তিন বলে তিন: হ্যাটট্রিকের ভিডিওটা নিয়মিত দেখি

জিম্বাবুয়ে তখন দারুণ ছন্দে। ২৩৭ রানের লক্ষ্যে ব্যাটিং করতে নেমে ৩২.৫ ওভারে চার উইকেটে ১৩১ রান জমা করে ফেলে স্বাগতিকরা। এমন সময় শাহাদাত হোসেনকে ডেকে হাতে বল তুলে দেন অধিনায়ক খালেদ মাসুদ পাইলট। ঠিক সেই সময় শাহাদাতকে মোহাম্মদ আশরাফুল বলেন, 'রাজিব, পাগলা হ্যাটট্রিক করতে হবে। হ্যাটট্রিক কর। একদম স্টাম্প ভেঙে ফেলতে হবে, জোরে বল করতে হবে।'
আশরাফুলের কথায় যেন জিদ চেপে যায় শাহাদাতের। পণ করে বসেন প্রতিপক্ষের ব্যাটিং দূর্গ গুঁড়িয়ে দেওয়ার। শুধু উইকেট নেবেন বলেই দৌড় শুরু করেন ডানহাতি এই পেসার। প্রথম বলেই মিলে যায় উইকেটের দেখা। মুফামবিসিকে ফেরানোর পর চিগুম্বুরাকেও সাজঘর দেখিয়ে দেন শাহাদাত।
তৃতীয় বলটি করার আগে এগিয়ে আসেন রাজিন সালেহ। বলে ওঠেন, 'রাজিব, ফু দিয়ে দিলাম। তোর হ্যাটট্রিক হয়ে যাবে।' এটা শুনে একটু সময় নিয়ে বল করেন শাহাদাত, তৃতীয় বলেও মিলে যায় উইকেট। হ্যাঁ, হ্যাটট্রিক। ওয়ানডেতে বাংলাদেশের প্রথম বোলার হিসেবে হ্যাটট্রিক করেন শাহাদাত। কিন্তু হারারেতে ২০০৬ সালের ২ আগস্টের স্মৃতিময় সেই ম্যাচটা হেরে যাওয়ায় আক্ষেপের শেষ নেই ডানহাতি এই পেসারের।
টেস্ট এবং ওয়ানডে মিলিয়ে বাংলাদেশের সাতজন বোলার হ্যাটট্রিক করেছেন। হ্যাটট্রিকের নায়কদের নিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের নিয়মিত আয়োজনের তৃতীয় পর্বে আজ থাকছেন শাহাদাত হোসেন। হ্যাটট্রিকে একজন বোলারের কেমন অনুভূতি হয়, ১৪ বছর আগে হারারেতে হ্যাটট্রিক করার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল, এখনও কীভাবে মনে পড়ে; এসব নিয়ে কথা বলেছেন বাংলাদেশের এই ক্রিকেটার। তার মুখেই শোনা যাক সে গল্প।
শাহাদাত হোসেন: আমি হ্যাটট্রিক করি ২ আগস্ট আর আমার জন্মদিন ছিল ৫ দিন পর, ৭ আগস্ট। আমি হ্যাটট্রিক করার আগে জিম্বাবুয়ের অবস্থা খুবই ভালো ছিল। জেতার জন্য ওই সময় আমাদের একটা ব্রেক থ্রু দরকার ছিল। প্রথম স্পেলে আমি মোটামুটি ভালো বোলিং করলেও উইকেট পাইনি। যখন আমি শেষের দিকে থার্ড স্পেলে আসি, তখন আমার বল রিভার্স করছিল।
ওই সময় পাইলট ভাই যখন আমাকে বল দেন, তখন রাজিন ভাই আমাকে বলছিলেন, "পাগলা এবার কিন্তু ভালো বোলিং করতে হবে। তুই যদি ৩-৪টা উইকেট নিতে পারিস, আমরা ম্যাচ জিতে যাব।" আমি বলেছি, ভালো বোলিং করব। ওই সময় তো আমি একদম তরুণ। মাত্র এক-দেড় বছর হয়েছে বাংলাদেশ দলে খেলার। আশরাফুল ভাই তখন বলছিলেন, "রাজিব, পাগলা হ্যাটট্রিক করতে হবে। হ্যাটট্রিক কর। একদম স্টাম্প ভেঙে ফেলতে হবে, জোরে বল করতে হবে।"
আমি বলছিলাম ঠিক আছে ভাই। প্রথম বলটা আমি অফ স্টাম্পের বাইরে করি, ফোর স্টাম্পে। ওই বলে আমি উইকেট পেলাম। তখন ছন্দ পাচ্ছিলাম। এরপর আশরাফুল ভাই আবার বলছিলেন, "চিগুম্বুরা নতুন ব্যাটসম্যান। ইয়ার্কার দিবি। স্টাম্প ভেঙে দিবি।" চিগুম্বুরা উইকেটে আসে, আমি রান আপে যাই। রাজিন ভাই তখন মিড অফে, আশরাফুল ভাই মিড অনে। আশরাফুল ভাই আমাকে উদ্বুদ্ধ করতে কভার থেকে মিড অনে চলে আসেন।
