আদানির বিদ্যুৎ আনার গ্রিড লাইন নির্মাণের ব্যয় তিনগুণ বেড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা

২০১৭ সালে ভারতের আদানি গ্রুপের সাথে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি সম্পাদন করে বাংলাদেশ; দেশের উত্তরাঞ্চলেও রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র থেকে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রত্যাশা করা হচ্ছিল। এই প্রেক্ষাপটে, ২০১৮ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত পাওয়ার গ্রিড পরিচালক সংস্থা একটি সঞ্চালন লাইন প্রকল্প নেয়।
ভারতীয় লাইন অব ক্রেডিটের আওতায়, দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া থেকে বগুড়া হয়ে গাজীপুরের কালিয়াকৈর পর্যন্ত ২৬০ কিলোমিটার বৈদ্যুতিক (সঞ্চালন) লাইন নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩ হাজার ৩২২ কোটি টাকা। প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২২ সালের জুনে।
মূল পরিকল্পনা অনুসারে, প্রতি কিলোমিটার বৈদ্যুতিক লাইন নির্মাণের খরচ ছিল ১২.৭৭ কোটি টাকা– যা চলমান অন্যান্য বৈদ্যুতিক লাইন প্রকল্পের মতোই।
কিন্তু, এরপর থেকে নির্মাণ কাজে দেরি এবং ব্যয় বৃদ্ধি চোখ কপালে তোলার মতো হয়েছে। পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)-র বর্তমান হিসাবে ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ২৪৮ কোটি টাকায়, যা মূল প্রাক্কলনের চেয়ে ২০৮ শতাংশ বেশি। আর প্রকল্প সম্পন্নের নতুন তারিখ ধরা হয়েছে ২০২৫ সালের জুনে।
বিদ্যুৎ বিভাগের সূত্রগুলোর মতে, মূল পরিকল্পনায় ব্যয় নিরূপণে দুর্বল প্রাক্কলন সঞ্চালন লাইনের প্রাথমিক পর্যায়ের কাজকে স্থবির করে তোলে, একারণে প্রথম সংশোধনীতে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি প্রকল্প ব্যয় ২২ শতাংশ বৃদ্ধি এবং ডেডলাইন ২০২৪ সাল পর্যন্ত করার প্রস্তাব দেয়।
এখন মুদ্রার অস্থিতিশীল বিনিময় দরের অজুহাতে দ্বিতীয়বার সংশোধনকে সমর্থন করে বাস্তবায়নকারী সংস্থাটি প্রকল্পের দ্বিতীয় সংশোধনী চায়, এতে প্রকল্প ব্যয় ১৫৩ শতাংশ বাড়বে এবং সম্পন্ন হওয়ার তারিখ পৌঁছাবে ২০২৫ সালে।
প্রকল্পের ভৌত বাস্তবায়ন কাজে অগ্রগতি এপর্যন্ত হয়েছে ৪২ শতাংশ; এই অবস্থায় ব্যয় ও মেয়াদ বৃদ্ধির এই প্রস্তাবনার ওপর আগামী ১৯ ফেব্রুয়ারি একটি মূল্যায়ন সভা আহ্বান করেছে পরিকল্পনা কমিশন। কমিশনের কর্মকর্তারা বলেন, কাজের আওতা একই থাকলেও প্রকল্পের ব্যয় – প্রতি কিলোমিটারে ৩৯ কোটি টাকা – অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধির প্রস্তাবের ব্যাখ্যা বিদ্যুৎ বিভাগের কাছে চাওয়া হবে।
তবে প্রকল্প পরিচালক বলেন, বড়পুকুরিয়া-বগুড়া-কালিয়াকৈর ৪০০ কেভি লাইন প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি 'যৌক্তিক' এবং একে সমর্থনকারী নথিপত্র তিনি সভার আগেই পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছেন।
এদিকে বিশাল ব্যয়ের প্রকল্পটি আর্থিক এবং অর্থনৈতিকভাবে লোকসানী হিসেবে চিহ্নিত করেছে বিদ্যুত বিভাগ নিজেই। এর অর্থ হলো, সরকারের প্রকল্প গাইডলাইন অনুসারে, ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব অনুমোদনের পরিবর্তে প্রকল্পটি সমাপ্ত ঘোষণা করে, প্রয়োজনে নতুন প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে।
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা আরো জানান, মধ্যমেয়াদি বাজেট কাঠামোয় (এমটিবিএফ) বিদ্যুত বিভাগের ফিসক্যাল স্পেস ঋণাত্মক থাকায় এই বাড়তি অর্থ কোথা থেকে আসবে সে সম্পর্কেও প্রশ্ন রয়েছে পরিকল্পনা কমিশনের।
ডলারের দর বাড়ার আগেই, দুর্বল প্রাক্কলনের ফলে বার বার সংশোধনীর উদ্যোগ
