সরবরাহ অনিশ্চয়তায় বাড়ছে চালের দাম

করোনাভাইরাস বাস্তবতায় প্রতি বস্তা চালে প্রায় ৫০০ টাকা বৃদ্ধির পর গত বছরের ডিসেম্বরে শুল্ক কমিয়ে বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি শুরু করা হয়। এরপর দাম কিছুটা কমে এসেছিল চালের বাজারে। তবু কাঙ্ক্ষিত দাম না কমায় চালের শুল্ক আরও কমিয়ে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। কিন্তু সরবরাহ সংকটে ফের বাড়ছে দাম।
গত এক সপ্তাহে দেশে চালের দাম বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) ১৫০-২০০ টাকা বেড়ে গেছে।
আমদানির অনুমতি দিলেও তা সবার জন্য উম্মুক্ত না করে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে নির্দিষ্ট করে দেওয়ায় গত ২৫ দিনে মাত্র এক লাখ টন চাল আমদানি হয়েছে। এতে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ও বড় মিল মালিকদের কারসাজিতে অতি নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যটির দাম আবারও বাড়তে শুরু করে।
ব্যবসায়ীদের তথ্যমতে, আমদানি শুরুর পর ভারত থেকে আসা বালাম সিদ্ধ চাল বিক্রি হয়েছিল বস্তাপ্রতি ২,৩০০ টাকায়। বর্তমানে বস্তাপ্রতি প্রায় ১৫০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২,৪৫০ টাকায়। একই দেশ থেকে আমদানি হওয়া আতপ চালও বস্তাপ্রতি প্রায় দেড়শ টাকা বেড়ে গেছে। আমদানির পর বস্তাপ্রতি বেতি আতপ চাল ১,৮০০-১,৮৫০ টাকা থেকে বর্তমানে তা বিক্রি হচ্ছে ২,০০০-২,০৫০ টাকার মধ্যে।
চট্টগ্রামের চাক্তাই ও পাহাড়তলী পাইকারি চালের ব্যবসায়ীরা জানান, জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে চাল আমদানির সিদ্ধান্তের পর দেশে বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) মিনিকেট সিদ্ধ চালের দাম ২০০ টাকা কমে ২,৩৫০-২,৪০০ টাকায় নেমে আসে। এছাড়া স্বর্ণা সিদ্ধ ১৫০-২০০ টাকা কমে বস্তাপ্রতি ২,১৫০ টাকায়, জিরাশাইল চাল ৫০ টাকা কমে ২,৮৫০ টাকায়, গুটি সিদ্ধ বস্তাপ্রতি ১০০ টাকা কমে ২ হাজার টাকা বিক্রি হয়েছিল।
কিন্তু গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে এসব চাল মানভেদে প্রতি বস্তা আবারও ১৫০-২০০ টাকা বেড়ে গেছে।
আমদানির প্রভাবে জানুয়ারির মাঝামাঝিতে আতপ চালের দামও বস্তাপ্রতি ১০০ টাকা পর্যন্ত কমেছিল। তবে বর্তমানে আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে আতপ চাল। বর্তমানে পাইকারিতে পুরাতন চালের মানভেদে প্রতিবস্তা বেতি চাল ২,৪০০-২,৭০০ টাকা, মিনিকেট আতপ ২,৬০০-২,৭০০ টাকা ও পাইজার আতপ মানভেদে ২,২০০-২,৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে কোনো ধরণের দাম পরিবর্তন না হয়ে দীর্ঘদিন থেকে প্রতিবস্তা চিনিগুঁড়া চাল মানভেদে ৩,৮০০-৪,৭০০ টাকা ও কাটারি সিদ্ধ বস্তাপ্রতি (২৫ কেজি) ১,৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
খাদ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০১৯ সালের ১ জুলাই সরকারের হাতে খাদ্য মজুদ ছিল ১৬ দশমিক ৭৪ লাখ টন। ২০২০ সালের জুলাইয়ে খাদ্য মজুদ ছিল ১১ দশমিক ৮৮ লাখ টন। তবে বর্তমানে (২৫ জানুয়ারি ২০২১ পর্যন্ত) সরকারি খাদ্যশস্যের মজুদ রয়েছে ৭ দশমিক ৪ লাখ টন। এরমধ্যে চাল রয়েছে ৫ লাখ ৪৮ হাজার টন এবং গমের মজুদ ১ লাখ ৫৬ হাজার টন।
আমদানির পাশাপাশি সরকার ধান-চাল সংগ্রহ কার্যক্রমও জোরদার রেখেছে। চলতি আমন সংগ্রহ (২০২০ সালের ৭ নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া) চলতি বছরের ২৫ জানুয়ারি সর্বমোট ৫১ হাজার ২৬ টন ধান-চাল সংগ্রহ হয়েছে। যারমধ্যে ৪৫ হাজার ৪ টন আমন সিদ্ধ চাল, ২ হাজার ২৮ টন আতপ চাল এবং ৬ হাজার ৯ টন আমন ধান (চালের আকারে) সংগ্রহ হয়েছে। তবে আমন মৌসুমে সরকারের ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০ লাখ টন।
