নকল ও ভেজাল কসমেটিকসে বাজার সয়লাব: বিদ্যমান আইন ও বাস্তবতা এবং সরকারের করণীয়

বাহারী সজ্জায় বিদেশী লেভেল আর নামী-দামি ব্র্যান্ডের আকর্ষনীয় মোড়কে থরে থরে সাজানো রাজধানী সহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কসমেটিকসের দোকানগুলো। তবে খালি চোখে দেখে বুঝার উপায় নাই কোনটি আসল আর কোনটি নকল। পুরান ঢাকার চকবাজার, নারায়নগঞ্জ, গাজীপুর, মৌলভীবাজার, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় এসব নকল কসমেটিকস তৈরির কারখানা রয়েছে। আর একটি অসাধু চক্র দেশি-বিদেশী বিখ্যাত সব ব্র্যান্ডের পরিত্যক্ত কৌটাতে নকল প্রসাধনী ঢুকিয়ে কম দামে বাজারজাত করছে। কম দামে পাওয়াতে ব্র্যান্ডের কসমেটিকস মনে করে ভোক্তারাও তা দেদারসে ক্রয় করছে।
নকল ভেজাল প্রসাধনীতে মাত্রাতিরিক্ত মার্কারী, সীসা, স্টেরয়েড ও হাইড্রোকুইনোন সহ নানান ক্ষতিকারক রাসায়নিক থাকায় তা ব্যবহারে অনেকের মাথার চুল পড়ে যাচ্ছে। অতিরিক্ত প্যারাবেনস যুক্ত প্রসাধনীর দীর্ঘ ব্যবহারের ফলে শরীরে হরমোনের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়, ফলে প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস পেতে পারে।
ফর্সা হতে গিয়ে আবার কারও মুখের চামড়া সাদা হয়ে যাচ্ছে অথবা স্থায়ী কালো দাগ পড়ে যাচ্ছে। গর্ভবতী নারীরা এইসব প্রসাধনী ব্যবহারের ফলে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী সন্তান জন্ম দিচ্ছেন। নকল কসমেটিকস দীর্ঘদিন ব্যবহার করলে স্কিন ক্যান্সার সহ লিভার ও কিডনির জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
কিছুদিন পূর্বে জনসন এন্ড জনসন কোম্পানীর বেবি পাউডারে ক্ষতিকর ক্যান্সারের উপাদান থাকায় আমেরিকার বাজার থেকে কোম্পানী পণ্যটি প্রত্যাহার করে এবং ক্ষতিগ্রস্থদের ৭০০ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ প্রদান করে।
উন্নত বিশ্বে শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ এবং আইনের কঠোর প্রয়োগ থাকায় কোম্পানীসমূহ খুব সতর্কতার সাথে বিধি-বিধান মেনে কসমেটিকস উৎপাদন ও বাজারজাত করে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের কসমেটিকস বাজারজাত করার দায়ে আমদানীকারক বা উৎপাদনকারী কোম্পানী কর্তৃক পণ্যটি প্রত্যাহার ও ক্ষতিপূরণ প্রদানের নজির নাই বললেই চলে।
ট্রেড এন্ড ট্যারিফ কমিশনের এক সমীক্ষায় দেখা যায় যে, বাংলাদেশে কসমেটিকস খাতের বাজার প্রায় ৩৪ হাজার কোটি টাকার। তারমধ্যে কালার কসমেটিকসের চাহিদা ১৩ হাজার কোটি টাকা এবং স্কিন কেয়ার পণ্যের চাহিদা প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা।
উক্ত পরিসংখ্যানে আরও দেখা যায় যে, মাত্র ১০ হাজার কোটি টাকার প্রসাধনী পণ্য বৈধভাবে আমদানি হয়ে থাকে বাকি ২৪ হাজার কোটি টাকার কসমেটিকস পণ্য লাগেজ পার্টির মাধ্যমে চোরাই পথে দেশে প্রবেশ করে। সেই হিসাবে ৭০ শতাংশ কসমেটিকস পণ্যের বাজার কালোবাজারীদের দখলে। এভাবে নকল কসমেটিকস তৈরি এবং শুল্ক ফাঁকির মাধ্যমে আমদানির ফলে ক্রেতারা যেমন ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে তেমনি সরকারও হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে।
নানান বাধা বিপত্তি পেরিয়ে বাংলাদেশে গার্মেন্টস, ঔষধ, চামড়া, হিমায়িত মৎস্য ও প্লাষ্টিক শিল্পে বিস্তর উন্নয়ন ঘটে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে বর্তমানে বিশ্বের ১৫০টিরও বেশি দেশে ঔষধ সহ উল্লেখিত পণ্য সমূহ রপ্তানী হচ্ছে।
