চড়া মূল্য দিয়ে জ্যাক মা ব্যবসার শিক্ষা নিলেন: চীনের নেতা একজনই

বলতে গেলে শূন্য থেকে বিশাল ব্যবসা-সাম্রাজ্য গড়েছেন জ্যাক মা। শত শত কোটি ডলার আয় করেছেন। মানুষকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন নিত্যনতুন ডিজিটাল আবিষ্কাররের সঙ্গে। জেফ বেজোস, ইলন মাস্ক, বিল গেটসদের সমতুল্য ছিলেন তিনি।
অথচ সেই জ্যাক মা এখন একেবারেই লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে গেছেন। এর আংশিক কারণ তার বেপরোয়া ঝুঁকি নেওয়ার স্বভাব।
একসময় পশ্চিমের সঙ্গে ইঁদুর দৌড়ে প্রযুক্তিকে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার মনে করত চীন। কিন্তু আজ সেই প্রযুক্তিই ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির জন্য ব্যবসার নিয়ম-কানুন নতুন করে লিখছেন শি জিনপিং।
বেইজিংয়ের নিয়ত পরিবর্তনশীল দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে তাল মেলাতে পারেননি জ্যাক মা। তার আচরণ বড় বেশি আমেরিকান উদ্যোক্তাদের মতো ছিল।
গত অক্টোবরে অর্থনৈতিক উদ্ভাবনকে দমিয়ে রাখার জন্য চীনের নীতিনির্ধারকদের সমালোচনা করেন মা। এর কদিন পরই জিনপিংয়ের ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপে মা'র ফিনটেক কোম্পানি অ্যান্ট গ্রুপের রেকর্ড ৩৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি পাবলিক অফারিং আটকে যায়। এরপর অ্যান্ট ব্যবসা পুনর্বিন্যস্ত করতে বাধ্য হয়েছে।
রাষ্ট্রীয় স্বার্থকে বেশি প্রাধান্য দেওয়ার জন্য বেইজিং চীনের বেসরকারি খাতের উপর খড়গহস্ত হয়েছে।
জ্যাক মা নিজে বেইজিংয়ে গিয়ে সবকিছু ঠিক করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছিল তার। মা'র খোলামেলা কথাবার্তা আর সহ্য করছেন না শি জিনপিং।
বেইজিংয়ের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, নিজের চেয়ে সরকারি উদ্যোগগুলোকে বেশি সমর্থন দেওয়া উচিত ছিল জ্যাক মা'র। সমাজকে তার প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশের ভাগ আরো বেশি দেওয়া উচিত ছিল।
মা'রসর্মথকরা বলছেন, পশ্চিমে যেসব কাজের জন্য প্রযুক্তি মোগলরা পুরস্কৃত হন, সেই একই কাজের জন্য জ্যাক মা পাচ্ছেন শাস্তি।
মনের কথা শোনা উদ্যোক্তা
জ্যাক মা ব্যবসা শুরু করেন ১৯৯০-এর দশকে, চীন যখন বিশ্ব-অর্থনীতিতে প্রবেশ করছে। সে সময় মা ইন্টারনেটের বিপুল সম্ভাবনায় আকৃষ্ট হন। সেই থেকে তিনি তার লক্ষ্য ব্যাখ্যা করার জন্য সরকারি অফিসগুলোতে ধরনা দিতে থাকেন।
১৯৯৯ সালে আলিবাবা প্রতিষ্ঠার পর সরকারের অনেক সিনিয়র কর্মকর্তা তার উদ্যমকে স্বাগত জানান। চীনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ওয়েন জিয়াবাও মা'র উদ্ভাবনীক্ষমতার ভক্ত ছিলেন।
২০০০-এর দশকের শেষদিকে আলিবাবা ফুলে-ফেঁপে ওঠে। টিভি পর্দায়, পোস্টারে নিয়মিত দেখা যেতে থাকে মা'কে। সাফল্য সম্পর্কে নিজের দর্শন নিয়ে কথা বলতেন তিনি। এক বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন, 'একটি কোম্পানির সাফল্য-ব্যর্থতা নির্ভর করে সেটির প্রতিষ্ঠাতা তার মনের কথা শুনছেন কি না, তার ওপর।'
সরকারি কর্মকর্তারা মা'র কাজের প্রশংসা করতেন। শি জিনপিংও ছিলেন তার প্রশংসাকারীদের দলে। তখনও অবশ্য তিনি চীনের প্রেসিডেন্ট হননি। স্টার্টআপকে সমর্থন দিতেন জিনপিং। ২০০৭ সালে তিনি আলিবাবার কার্যালয় দেখতে গিয়ে মা'কে বলেন, 'আপনারা সাংহাই এসে আমাদের উন্নয়নের সাহায্য করতে পারেন না?'
