রিজার্ভ ছাড়া আইএমএফের প্রায় সব শর্ত পূরণের পথে বাংলাদেশ

প্রত্যাশা অনুযায়ী বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগিদের কাছ থেকে প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলারের বাজেট সাপোর্ট পাওয়া গেলেও আইএমএফ'র ঋণের শর্ত অনুযায়ী আগামী জুনে বৈদেশিক মুদ্রার নিট রিজার্ভ ২৪.৪৬ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা চ্যালেঞ্জিং হবে বলে মনে করছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
আইএমএফ'র ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণে ছোট-বড় প্রায় ৩৮টি শর্ত রয়েছে, যেগুলোর বাস্তবায়ন অগ্রগতি প্রথমবারের মতো রিভিউ করতে মঙ্গলবার (২৫ এপ্রিল) সংস্থাটির স্টাফ কনসালটেনশন টিম ঢাকা সফরে আসছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গত ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশের গ্রস বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩১.১৮ বিলিয়ন ডলার। এরমধ্যে নিট রিজার্ভের পরিমাণ কত, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
তবে নাম প্রকাশ না করা শর্তে অর্থ বিভাগের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা সোমবার টিবিএসকে বলেন, "ঈদের আগে বাংলাদেশের নিট রিজার্ভের পরিমাণ ২০ বিলিয়ন ডলারের কিছুটা বেশি ছিল। আগামী জুনের মধ্যে তা ২৪.৪৬ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা খুবই চ্যালেঞ্জিং হবে।"
এদিকে, বিশ্বব্যাংক থেকে জুনের মধ্যে ৫০০ মিলিয়ন ডলার পাওয়া যাবে। এছাড়া, এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের কাছে ৪০০ মিলিয়ন ডলার, জাইকার কাছে ৩২০ কোটি ডলার এবং কোরিয়ার কাছে ১০০ মিলিয়ন ডলার বাজেট সাপোর্ট চেয়েছে সরকার, যা আগামী জুনের মধ্যেই পাওয়ার চেষ্টা করছে ইআরডি। এসব ঋণ পাওয়া গেলে জুনের মধ্যে রিজার্ভে বাড়তি ১.৩২ বিলিয়ন ডলার যোগ হবে।
তবে অর্থ বিভাগের কর্মকর্মতারা জানান, জুনের মধ্যে রিজার্ভের শর্ত পূরণ করতে না পারলেও আগামী সেপ্টেম্বরে ২৫.৩১৬ বিলিয়ন ডলারের ফ্লোর অবশ্যই পূরণ করতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংককে। প্রথম রিভিউয়ে আইএমএফ দেখবে বাংলাদেশ শর্ত পূরণের জন্য আগামী বাজেটসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিচ্ছে কি-না।
কোনো ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দূর্বলতা থাকলে তা দূর করতে পরামর্শ দেবে আইএমএফ। তবে আগামী সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠেয় দ্বিতীয় রিভিউ রিপোর্টের ভিত্তিতে আগামী নভেম্বরে ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড় করবে সংস্থাটি। ফলে সেপ্টেম্বরের মধ্যে শর্ত অনুযায়ী অগ্রগতি নিশ্চিত করতে হবে বাংলাদেশকে।
আইএমএফ গত মার্চে ২২.৯৪৭ বিলিয়ন ডলার নিট রিজার্ভ রাখার ফ্লোর নির্ধারণ করেছিল, যা পূরণ করতে পারেনি বাংলাদেশ। আগামী জুনে এই ফ্লোর বাড়িয়ে ২৪.৪৬২ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার শর্ত রয়েছে সংস্থাটির। আগামী সেপ্টেম্বরে নিট রিজার্ভের পরিমাণ বাড়িয়ে ২৫.৩১৬ বিলিয়ন ডলার এবং ডিসেম্বরে ২৬.৪১১ বিলিয়ন ডলারের ফ্লোর করে দিয়েছে আইএমএফ।
মঙ্গলবার এসে আগামী ২ মে বাংলাদেশ ছাড়ার আগে আইএমএফ টিম বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়সহ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তরগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করবে। আজ বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করবে তারা।
