পাইলটের পোশাকে থাকা স্ট্রাইপের অর্থ কী?

পরনে চকচকে সাদা ইউনিফর্ম, বুকের উপর ছোট্ট পাখার ব্যাজ। বিমানচালকদের বেশভূষা যেন অনেকটাই একইরকম। একটু খেয়াল করে দেখলে বোঝা যায়, তাদের কাঁধে বা মাঝে মাঝে হাতার কাছেও কিছু স্ট্রাইপ থাকে। অনেকেই ভাবতে পারেন, এটা শুধু ইউনিফর্মের স্টাইল বা ঐতিহ্যবাহী নকশা। কিন্তু আসলে এই স্ট্রাইপের সংখ্যা একেক পাইলটের জন্য একেক রকম হয়, আর এর পেছনে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অর্থ।
এই স্ট্রাইপগুলোর প্রকৃত নাম কী?
পাইলটদের ইউনিফর্মে কাঁধের ওপর থাকা স্ট্রাইপগুলোর নাম 'এপোলেট'। ফরাসি শব্দ 'এপল' (épaule) থেকে এসেছে এই শব্দের উৎপত্তি, যার মানে 'কাঁধ'।
যাত্রীদের এগুলো তেমন চোখে পড়ে না, কিন্তু পাইলটদের কাছে এর গুরুত্ব অনেক। সাবেক পাইলট ও গবেষক ড্যান বাব বলেন, "এপোলেট অর্জনের মধ্যে এক ধরনের অর্জনের অনুভূতি কাজ করে।" কারণ এই স্ট্রাইপগুলো পাইলটের দায়িত্ব, অভিজ্ঞতা আর প্রশিক্ষণের প্রতীক।
এই স্ট্রাইপগুলো পাইলটের পদমর্যাদা বুঝিয়ে দেয়, কে সিনিয়র, কে জুনিয়র, কার উপর কতটা দায়িত্ব বর্তায় সবই বোঝা যায় এগুলো দেখে।
এগুলো আসলে কী বোঝায়?
পাইলটদের কাঁধের স্ট্রাইপগুলো শুধুই পোশাকের অংশ নয় এগুলো সরাসরি বোঝায় তাদের পদবি ও দায়িত্বের মাত্রা। সাবেক পাইলট ড্যান বাব বলেন, "যে দিন আমি ফার্স্ট অফিসার হিসেবে এপোলেট পেয়েছিলাম, মনে হয়েছিল সব পরিশ্রম সার্থক হয়েছে। আমার স্বপ্নের চাকরির স্বীকৃতি যেন ওই স্ট্রাইপেই ধরা ছিল।"
এখন দেখে নেওয়া যাক, এই স্ট্রাইপের সংখ্যা অনুযায়ী কে কোনটা পরেন এবং তার মানে কী।

একটি স্ট্রাইপ: এটি পরেন একজন ক্যাডেট বা প্রশিক্ষণরত পাইলট, যিনি অভিজ্ঞ প্রশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে নির্ধারিত সময় ধরে বা নির্দিষ্ট 'ফ্লাইং আওয়ার' পূরণ করছেন এবং ফ্লাইট স্কুল শেষ করার পথে আছেন।
দুটি স্ট্রাইপ: এটি পরেন ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার বা সেকেন্ড অফিসার, যিনি সাধারণত তিন নম্বর কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেন বড় উড়োজাহাজে। তারা ফ্লাইট শুরুর আগের ও পরে যন্ত্রপাতি পরীক্ষা ও ফ্লাইট চলাকালীন সিস্টেম পর্যবেক্ষণের দায়িত্বে থাকেন।
তিনটি স্ট্রাইপ: এটি পরেন ফার্স্ট অফিসার বা কো-পাইলট। এরা ক্যাপ্টেনের সঙ্গে মিলেই উড়োজাহাজ চালান। ফ্লাইট শুরু হওয়ার আগে চেক, টেকঅফ, ল্যান্ডিংসহ পুরো উড়ন্ত সময়ের দায়িত্ব ভাগ করে নেন।
চারটি স্ট্রাইপ: এটি পরেন ক্যাপ্টেন বা প্রধান পাইলট। তিনিই পুরো ফ্লাইট, যাত্রী, ক্রু ও উড়োজাহাজের নিরাপত্তার সর্বোচ্চ দায়িত্বে থাকেন। যাকে বলে 'পাইলট ইন কমান্ড'।
পাইলটরা কীভাবে অর্জন করেন এই স্ট্রাইপগুলো?