বলছিলেন, "পারবি তো ইয়র্কার দিতে? ও উইকেট নতুন। বল রিভার্স করছে, ইয়ার্কার দিলে পায়ে লাগবে।" আমি বলছিলাম পারব। এরপর চিগুম্বুরাকে ইয়ার্কার করি, ও এলবিডব্লিউ হয়ে যায়। এরপর রাজিন ভাই বলছিলেন, "রাজিব, ফু দিয়ে দিলাম। তোর হ্যাটট্রিক হয়ে যাবে।"
হ্যাটট্রিকের বলটা সময় নিয়ে করি। রাজিন আর আশরাফুল ভাই বলছিলেন, "ইয়র্কার না, ও বসেই থাকবে ইয়র্কারের জন্য। জায়গায় বল কর।' এরপর ফোর স্টাম্পেই বল করলাম, উইকেটকিপারের কাছে গেল। আমি বুঝেই উঠতে পারছিলাম না যে, হ্যাটট্রিক করেছি। ওয়ানডেতে বাংলাদেশের প্রথম হ্যাটট্রিক ওটাই। অসাধারণ এক অনুভূতি কাজ করছিল।
সবাই আমাকে জড়িয়ে ধরছিল। শেষের দিকে ফুটবলার গোল দিলে যেমন হয়, তেমন ছিল। শুধু খেলোয়াড় না, সবাই চলে আসে। কোচ, ম্যানেজার সবাই বাইরে চলে আসে। ওই সময় সাকিব ছিল (সাকিব আল হাসান)। ওই সিরিজের শেষ ওয়ানডেতে সাকিবের অভিষেক হয়। তো খুব ভালো লাগছিল। কারণ উইকেট তো সবাই নেয়, কিন্তু হ্যাটট্রিক তো সবাই করতে পারে না। আমার জন্য এটা বিরাট অর্জন।
কোনো কিছু প্রথম হিসেবে করার মজাটাই আলাদা। এটা বড় অর্জন। অনেকেরই ইচ্ছা থাকে কোনো কিছু আগে করার, যেটা জীবনের সবচেয়ে বড় স্মৃতি হয়ে থাকবে। তো ওই সময়ে আমার ইচ্ছা ছিল বাংলাদেশের হয়ে প্রথম কিছু করার। বাংলাদেশের হয়ে প্রথম কিছু করার স্বপ্ন দেখতাম। টেস্টে আমি সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম। যদিও তেমন জায়গায় এখনও যেতে পারিনি।
হ্যাটট্রিকের সেই ঘটনা মনে পড়লে ভালো লাগে, গর্ব হয়। কারণ বাংলাদেশের প্রথম বোলার হিসেবে আমি ওয়ানডেতে হ্যাটট্রিক করি। এটা অবশ্যই বড় কিছু। কারণ চাইলেই আপনি হ্যাটট্রিক করতে পারবেন না। উইকেট নেবেন, কিন্তু হ্যাটট্রিক আলাদা জিনিস।
সব বোলারেরই স্বপ্ন থাকে হ্যাটট্রিক করার। সবাই চায়, হ্যাটট্রিক করব। উইকেট নেবেন, ৫ উইকেটও নেবেন। এটা হয়ে যাবে খেলতে খেলতে। কিন্তু হ্যাটট্রিক হ্যাটট্রিকই। এটা অন্যরকম এক অনভূতি দেয়। অনেক ম্যাচেই আপনি ৫ উইকেট পাবেন। কিন্তু হ্যাটট্রিক সব ম্যাচে করতে পারবেন না। হ্যাট্রট্রিক সম্পূর্ণ আলাদা একটা শব্দ। এটা অর্জন করতে আপনাকে দক্ষ হতে হবে, আবার ভাগ্যও লাগবে।
আগে যেটা বলছিলাম, তৃতীয় বল করার আগে রাজিন ভাই বলছিলেন, "তোর হ্যাটট্রিক হয়ে যাবে।" এখনও সেটা চোখে ভাসে। তখন বল বেশি রিভার্স করছিল। লেংন্থে বল করলেও বল ভেতরে ঢুকছিল। এ সময় ব্যাটে লাগার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তো ফোর স্টাম্পে বল করি, ক্যাচ হয়ে যায়। তৃতীয় বলটি করার আগে মনে হচ্ছিল যে হ্যাটট্রিক হয়ে যেতে পারে।
ম্যাচটা হেরে যাই আমরা। জিতলে অনেক বেশি ভালো হতো। চেষ্টা ছিল ম্যাচটা জেতানোর। আমার ওই রকম অর্জনের ম্যাচে দল জিতলে সেটা পরিপূর্ণ হতো। দুর্ভাগ্যবসত আমরা ম্যাচটা জিততে পারিনি। অনেক খারাপ লাগছিল। মূলত বেন্ডন টেলরের কাছে আমরা হেরে যাই। ও দারুণ ব্যাটিং করে আমাদের হারিয়ে দেয়।
হ্যাটট্রিকের সেই ভিডিওটা দেখি। অনলাইনে পাওয়া যায়। নিয়মিতই দেখি। ফেসবুকসহ আরও অনেক জায়গাতেই পাওয়া যায় এটা। যদি আমার দুটি সেরা পারফরম্যান্সের কথা জিজ্ঞাস করেন, এর মধ্যেও হ্যাট্রট্রিক থাকবে। এটাই আমার ক্যারিয়ারের সেরা পারফরম্যান্স। এটাকে আমি এক নম্বরে রাখব। দুই নম্বরে রাখব লর্ডসের পারফরম্যান্সটা।