তবে ২০০৩ সালে চীন সরকার মা'র নতুন উদ্যোগ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। মা'র ওই উদ্যোগটির নাম ছিল তাওবাও। এই অনলাইন প্লাটফর্মের মাধ্যমে লোকে একে অন্যের কাছে সরাসরি জিনিসপত্র বিক্রি করতে পারত। কিন্তু উদ্যোগটি নিয়ে সরকারের অস্বস্তির টের পাওয়ায় মা তড়িঘড়ি এর যতি টানেন।
যা-ই হোক, একের পর এক সাফল্য পেতে থাকায় মা আরো সাহসী হয়ে ওঠেন। ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম আলিবাবার লেনদেনের জন্য তিনি আলিপে চালু করেন। চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর কর্তৃত্ব হুমকির মুখে পড়ে যায় আলিপের কারণে।
মা বলেন, চীনা ব্যাংকগুলো ক্ষুদ্র ব্যবসাকে যথেষ্ট সাহায্য করছিল না। ব্যাংকগুলোর সমস্ত মনোযোগ কেন্দ্রীভূত ছিল রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন উদ্যোগগুলোর ওপর। ২০০৮ সালে এক সভায় মা বলেন, 'ব্যাংকগুলো নিজেরা না বদলালে আমরাই ব্যাংক বদলে ফেলব।'
শি জিনপিং চীনের প্রেসিডেন্ট হন ২০১৩ সালে। তার আগের দুই রাষ্ট্রপ্রধান জিয়াং জেমিন এবং হু জিনতাওয়ের আমলে বেসরকারি খাত যথেষ্ট স্বাধীনতা ভোগ করতো। কিন্তু জিনপিং প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে বেসরকারি খাতের স্বাধীনতা কমে আসতে থাকে। তিনি ঘোষণা দেন, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন উদ্যোগগুলোকে কিছুতেই দুর্বল হতে দেওয়া যাবে না।
২০১৪ সালে আলিবাবা নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে রেকর্ড ২৫ বিলিয়ন ডলারের স্টক বিক্রি করে। মা তখন বলেছিলেন, চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন উদ্যোগগুলোকে অস্বস্তিতে ফেলতে পারার অনুভূতি দারুণ সুখকর। ২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের এক টিভি চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, 'আলিপের জন্য যদি কাউকে জেলে যেতে হয়, তাহলে আমিই যাব।'
আলিবাবা ও অ্যান্টের বাজার বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে চীনের সরকারি কর্মকর্তাদের উদ্বেগ। পেমেন্ট অ্যাপ আলিপের ব্যবহারকারী একশো কোটি ছাড়ালে চীন সরকারের উদ্বেগ আরো বেড়ে যায়। সরকারি নীতিনির্ধারকদের ধারণা ছিল, ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা নেওয়ার জন্য আলিপে ব্যবহারকারীদের তথ্য সংগ্রহ করত অ্যান্ট।
২০১৫ সালে চীনের বাজার নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, আলিবাবার তাওবাওতে ভুয়া, নিষিদ্ধ অথবা নিম্নমানের পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে।
আলিবাবা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ করার হুমকি দেয়। জ্যাক মা বেইজিংয়ে উড়ে গিয়ে তৎকালীন স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ফর ইন্ডাস্ট্রি অ্যান্ড কমার্স প্রধানের সঙ্গে দেখা করেন। এই প্রতিষ্ঠানই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছিল। মা যেদিন দেখা করেন, সেদিনই নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানটি তার ওয়েবসাইট থেকে প্রতিবেদনটি সরিয়ে ফেলে।
এ ঘটনার পর অনেক চীনা ভাবতে থাকে যে, সরকারকে চ্যালেঞ্জ জানানোর সামর্থ্য রাখে আলিবাবা।
২০১৩ সালে ইয়ুয়ে বাও নামে একটি পণ্য বাজারে ছাড়ে অ্যান্ট। ফলে লক্ষ লক্ষ আলিপে ব্যবহারকারী নিজেদের একাউন্টে টাকা স্থানান্তরের সুযোগ পায়। এর মাধ্যমে অর্থ লেনদেনের পরিমাণ চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোকে ছাড়িয়ে যায়।