যখন কেউ কোনো এয়ারলাইনে পাইলট হিসেবে নিয়োগ পান, তখন শুরুতেই তাকে যেতে হয় 'গ্রাউন্ড স্কুল'-এ। এরপর দিতে হয় ফ্লাইট বা সিমুলেটর টেস্ট। এই ধাপগুলো সফলভাবে পেরোলেই, যেখান থেকে তার দায়িত্ব শুরু হচ্ছে, সেই পদ অনুযায়ী তাকে দেওয়া হয় এপোলেট বা স্ট্রাইপ।
কিন্তু শুধু শুরু করলেই হয় না। একজন পাইলটকে ধাপে ধাপে এগোতে হয় অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে। ফার্স্ট অফিসার হতে হলে অন্তত ১,৫০০ ঘণ্টা ফ্লাইট সময় থাকতে হয়। এরপরও ক্যাপ্টেন হতে হলে, নিয়মিত পারফরম্যান্স রিভিউয়ে ভালো করতে হয়, এবং ক্যাপ্টেনদের কাছ থেকে পেতে হয় ইতিবাচক মতামত।
ড্যান বাব বলেন, "সাধারণত একজন ফার্স্ট অফিসারের ক্যাপ্টেন হতে দুই থেকে তিন বছর লাগে। এই সময়ের মধ্যে তিনি নির্দিষ্ট ধরনের উড়োজাহাজে প্রচুর অভিজ্ঞতা অর্জন করেন।"
ফাইনাল পদোন্নতির আগে দিতে হয় আরেকটি ফ্লাইট বা সিমুলেটর টেস্ট। এরপর তাকে ৬ থেকে ১২ মাসের জন্য দায়িত্ব পালন করতে হয় অন্য অভিজ্ঞ ক্যাপ্টেন বা সিনিয়র ফার্স্ট অফিসারের সঙ্গে। যাত্রী বহনের সময়ই পরীক্ষা হয় তার দক্ষতা ও পেশাদারিত্ব। সব মাপকাঠি পেরিয়ে তবেই হাতে আসে চার স্ট্রাইপের গর্বিত সম্মান পূর্ণাঙ্গ ক্যাপ্টেনের মর্যাদা।
সব এয়ারলাইনে কি একই নিয়ম?
প্রায় সব ক্ষেত্রেই হ্যাঁ। পাইলটদের স্ট্রাইপ সিস্টেম বেশিরভাগ দেশে প্রায় একই নিয়মে চলে। এটি নির্ধারিত হয় আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল অ্যাভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ও ইন্টারন্যাশনাল সিভিল অ্যাভিয়েশন অর্গানাইজেশন এর নির্দেশনায়।
এপোলেটের ইতিহাস
এপোলেটের শিকড় খুঁজে পাওয়া যায় ১৭শ শতকের শেষদিকে। তখন এগুলো ব্যবহার করা হতো সামরিক পোশাকে বেল্ট বা কাঁধের ফিতা ঠিক রাখতে, এমনকি কখনো কাঁধ রক্ষার জন্যও। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই কাঁধের অংশগুলো হয়ে ওঠে সামরিক পদমর্যাদার প্রতীক।
যখন আমরা 'এপোলেট' শব্দটি শুনি, তখন অনেকেই ভাবেন ফরাসি সামরিক নেতা নেপোলিয়ন বোনাপার্টের কথা। ইউরোপজুড়ে তার অভিযান চলাকালে নেপোলিয়ন ও তার সেনারা কাঁধে পরতেন দৃষ্টিনন্দন, ঝলমলে এপোলেট যার ডিজাইন ও ধাতব অংশ দিয়ে বোঝা যেত, কে কোন পদে আছেন। নেপোলিয়নের কাঁধে ঝুলত মোটা সোনালি ফ্রিঞ্জসহ ভারী গাঁথুনির এপোলেট যা তখন পরিণত হয়েছিল ক্ষমতা ও সম্মানের চিহ্নে।
মার্কিন সেনাবাহিনীতে এপোলেটের ব্যবহার কীভাবে বদলে গেছে?
যুক্তরাষ্ট্রের কনটিনেন্টাল আর্মি প্রথম দিকে অনুপ্রাণিত হয়েছিল ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর কাছ থেকে। ব্রিটিশরা ১৭৬৮ সালে অফিসারদের পদমর্যাদা বোঝাতে এপোলেট ব্যবহার শুরু করে, আর আমেরিকার সৈন্যরা এই ধারণা গ্রহণ করে। তারা পরতেন দৃষ্টিনন্দন ও দামি এপোলেট, যেগুলোকে অনেকে রসিকতা করে বলতেন "ঝাঁ চকচকে চিরুনির মতো।"
আমেরিকান সেনাবাহিনীতে এপোলেটের ব্যবহার শুরু হয় ১৭৮০ সালে, বিপ্লবী যুদ্ধের সময়। তখন থেকে ১৮৭২ সাল পর্যন্ত অফিসারদের ড্রেস ইউনিফর্মে সোনা বা রুপার তৈরি এপোলেট ব্যবহৃত হতো।
পরবর্তী এক শতকে এই গর্জনাত্মক ডিজাইন ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে আরও বাস্তবধর্মী ও ব্যবহারযোগ্য। ভারী এপোলেটের জায়গা নেয় হালকা এমব্রয়ডারির কাঁধের ফিতা ও ধাতব ব্যাজ।
এভিয়েশনে প্রবেশ
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় এপোলেট ঢুকে পড়ে সামরিক বিমানবাহিনীর ইউনিফর্মে। পরে, বাণিজ্যিক এভিয়েশনে এর ব্যবহার শুরু হয়।
ড্যান বাব বলেন, "১৯৩০-এর দশকে বাণিজ্যিক উড়োজাহাজে পাইলটদের জন্য ইউনিফর্ম বাধ্যতামূলক করা হয়। যেহেতু তারা যাত্রী পরিবহন করতেন, তাই পেশাদার দেখানোটা জরুরি ছিল।"
তৎকালীন শীর্ষ এয়ারলাইন প্যান আম তাদের পাইলটদের পোশাক নেভির অফিসারদের মতো করে নকশা শুরু করে। এখান থেকেই শুরু হয় বাকি এয়ারলাইনগুলোর মধ্যে এপোলেটের জনপ্রিয়তা যা আজও বহাল আছে।
"আজকাল কিছু এয়ারলাইন হয়তো ইউনিফর্মের রং বা স্ট্রাইপের পুরুত্বে পরিবর্তন আনে," বলেন বাব, "তবে সামগ্রিকভাবে ইউনিফর্মের ধরন আগের মতোই রয়ে গেছে।"
অনুবাদ : নাফিসা ইসলাম মেঘা