চাল ব্যবসায়ীরা জানান, দেশীয় বাজার স্থিতিশীল রাখতে দীর্ঘদিন ধরে চাল আমদানিতে ৬২ দশমিক ৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা ছিল। কিন্তু সরবরাহ ঘাটতি কমিয়ে আনতে সরকার গত ডিসেম্বরের শেষার্ধ্বে সব ধরনের চাল আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনে। পরবর্তীকালে দাম কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে কমে না আসায় কাটারি কিংবা বাসমতি জাতীয় চালের আমদানি শুল্ক আগের মতো ২৫ শতাংশে স্থির রেখে মোটা চালের আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ নির্ধারণ করে। এরপর শুধু নির্দিষ্ট অনুমতিপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানই ভারত থেকে চাল আমদানি করছে।
খাদ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত ৬ ও ১০ জানুয়ারি দুই দফায় ৩২০টি প্রতিষ্ঠানকে ৬ লাখ ৭৬ হাজার টন চাল আমদানির অনুমতি দেয় খাদ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু গত ২৫ দিনে সরকারি ও বেসরকারিভাবে চাল আমদানি হয়েছে মাত্র ১ লাখ টন। এরমধ্যে বেসরকারিভাবে গত ৯ থেকে ১২ জানুয়ারি হিলি স্থলবন্দর দিয়ে চার দফায় দুই হাজার ১৫৩ টন চাল আমদানি হয়।
খাদ্য অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ) মোঃ হারুন-অর-রশিদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, সরকারি ও বেসরকারিভাবে খাদ্য অধিদপ্তর এ পর্যন্ত প্রায় এক লাখ টন চাল আমদানি করেছে। তবে এ পর্যন্ত ১৭৭টি প্রতিষ্ঠান খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে ৬ লাখ ৭৬ হাজার টন চাল আমদানির অনুমতি নিয়েছে। এসব চাল আমদানির প্রক্রিয়ায় রয়েছে। আমদানির পরে চালের দাম কিছুটা কমেছিল। আমদানি আরও বাড়লে পর্যায়ক্রমে দামও কমবে বলে আশা প্রকাশ করেন ওই কর্মকর্তা।
চাল ব্যবসায়ীরা জানান, চাল আমদানি হলেও বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধির পাশাপাশি দেশীয় পর্যায়ে ধান-চাল সরবরাহ না বাড়ায় বাজার নতুন করে অস্থিরতার দিকে যাচ্ছে। এছাড়া সরকার চাল আমদানির সুযোগ দিলেও সেটি সীমিত রেখেছে।
চট্টগ্রাম রাইস মিল মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি ও চাল ব্যবসায়ী শান্ত দাশগুপ্ত বলেন, আমদানি উন্মুক্ত না করে শুধু বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে অনুমতিপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানই চাল আমদানির সুযোগ পাচ্ছে। এ কারণে চাহিদা অনুযায়ী দেশে এখনো পর্যাপ্ত চাল আমদানি হয়নি।
আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ও বড় মিল মালিকরা সিন্ডিকেট করে চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন বলে অভিযোগ ব্যবসায়ীদের।
তাছাড়া আমনের উত্তোলন মৌসুমের শুরুতে বেশি দামে ধান কিনেছেন মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীরা। এখন চালের দাম কমে যাওয়ার কারণে মজুদ থাকা সেসব চাল সরবরাহ করছেন না তারা। যার ফলে নতুন করে চালের বাজারে দাম বাড়তে শুরু করেছে বলে অভিমত এই ব্যবসায়ী নেতার।
খাত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দেশে খাদ্যের মজুদ কমে এসেছে। অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ কার্যক্রমও লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী হচ্ছে না। এই সংকট মোকাবেলায় সরকার চাল আমদানির সুযোগ দিলেও এইচএস কোড জটিলতায় গত ১৩ জানুয়ারি থেকে আমদানি প্রক্রিয়া স্থগিত রয়েছে। তাছাড়া বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি উম্মুক্ত না করে নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে আমদানির সুযোগ দেওয়ায় আমদানিকৃত চালের প্রভাব খোলা বাজারে পড়ছে না।