এর আগেই সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তরগুলোকে বিপুল সংখ্যক প্রশ্ন পাঠিয়ে জবাব প্রস্তুত রাখতে বলেছে আইএমএফ। সে অনুযায়ী, প্রস্তুতি সম্পন্ন করে রেখেছে সরকারের সংস্থাগুলো। তাতে শুধু বৈদেশিক মুদ্রার নিট রিজার্ভে আইএমএফ এর সিলিং পূরণ করা ছাড়াও অন্য সব শর্ত পূরণের ক্ষেত্রে সন্তোষজনক অগ্রগতি রয়েছে বলে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অর্থ বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা।
বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার নিট রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করে না। সংস্থাটি গ্রস রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করে, যেখানে এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ড, শ্রীলঙ্কাকে দেওয়া ঋণ, দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে বৈদেশিক মুদ্রায় গঠিত তহবিলের অর্থও রিজার্ভে দেখানো হয়। এসব অর্থ বাদ দিয়ে তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে খরচ করার মতো যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা বাংলাদেশ ব্যাংকের রয়েছে, সেগুলোকে নিট রিজার্ভ হিসেবে চিহ্নিত করে আইএমএফ।
সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, রিজার্ভ বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে ইডিএফের আকার ৭ বিলিয়ন ডলার থেকে কমিয়ে ৫.২ বিলিয়ন ডলার করেছে। ইডিএফ থেকে নতুন করে ঋণ বিতরণও কমানো হচ্ছে।
সাধারণত ঈদ-উল-আযহার মাসে রেমিটেন্স অনেক বেশি আসে, যা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে ভূমিকা রাখে। এ বছর জুনের শেষে এই ঈদ হতে পারে। কিন্তু তা আইএমএফ এর ফ্লোর পূরণে কতোটা ভূমিকা রাখবে, তা নিয়ে নিশ্চিত কিছু বলা যাচ্ছে না বলে উল্লেখ করেন ওই কর্মকর্তা।
ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন টিবিএসকে বলেন, "আমার ধারণা, এখন ১৯-২০ বিলিয়ন ডলার নিট রিজার্ভ রয়েছে। সেক্ষেত্রে জুনের মধ্যে বাড়তি ৪ বিলিয়ন ডলার যোগ করতে হবে। এটি করতে পারলে আইএমএফ সন্তুষ্ট হবে। না হলে বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের আউটলুক প্রণয়ন করার ক্ষেত্রে যেসব বিষয় বিবেচনা করে, সেটি সংশোধন করতে বলবে আইএমএফ।'
আইএমএফ'র শর্তগুলোর মধ্যে আরেকটি কঠিন কাজ হলো, আগামী অর্থবছরে জিডিপির অনুপাতে রাজস্ব আদায় ০.৫% বাড়ানো। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড হিসাব করে দেখেছে, এটি অর্জন করতে হলে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট), আয়কর ও শুল্কখাত থেকে রাজস্ব আয়ের স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধির পরও অতিরিক্ত ১৫,০০০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করতে হবে। কীভাবে এই বাড়তি রাজস্ব আদায় হবে, সে বিষয়ে একটি কর্মপরিকল্পনা প্রস্তুত করা হয়েছে, যা বুধবার আইএমএফ টিমের সামনে তুলে ধরবে এনবিআর।
এরমধ্যে গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পেট্রোবাংলার কাছে পাওনা ৭,৫১৩ কোটি টাকা আদায়ের পরিকল্পনা রয়েছে এনবিআর'র। এই অর্থ পরিশোধের সক্ষমতা পেট্রোবাংলার আছে কি-না, তা জানতে চাইলে অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, পেট্রোবাংলাকে এই রাজস্বের অর্থ এনবিআরকে পরিশোধ করতে হবে। পেট্রোবাংলার বকেয়া রাজস্ব পরিশোধের সামর্থ্য না থাকলে প্রয়োজনে অর্থ বিভাগের কাছে বরাদ্দ চাইবে তারা।