পিছিয়ে পড়া কসমেটিকস শিল্পকে অন্যান্য শিল্পের মতো এগিয়ে নিতে বিগত সরকারগুলো নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বিগত সংসদে ঔষধ ও কসমেটিকস আইন-২০২৩ পাস করা। এই আইনের ২(৮) ধারায় কসমেটিকসের সংজ্ঞায় ঔষধ সংশ্লিষ্ট প্রসাধন সামগ্রী এবং ৩১-৩৫ ধারায় কসমেটিকস এর উৎপাদন, মান নিয়ন্ত্রণ, নিবন্ধন এবং বিজ্ঞাপন সম্পর্কে বিশদ বিবরণ রয়েছে।
তাছাড়া নকল কসমেটিকস উৎপাদন ও বাজারজাতকারীদের ৫ বছরের কারাদন্ড ও ৫ পাঁচ লক্ষ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। আইনটি প্রণয়নকালে সরকারের দুটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এন্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই) এবং ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর (ডিজিডিএ) এর মধ্যে রশি টানাটানি শুরু হয়।
বিএসটিআই এর মতে নির্বাহী বিভাগের সিদ্ধান্তক্রমে দীর্ঘদিন ধরে তারা প্রসাধনী পণ্যের ছাড়পত্র প্রদান করে আসছে। অপরদিকে ডিজিডিএ এর মতে বেশির ভাগ কসমেটিকস ত্বকের মাধ্যমে শোষিত হয়ে শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন সাধনের মাধ্যমে কার্যকর হয় বলে বিষয়টি জনস্বাস্থ্যের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত এবং আমেরিকা, কানাডা, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, জাপান ও ভারতসহ বিভিন্ন দেশের ড্রাগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা কসমেটিকস সামগ্রী নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। তাই কসমেটিকস সেক্টরটি স্বাস্থ্য বিভাগের নিয়ন্ত্রণে থাকা উচিত।
সরকারী সংস্থা সমূহের মধ্যে দ্বিধা-সংশয় থাকায় এবং মেডিকেটেড ও নন-মেডিকেটেড কসমেটিকস এর তালিকা বা আমদানীর শর্তাবলী আইন বা বিধিতে সুষ্পষ্ট ভাবে নির্ধারিত না থাকায় নকল কসমেটিকস উৎপদন ও বাজারজাতকারীরা সুযোগ নিচ্ছে।
ঔষধ ও কসমেটিকস আইন ২০২৩ কার্যকর হওয়ার প্রায় দুই বছর অতিক্রান্ত হলেও নকল ও ভেজাল কসমেটিকস উৎপাদনকারী-বাজারজাতকারীদের বিরুদ্ধে বড় ধরনের জেল-জরিমানার খরব পাওয়া যায়নি।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যর্থতা থাকলেও সম্প্রতি আমেরিকায় পোষাক রপ্তানী শুল্ক ৩৫ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশে নির্ধারণ করাটা বর্তমান সরকারের একটি বড় কূটনৈতিক সাফল্য হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে। বর্তমান অন্তবর্তী সরকার পুলিশ সংস্কার কমিশন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন, স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনসহ বিভিন্ন সংস্কার কমিশন গঠনের মাধ্যমে দীর্ঘদিনের সমস্যা নিরসনে কাজ শুরু করেছে।
কসমেটিকস জনস্বাস্থ্যের সাথে সরাসরি জড়িত বিধায় সিএসটিআই ও ডিজিডিএ এর মধ্যে রশি টানাটানি বন্ধ করে তাদের মধ্যকার আইনগত বিরোধ ও বিদ্যমান সমস্যা সমূহ নিরসন করে উন্নত বিশ্বের আদলে একটি নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ গঠন করা যেতে পারে। সেজন্য বিদ্যমান আইন ও বিধি বিধান সংশোধন করে প্রয়োজনে অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে সমস্যা দ্রুত সমাধান হতে পারে।
যথাযথ পরিকল্পনা এবং পলিসি ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা গেলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে অন্যান্য রপ্তানী খাতের ন্যায় কসমেটিকস শিল্পও বিশ্ববাজারে একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্ভাবনাময় রপ্তানীখাত হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।

- ড. এম. এন. আলম: সাবেক উপ-পরিচালক ও আইন কর্মকর্তা, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর, ঢাকা।