চট্টগ্রামের প্রধান পাঁচ নদী থেকে ‘বিলুপ্তপ্রায়’ ১৭ দেশীয় মাছ

চট্টগ্রামের প্রধান পাঁচ নদী থেকে গত এক দশকে অন্তত ১৭ প্রজাতির দেশীয় মাছ 'প্রায় বিলুপ্ত' হবার পথে রয়েছে বলে এক গবেষণায় উঠে এসেছে।
গবেষণায় জানা গেছে- বাইম, অলুয়া, গ্যাং মাগুর, গুইলসা টেংরা, বাঘা আঁইড়, চরপ মহাল, নাক কাটা, ঢেলা, শিং ওয়ালা রুই, চেপচেলা, কালা বাটা, ঘোড়া চেলা, শিল বাইলা, চেংমাছ, টাকি, ভোট বাইলা, শোলসহ বেশ কিছু মাছ বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে।
২০০০ সালের মে মাস থেকে ২০২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চট্টগ্রামের কর্ণফুলি, হালদা, সাঙ্গু, শিকলবাহা ও চাঁদখালী নদীতে এ গবেষণা পরিচালিত হয়। গবেষণায় নেতৃত্ব দেন নদী গবেষক ও আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের (আইআইইউসি) সাবেক প্রো ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আলী আজাদী। তার সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন নদী গবেষক ড. মোহাম্মদ আরশাদ উল আলম।
প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আলী আজাদী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমাদের গবেষণায় পাঁচ নদীতে মোট ১৩০ প্রজাতির মাছ, চিংড়ি ও কাঁকড়ার খোঁজ মিলেছে। এর মধ্যে ১১২ প্রজাতির মাছ ও ১৮ প্রজাতির চিংড়ি ও কাঁকড়া রয়েছে।"
"১১২ প্রজাতির মাছের মধ্যে নাইলোটিকা মাছকে মারাত্মকভাবে বিপন্ন অবস্থায় পাওয়া গেছে। এছাড়া ৬ প্রজাতির মাছ বিপন্ন ও ১১ প্রজাতির মাছ অস্তিত্বের হুমকিতে বা অরক্ষিত রয়েছে," বলেন প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আলী আজাদী।
গবেষণায় দেখা গেছে, কর্ণফুলি নদীতে ১১০ প্রজাতির মাছ ও ১৮ প্রজাতির চিংড়ি-কাঁকড়া আছে। সাঙ্গু নদীতে আছে ১১১ প্রজাতির মাছ ও ১৮ প্রজাতির চিংড়ি-কাঁকড়া। এছাড়া শিকলবাহা নদীতে ৭৪ প্রজাতির মাছ ও ১১ প্রজাতির চিংড়ি-কাঁকড়া ও চাঁদখালী নদীতে ৭২ প্রজাতির মাছ ও ১১ প্রজাতির চিংড়ি-কাঁকড়ার অস্তিত্ব রেকর্ড করা হয়েছে। হালদায় ৮৩ প্রজাতির মাছ ও ১০ প্রজাতির চিংড়ি-কাঁকড়া পাওয়া গেছে। গবেষকরা এসব মাছকে ২০টি বর্গ ও ৪৭টি পরিবারে ভাগ করেছেন।
প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আলী আজাদী জানিয়েছেন, প্রকৃতি সংরক্ষণ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আইইউসিএন ২০০০ সালে প্রথম জরিপে দেশের ৫৪ প্রজাতির মাছ বিপন্ন হিসেবে চিহ্নিত করে। এরপর ২০১৫ সালে সর্বশেষ জরিপে নতুন করে আরো ৬৪ প্রজাতির মাছকে বিপন্ন ঘোষণা করে। কিন্তু একই সময়ে চট্টগ্রামের প্রধান পাঁচ নদীতে সরেজমিন গবেষণা পরিচালনা করে তারা ভিন্ন চিত্র পেয়েছেন।
তিনি বলেন, "আইইউসিএন এর রিপোর্টে বিপন্ন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এমন অনেক মাছ চট্টগ্রামের নদীগুলোতে ভালোভাবেই আছে। মূলত মাঠের তথ্যের অভাবে তারা এসব মাছ এখন আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলে তথ্য দিয়েছিলেন।"
গবেষণায় দেখা গেছে, কর্ণফুলি ও সাঙ্গু নদীতে যেসব মাছ এখনো টিকে আছে তা অপর তিনটি নদীতে সঙ্কটাপন্ন। আবার কর্ণফুলি ও সাঙ্গু নদীতে বিপন্ন বেশ কয়েকটি মাছের প্রজাতি হালদা নদীতে ভালোভাবেই টিকে আছে।
প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আলী আজাদী বলেন, "মূলত নদীর গভীরতা, পানি প্রবাহ ও পরিবেশের উপর মাছের টিকে থাকা নির্ভর করে। তাই যেসব মাছ কর্ণফুলি ও সাঙ্গু নদীতে এখনো পাওয়া যাচ্ছে তা শিকলবাহা ও চাঁদখালী নদীতে পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ এসব নদীর গভীরতা কম। এছাড়া সমুদ্রের নোনা পানির কিছু মাছ মিঠা পানিতে নিজেকে সয়ে নিয়েছে। তাদের কর্ণফুলি নদীতে বেশি পাওয়া যায়। যেমন- লারকেইল্লা কোড়াল ও নলুয়া।"
