ম্যারাডোনার মৃত্যুর পাঁচ বছর: শ্রদ্ধাঞ্জলি, ন্যায়বিচার ও সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিয়ে দ্বন্দ্ব
'কতবার তারা আমাকে মেরেছে, কতবার আমি মরেছি, তবুও আমি এখানেই আছি, বারবার জেগে উঠছি'—ফুটবল কিংবদন্তি দিয়েগো ম্যারাডোনার মৃত্যুর পাঁচ বছর পর তার অফিসিয়াল অ্যাকাউন্ট থেকে এই বার্তা পোস্ট করা হয়েছে। মারিয়া এলেনা ওয়ালশের বিখ্যাত গান 'কোমো লা সিগারা'র এই কথাগুলো আবারও মনে করিয়ে দেয়, আর্জেন্টাইনদের কাছে তাদের প্রিয় তারকা আসলে অমর।
৬০তম জন্মদিন পালন করার মাত্র কয়েক সপ্তাহ পর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ম্যারাডোনা। তার পরিবার বিশ্বাস করে, এই মৃত্যু এড়ানো যেত। তাদের দাবি, চিকিৎসকদের অবহেলার কারণে এই ঘটনা ঘটে। তাই প্রিয়জনের আত্মার শান্তির জন্য তারা এখনও ন্যায়বিচারের অপেক্ষায় রয়েছেন।
ম্যারাডোনার মৃত্যুর জন্য তার চিকিৎসায় নিয়োজিত মেডিকেল টিম দায়ী কি না, তা নিয়ে প্রথম দফায় বিচার কাজ কোনো ফলাফল ছাড়াই শেষ হয়। ওই সময়ে একজন বিচারককেও তার পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ২০২৬ সালের ১৭ মার্চ দ্বিতীয়বারের মতো এই মামলার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হবে।
বুয়েনস এইরেসের উপকণ্ঠে একটি ভাড়া করা বাড়িতে অস্ত্রোপচার পরবর্তী বিশ্রামের সময় ম্যারাডোনা মারা যান। তার হৃৎস্পন্দন থেমে যাওয়ার খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গে পুরো আর্জেন্টিনা শোকে স্তব্ধ হয়ে যায়। শোক এতটাই তীব্র ছিল যে, কোভিড-১৯ মহামারির কঠোর বিধিনিষেধ উপেক্ষা করেও মানুষ রাস্তায় নেমে আসে।
গত ২৫ নভেম্বর ম্যারাডোনার ৫ম মৃত্যুবার্ষিকীতে ভক্তরা আবেগঘন বার্তা ও ছবি পোস্ট করেছেন। কেউ লিখেছেন, 'আমরা তোমাকে সবসময় মিস করব', কেউবা লিখেছেন, 'দিয়েগো তুমি অনন্ত'।
ম্যারাডোনা নিজের প্রিয় ক্লাব বোকা জুনিয়র্সকে বলতেন, 'পৃথিবীর বুকে আমার নিজের জায়গা।' ক্লাবটি তার স্মরণে একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে। সেখানে দেখা যায়, লা বোম্বোনেরা স্টেডিয়ামে ম্যারাডোনার ১০ নম্বর জার্সির মূর্তির বিখ্যাত বাম পায়ে সব বয়সের ভক্তরা ডেইজি ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে।
অন্যদিকে আর্জেন্টিনা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (এএফএ) আরেকটি ভিডিও বার্তায় জানিয়েছে, 'যাদের মানুষ ভুলে যায়, কেবল তাদেরই সত্যিকারের মৃত্যু হয়। দিয়েগো, আমরা তোমাকে প্রতিদিনই মনে করি।'
আর্জেন্টিনার সীমানা ছাড়িয়ে ম্যারাডোনার প্রতি শ্রদ্ধার ঢেউ ইতালির নেপলস শহরেও ছড়িয়ে পড়েছে। এই শহরেই তিনি নাপোলির হয়ে খেলতেন এবং ১৯৮৭ ও ১৯৯০ সালে দুটি লিগ শিরোপা (স্কুডেত্তো) জিতেছিলেন। তাই নেপলসবাসীর মনে তাদের প্রিয় এই তারকা আজও অমলিন।
এদিকে, ম্যারাডোনার মৃত্যুর পর তার স্বীকৃত পাঁচ সন্তান—দালমা, জিয়ানিনা, দিয়েগো জুনিয়র, জানা ও দিয়েগো ফার্নান্দোর মধ্যে সম্পত্তি উত্তরাধিকার নিয়ে দীর্ঘ বিবাদ চলছিল। প্রকাশ্যে কাদা ছোড়াছুড়ির পর অবশেষে গত মাসে তারা একটি সমঝোতায় পৌঁছেছেন। 'ম্যারাডোনা' ব্র্যান্ডের পণ্যের উৎপাদন ও বিপণনের জন্য তারা সুইডিশ-ইরানি কোম্পানি 'ইলেকটা গ্লোবাল'-এর সঙ্গে যৌথভাবে চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন।
এম১০ মেমোরিয়াল
৮৬-র বিশ্বকাপজয়ী এই মহানায়কের সমাধি বর্তমানে বুয়েনস এইরেসের উত্তরে বেল্লা ভিস্তা কবরস্থানে রয়েছে। তবে এটি অস্থায়ী। তার সন্তানদের পরিকল্পনা হলো, রাজধানীর কেন্দ্রে 'কাসা রোসাদা' (রাষ্ট্রপতির কার্যালয়)-এর সামনে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করে সেখানে ম্যারাডোনার দেহ স্থানান্তর করা।