ডলারের বিনিময় মূল্য ৮৪.৮০ টাকা ধরে প্রকল্পটি প্রণয়ন করা হলেও, দ্বিতীয় সংশোধিত প্রস্তাবনা তৈরির সময় তা ১০৭ টাকায় উঠে। একারণে দুটি নির্মাণ প্যাকেজের ব্যয় বেড়েছে প্রায় ৬০২ কোটি টাকা।

তবে নাম না প্রকাশের শর্তে বিদ্যুৎ বিভাগের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, প্রথম থেকেই দুর্বল পরিকল্পনা ও প্রাক্কলনের কারণে এই প্রকল্পে বার বার ব্যয় সমন্বয় করা হয়েছে।
যেমন যমুনা নদীর ওপর ৯ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণে প্রাথমিকভাবে ৬২৪ টাকা ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়। এই অংশের জন্য আমিনবাজার-মোংলা ডুয়েল সার্কিট লাইনের ব্যয় অনুসরণ ছিল পিজিসিবির প্রাথমিক প্রাক্কলনে, পদ্মা নদীর ওপর দিয়ে একই ধরনের সঞ্চালন লাইন নির্মাণের প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ৫০৫ কোটি টাকা।
কিন্তু, দরপত্র ও পুনঃদরপত্র প্রক্রিয়ায় – ভারতীয় লাইন অব ক্রেডিটের শর্ত অনুসারে, যেখানে শুধু ভারতীয় ঠিকাদাররাই অংশগ্রহণ করে– পিজিসিবি এখন দেখছে একাজের সর্বনিম্ন ব্যয় ২ হাজার ৯৯৮ কোটি টাকা, যা আমিনবাজার-মোংলা সম্পূর্ণ প্রকল্প ব্যয়ের চেয়েও ২০ শতাংশ বেশি।
প্রস্তাবিত সংশোধনীতে, পিজিসিবি বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির জন্যও ৫ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা চেয়েছে – যা প্রাথমিক প্রাক্কলনের চেয়ে ১৯৭ শতাংশ বেশি। বৈদ্যুতিক ইনস্টলেশনের জন্য বাস্তবায়নকারী সংস্থাটি অতিরিক্ত আরো ২১৫ কোটি টাকা চায়।
প্রতি কিলোমিটারে ৩৯ কোটি টাকা
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, সদ্যসমাপ্ত দুইটি প্রকল্পের ব্যয়ের সঙ্গে তুলনা করে প্রস্তাবিত দ্বিতীয় সংশোধনী অনুমোদনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে চায় পরিকল্পনা কমিশন।
প্রকল্পের মোট দৈর্ঘ্যকে ব্যয় অনুসারে ভাগ করে প্রতি কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন স্থাপনের ব্যয় হিসাব করলে দেখা যায়, বড়পুকুরিয়া-বগুড়া-কালিয়াকৈর প্রকল্পে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হবে ৩৯ কোটি টাকা – যা বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানের একই রকম প্রকল্পের চেয়ে ২ থেকে ২.৭ গুণ উচ্চ। যেমন জুনে শেষ হতে চলা আমিনবাজার-মোংলা প্রকল্পের ব্যয় প্রায় ২ হাজার ৫০৫ কোটি টাকা – প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় ১৪ কোটি টাকা।
পটুয়াখালী (পায়রা)- গোপালগঞ্জ ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইন এবং গোপালগঞ্জ ৪০০ কেভি গ্রিড সাবস্টেশন প্রকল্প ৩ হাজার ৫৩২ কোটি টাকায় বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এই প্রকল্পের অধীনেও নদীর ওপর ৭ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন রয়েছে, প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় ২১ কোটি টাকা।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মূল পাওয়ার গ্রিড শক্তিশালীকরণ প্রকল্পের অধীনে ২২৭.৫ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ৪ হাজার ৫৬৭ কোটি টাকা। এই প্রকল্পে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় ২০ কোটি টাকা।
ব্যয় বৃদ্ধিকে সমর্থন করছেন প্রকল্প পরিচালক
প্রকল্প পরিচালক ও পিজিসিবির প্রধান প্রকৌশলী শেখ জাকিরুজ্জামান বলেন, বিভিন্ন কারণেই প্রকল্পটি বাস্তবায়নে কিছু বিলম্ব হয়েছে। আর এর ব্যয় বৃদ্ধির যৌক্তিকতাও রয়েছে।
তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'এ সংক্রান্ত সব ডকুমেন্ট মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। পিইসির মূল্যায়ন সভায় এর বিষদ ব্যাখ্যা দেয়া হবে' মন্তব্য করে তিনি বলেন, 'এর আগে সংবাদ মাধ্যমে এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করা ঠিক হবে না'।