"অপরদিকে চারনদীতে নেই এমন মাছ যেমন- ঘোড়াচেলা, গ্যাং মাগুর, গুইলসা টেংরা এখনো সাঙ্গু নদীর উজানে রেমাক্রি অঞ্চলে পাওয়া গেছে। যা দক্ষিণ এশিয়ায় একমাত্র নেপালে পাওয়া যায়।"
গবেষণায় দেখা গেছে, চট্টগ্রামের কর্ণফুলি থেকে এখন ১১ প্রজাতির মাছ একেবারে নাই হয়ে গেছে। খুব কম পরিমাণে এখনো টিকে আছে ৪২ প্রজাতির, বিপন্ন প্রায় ১০ প্রজাতির মাছ।
সাঙ্গু নদীতে এখন ৮ প্রজাতির মাছ একেবারেই পাওয়া যাচ্ছে না। স্বল্প পরিমাণে এখনো টিকে আছে ৩০ প্রজাতির, বিপন্ন প্রায় ১২ প্রজাতির মাছ।
হালদা নদীতে এখন আর মিলছেনা ৩৫ প্রজাতির মাছ। বিপন্ন অবস্থায় আছে আরো ৬ প্রজাতি এবং খুব কম পরিমাণে টিকে আছে ৪২ প্রজাতির মাছ। হালদা থেকে বিলুপ্ত মাছের তালিকায় রয়েছে- পাঙ্গাস, বাইল্লাতোরা, মেনি ও ভেদা, মুর বাইলা।
প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আলী আজাদী বলেন, "শিকালবাহা এবং চাঁদখালী হল দুটি গুরুত্বপূর্ণ সংযুক্ত নদী দ্বারা পরস্পর সংযুক্ত। এ দুটো নদী মাছদের স্থানান্তরকে সহজ করে। প্রজনন মৌসুমে (চৈত্র থেকে আষাঢ় মাস) সাঙ্গু নদী থেকে হালদা নদী পর্যন্ত কার্প জাতীয় মাছেরা মাইগ্রেট করে হালদায় আসে এবং ডিম ছেড়ে আবার চলে যায়। তাই হালদাকে রক্ষা করতে হলে অপর চারটি নদীতে মৌসুম ভিত্তিক মাছ ধরা নিষিদ্ধ করতে হবে।"
তিনি জানান, বৃহত্তর চট্টগ্রামের প্রধান বড় উপনদীগুলো হলো মায়নী, চেঙ্গি, রেইনখিয়াং, ইছামতি ও হালদা। এর মধ্যে হালদা নদী থেকে কার্প জাতীয় মাছের ডিম সংগ্রহ করা হয়। অপরদিকে রাঙ্গামাটির মায়নী নদী থেকে রুই-কাতলা মাছের ডিম সংগ্রহ করে তা কাপ্তাই হ্রদে ছাড়া হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, চট্টগ্রামের নদীগুলোতে চিংড়ি ও কাঁকড়া বেশ ভালোভাবেই টিকে আছে। মোট ১৮ প্রজাতির চিংড়ি ও কাঁকড়া পাওয়া যায়। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- গলদা চিংড়ি, চটকা চিংড়ি, গদা চিংড়ি, কাইরা চিংড়ি, গুড়া চিংড়ি ও লইল্লা চিংড়ি।
তবে কর্ণফুলি ও সাঙ্গু নদীতে বিপন্ন অবস্থায় আছে বাগদা চিংড়ি। এছাড়া খুব কম পরিমাণে এখনো পাওয়া যায় বাঘাচাম চিংড়ি, গোছা চিংড়ি ও কুছ চিংড়ি।
প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আলী আজাদী জানান, গবেষণার জন্য হালদা নদীর সাথে সংযুক্ত জোয়ার-ভাটার নদী কর্ণফুলী, শিকলবাহা, চাঁদখালী ও সাঙ্গু নদী থেকে মাছের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল। এ সময় নদীতে যান্ত্রিক নৌকা ব্যবহার ও বিভিন্ন ধরনের জালের প্রভাব মূল্যায়নের জন্য কর্ণফুলী নদীর শিলোক বাজার পয়েন্ট থেকে শিকলবাহা (নদীর মুখ থেকে মুরালি ঘাট) ও চাঁদখালী নদী (মুরালি ঘাট থেকে কেশুয়া) পর্যন্ত সরেজমিন পরিদর্শন করা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, "চট্টগ্রামে প্রধান পাঁচটি নদীর বাইরে যে জলাধারগুলোকে খাল বলে আসলে সেগুলো নদী। মাছের ধর্ম হচ্ছে চৈত্র মাছের শেষে বর্জ্য বৃষ্টি হলে এই নদগুলো বেয়ে একেবারে উজানে যায়। পরে কালবৈশাখী হলে অনুকূল আবহাওয়া পেলে মেয়ে মাছ ডিম ছাড়ে, পুরুষ মাছ ছাড়ে স্পার্ম। পানির টার্বুলেশনে তার ফার্টিলাইজেশন হয়। কিন্তু স্লুইস গেট ও কারখানার বর্জ্যের কারণে মাছের খাবারের সংকট তৈরী হচ্ছে; নষ্ট হয়ে গেছে মাছের আধার। এ কারনে মাছরা অস্তিত্বের সংকটে রয়েছে"।