গত বছর এই স্মৃতিস্তম্ভের প্রস্তাবনা দেওয়া হলেও বর্তমানে নির্মাণকাজ থমকে আছে। ম্যারাডোনার বড় মেয়ে দালমা সম্প্রতি স্থানীয় সংবাদপত্র 'লা নাসিওন'-কে বলেন, 'মামলা নিয়ে যা ঘটছে, তাতে বাকি সবকিছু ম্লান হয়ে গেছে। স্মৃতিস্তম্ভ অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু এখন আমাদের কাছে আইনি লড়াইটাই প্রধান অগ্রাধিকার।'
বিচারক বরখাস্ত ও বিচার বাতিল
ম্যারাডোনার মৃত্যুর জন্য চিকিৎসকদের অবহেলা ছিল কি না—এ নিয়ে প্রথম দফার বিচার একটি বড় কেলেঙ্কারির কারণে বাতিল (মিসট্রায়াল) হয়ে যায়।
কয়েক মাসের শুনানির পর জানা যায়, বিচারক প্যানেলের একজন সদস্য জুলিয়েটা মাকিনতাচ গোপনে 'ডিভাইন জাস্টিস' নামের একটি ডকুমেন্টারির জন্য আদালতের ভেতরের দৃশ্য ধারণের অনুমতি দিয়েছিলেন, যেখানে নিজেই প্রধান চরিত্র ছিলেন।
একজন বিখ্যাত বিচারকের কন্যা হওয়া সত্ত্বেও এই অপেশাদার আচরণের জন্য জুলিয়েটাকে তার পদ থেকে অপসারণ করা হয় এবং আজীবনের জন্য বিচারিক কাজ থেকে নিষিদ্ধ করা হয়। তার বিরুদ্ধে এখন ফৌজদারি মামলা চলবে।
ম্যারাডোনার মৃত্যু সংক্রান্ত মামলার বিচার কার্যক্রম নতুন করে শুরু হচ্ছে। এবার এই বিচার সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি আদালতের অধীনে হবে, যেখানে বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন আলবার্তো ওর্তোলানি, পাবলো রোলন ও আলবার্তো গাইগ।
নতুন বিচারকরা রায় দিয়েছেন, আগের সেই 'অভিনেত্রী' বিচারক মাকিনতাচের যোগদানের পর যে সমস্ত আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছিল, তা বাতিল গণ্য হবে। তবে তার যোগদানের আগে যেসব প্রমাণ ও তথ্য আদালতে জমা দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো বহাল থাকবে।
অটোপসি রিপোর্টে ভয়াবহ তথ্য
ম্যারাডোনার ময়নাতদন্ত বা অটোপসি রিপোর্টে মৃত্যুর কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে 'ক্রনিক হার্ট ফেইলিউরের কারণে অ্যাকিউট পালমোনারি ইডিমা', অর্থাৎ ফুসফুসে পানি জমে যাওয়াকে। রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, এই ফুটবল তারকা লিভার সিরোসিস এবং দীর্ঘস্থায়ী ফুসফুসের সমস্যায় ভুগছিলেন।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, মৃত্যুর সময় তার পেটের গহ্বর অস্বাভাবিকভাবে ফুলে গিয়েছিল এবং কিডনিতে গুরুতর সমস্যা দেখা দিয়েছিল। সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য হলো, ম্যারাডোনার হৃৎপিণ্ডের ওজন স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি ছিল।
শারীরিক অবস্থার তীব্র ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও, ১১ থেকে ২৫ নভেম্বর পর্যন্ত ম্যারাডোনা কী ধরনের সেবা পেয়েছিলেন, সেটাই এখন তদন্তের মূল বিষয়।
এই মামলার প্রধান অভিযুক্ত হলেন নিউরোসার্জন লিওপোল্ডো লুক। ম্যারাডোনার মেয়েরা অভিযোগ করেছেন, ডাক্তার লুকই তাদের বোঝান যে বাবাকে ক্লিনিক থেকে ওই ভাড়া বাসায় স্থানান্তর করা হবে। অভিযুক্তদের তালিকায় আরও রয়েছেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অগাস্টিনা কোসাছভ, মনোবিজ্ঞানী কার্লোস দিয়াজ, নার্স রিকার্ডো আলমিরন ও মারিয়ানো পেরোনি, ইনস্যুরেন্স কো-অর্ডিনেটর ন্যান্সি ফোরলিনি এবং চিকিৎসক পেদ্রো দি স্পাগনা।
যে বাড়িতে ম্যারাডোনা শেষ দিনগুলো কাটিয়েছেন, সেখানে জরুরি চিকিৎসার কোনো সরঞ্জাম ছিল না। এমনকি বাথরুমটিও হাঁটাচলায় অক্ষম রোগীর ব্যবহার উপযোগী ছিল না।
ম্যারাডোনার মেয়ে জিয়ানিনা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, চিকিৎসকরা বাসায় 'উন্নত সেবা' দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে তা ছিল এক 'ভয়াবহ প্রহসন'। পরিবারের দাবি, ডাক্তার লুক তাদের সতর্কবার্তায় কোনো গুরুত্ব দেননি, যার করুণ পরিণতি পুরো বিশ্বকে ভোগ করতে হয়েছে।
