আইএমএফ) যেসব দেশে কর্মসূচি নিয়েছে অর্থাৎ যেসব দেশ আইএমএফের শর্ত মেনে ঋণ নিয়েছে, সেইসব দেশে বৈষম্য বেড়েছে। বাংলাদেশে যখন স্বাভাবিকভাবেই সার্বিক বৈষম্য বাড়ছে, সেই সময় আইএমএফ কর্মসূচি নিয়েছে। ফলে বাংলাদেশে বৈষম্য বাড়ার ঝুঁকি রয়েছে।"
সিপিডি ও নাগরিক প্লাটফর্ম আয়োজিত 'আইএমএফের সময়কালে অসুবিধাগ্রস্ত মানুষের কথা জাতীয় বাজেটে কীভাবে প্রতিফলিত হতে পারে?' শীর্ষক সংলাপের মূল প্রবন্ধে তিনি এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, "আইএমএফের কর্মসূচি বাস্তবায়নে যে উদ্যোগ নেওয়া হবে সেগুলো খুব সতর্কভাবে নিতে হবে। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট খাতের লোকদের মতামত নিতে হবে। নতুবা বাংলাদেশ আরও বৈষম্যপূর্ণ দেশে পরিণত হবে।"
পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরতার প্রেক্ষিত কতটা সংস্কার করা যাবে তা নিয়ে তিনি সংশয় প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, "আইএমএফ কৃচ্ছ্রসাধনের পক্ষে। এতে সরকারি ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করা হয়। যেকারণে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী সমস্যায় পড়েন। এতে কাজের সুযোগ কমে যায়। মানুষের আয় কমে যায়।"
দেবপ্রিয় বলেন, "পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী দেশে দরিদ্র কমলেও বৈষম্য বেড়েছে। শহরে বৈষম্য বেড়েছে বেশি। আয় ও ভোগ বৈষম্য বেড়েছে। শহরে বৈষম্য বৃদ্ধির কারণ হতে পারে গ্রাম থেকে মানুষ শহরে আসছে কাজের প্রয়োজনে। যদিও সম্পদ বৈষম্যের তথ্য পাওয়া যায়নি। সেক্ষেত্রেও বৃদ্ধির আশংকা রয়েছে।"
তিনি বলেন, "মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমছে। বাজারে উচ্চমূল্যে জিনিসপত্র বিক্রি হচ্ছে। উন্নয়ন আকাঙ্খার লক্ষ্যমাত্রা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা আর বিশেষ উল্লেখ করছেন না। একমাত্র অবকাঠামো ব্যতিত অন্য কোনো ক্ষেত্রে অষ্টম পঞ্চবার্ষিকীর লক্ষ্য অর্জন নিয়ে কেউ কিছু বলছে না। এটা ভালো লক্ষণ নয়।"
সিপিডি অ্যান্ড সিটিজেনস প্লাটফর্ম ফর এসডিজি বাংলাদেশ আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, বাজেটের মাধ্যমে সরকারের গৃহীত রাজস্ব ও ব্যয়ের পরিকল্পনার প্রভাব রয়েছে সব স্তরের মানুষের ওপরই।
"একটি ভারসাম্যপূর্ণ, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং টেকসই সমাজের জন্য উন্নয়নের সুফল অবশ্যই সুষমভাবে বন্টন করতে হবে। কিন্তু, দেশে দারিদ্র্য কমলেও বৈষম্য বাড়ছে বলে মনে হচ্ছে," বলেন তিনি। এসময় ফাহমিদা খাতুন সুশাসনের আহ্বান জানান।
অর্থমন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য রানা মোহাম্মাদ সোহেল বলেন, সরকার সংকটে পড়েই আইএমএফের দারস্থ হয়েছে। এখন আবার আইএমএফের শর্ত মানতে গিয়ে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। এতে অর্থনৈতিক অগ্রগতি ব্যহত হবে। তিনি সাধারণ মানুষের জন্য বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানোর সুপারিশ করেন।
তিনি সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য বরাদ্দ বাড়ানোর সুপারিশ করেন।
বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্টের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফেরদৌস আরা বেগম বলেন, ভর্তুকি বৈষম্য দূর করতে পারে; তিনি ভর্তুকি আরও বাড়ানোর পরামর্শ দেন।
সংলাপে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান।
তিনি বলেন, "দেশের দরিদ্র্য জনগোষ্ঠী বঞ্চিত হচ্ছেন। সরকার দরিদ্র্যদের জন্য যে বরাদ্দ দেয়, পদ্ধতিগত কারণে সংসদ সদস্যরা চেষ্টা করেও অনেক ক্ষেত্রেই সঠিক জায়গায় পৌঁছাতে পারেন না।"
এম এ মান্নান বলেন, "বাংলাদেশ আইএমএফের ওপর নির্ভরশীল নয়। বাজেট সম্পূর্ণভাবে সরকারের নিজস্ব পরিকল্পনা। আইএমএফ সাইড অ্যাক্টর মাত্র।"
তিনি বলেন, "এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় সমস্যা মূল্যস্ফীতি। যদিও গত মাসে সামান্য কমেছে। মজুরি সামান্য বেড়েছে। এটা ভালো হলেও পণ্য মূল্য এখনও অনেক বেশি।"
তিনি বলেন, মন্দ ভর্তুকি বন্ধ করতে হবে, কারণ একদল অসাধু লোক এর সুযোগ নিচ্ছে। "এসব থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। প্রণোদনার নামে এক ধরনের উন্মাদনা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এমনকি সরকারের কর্মকর্তাদের বড় গাড়ি, বড় বাড়ির রীতি থেকেও বের হতে হবে।"
অনুষ্ঠানে সিপিডির ট্রাস্টি সুলতানা কামাল বলেন, সরকার ভাতা দিতে আগ্রহী কিন্তু কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও স্বনির্ভর নাগরিক গড়ে তুলতে আগ্রহী নয়।
তিনি আরো বলেন, "মানুষ অনেক সমস্যায় রয়েছে। তারা বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করছে। যারা ক্ষমতায় আছে তাদের নাগরিকদের সমস্যা শোনার ধৈর্য ও মানসিকতা নেই।"
সাবেক সংসদ সদস্য ব্যারিষ্টার রুমিন ফারহানা বলেন, রপ্তানি ও রেমিট্যান্স থেকে যা আয় হচ্ছে আমদানি ও ঋণ পরিশোধ বাবদ তার চেয়ে বেশি ব্যয় হচ্ছে।
"ঘরে বৈদেশিক মুদ্রা জমছে না। ফলে জ্বালানিসহ অন্যান্য জরুরি পণ্য আমদানি করা যাচ্ছে না। মূল্যষ্ফীতি বাড়ছে। বৈষম্য বাড়ছে। বৈষম্য কমানোর জন্য বাজেটে কি পদক্ষেপ নিচ্ছে তা পরিস্কার নয়," বলেন তিনি।
"সরকার করের আওতা না বাড়িয়ে যারা কর দিচ্ছে তাদের থেকেই আদায়ের চেষ্টা করছে। পাচারের অর্থ ফেরতের সুযোগ দিচ্ছে। পরোক্ষ কর থেকে বের না হলে বৈষম্য কমবে না," বলেন তিনি।