২০১৮ ইয়ুয়ে বাওয়ের মূল তহবিল বিশ্বের বৃহত্তম অর্থ-বাজার তহবিলে পরিণত হয়। ইয়ুয়ে বাওয়ের তহবিলের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৪৪ বিলিয়ন ডলারে। বিপদ দেখে রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকরা অ্যান্টেকে তহবিলের আকাশ কমানোর নির্দেশ দেয়।
এর মাধ্যমেই প্রকাশ্যে চলে আসে শি জিংপিং ও মা'র দ্বন্দ্ব।
পতনের শুরু
২০১৫ সালে সিয়াটলে শি জিনপিং এবং প্রভাবশালী মার্কিন ও চীনা নির্বাহীদের মধ্যে বৈঠক হয়। সেখানে সব নির্বাহীকে ৩ মিনিট করে কথা বলার সুযোগ দেন জিনপইং। সবাই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বক্তব্য শেষ করলেও জ্যাক মা সময় নেন অনেক বেশি। দীর্ঘ বক্তব্যে চীনের বাণিজ্যের দৃষ্টিভঙ্গি এবং চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের উন্নতির জন্য চীনা কোম্পানিগুলো কী ভূমিকা রাখতে পারে, তা নিয়ে কথা বলেন তিনি।
জ্যাক মা'র বক্তব্যে মোটেও খুশি হতে পারেননি শি জিনপিং। সে-ই শেষবার প্রেসিডেন্টের কোনো দলীয় সভায় কথা বলার সুযোগ পান মা।
তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা জ্যাক মা'কে হোয়াইট হাউসে দুপুরের খাবারে নিমন্ত্রণ করেন। এছাড়াও তিনি প্যারিসে গিয়ে তৎকালীন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদের সঙ্গে ই-কমার্স নিয়ে আলাপ করেন।
২০১৭-র শুরুর দিকে জ্যাক মা তৎকালীন নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করেন। মিডিয়ার সামনে মা'কে মহান উদ্যোক্তা বলে অভিহিত করেন ট্রাম্প।
সে বছরই আলিবাবার ১৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে মাইকেল জ্যাকসনের পোশাক পরে প্রায় ৪০ হাজার কর্মচারীর সামনে নাচেন মা।

বিদেশে মার জনপ্রিয়তা যত বাড়ছিল, দেশে ততই দুর্বল হচ্ছিল তার অবস্থান। তার ব্যক্তিগত অফিস থেকে চীনের রাষ্ট্রপ্রধানের দপ্তরে পাঠানো পরামর্শ একের পর এক প্রত্যাখ্যাত হচ্ছিল।
২০১৭ সালে পিপলস ব্যাংক অফ চায়না নির্দেশ দেয়, আলিপে ও অন্যান্য ব্যাংক-বহির্ভূত পেমেন্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে অনলাইন লেনদেন করতে হবে।
'নগদ অর্থবিহীন সমাজ'-এর ধারণা প্রচার করার জন্য অ্যান্টের সমালোচনায় মুখর হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
২০১৮ সালে ৫০ জন উদ্যোক্তাকে চীনের গ্রেট হল অফ দ্য পিপল-এ ডাকেন শি জিনপিং। নিমন্ত্রিতদের তালিকায় জ্যাক মা'র নাম ছিল না।
এছাড়াও সরকারি নীতিনির্ধারকরা অ্যান্টের আরেক পণ্য হুয়াবেই নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। হুয়াবেই অনেকটা ভার্চুয়াল ক্রেডিট কার্ডের মতো। ২০১৫ সালে চালু হওয়ার পর একটি তরুণদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।
অ্যান্ট প্রথমে সহজ শর্তে 'হুয়াবেই ঋণ' দিত। কিন্তু ২০১৭ সালের শেষ দিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অ্যান্টসহ এরকম অন্যান্য ঋণদাতাদের ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা সীমিত করে ফেলে। তারপরও অবশ্য হুয়াবেইয়ের জনপ্রিয়তা কমেনি।
চূড়ান্ত পতন
গত গ্রীষ্মে জ্যাক মা চীনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় শহর হেফেই-তে যান। করোনা পরিস্থিতি সামলাতে দক্ষতার পরিচয় দেওয়ায় সেখানকার স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের প্রশংসায় ভাসান তিনি। তার এই কাজে খুব বিরক্ত হন ক্ষমতাসীন দলের সিনিয়র নেতারা। বেইজিংয়ের মতে, স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশংসা করা জ্যাক মার কাজ নয়।
গত বছরের আগস্টে প্রথমবারের মতো আইপিও ছাড়ে অ্যান্ট। সেখানে প্রতিষ্ঠানটি প্রথমবারের মতো তাদের অর্থনৈতিক তথ্য প্রকাশ্যে আনে। অ্যান্টের ঋণ দেওয়ার ব্যবসা কতটা বড় হয়েছে, তা দেখে রীতিমতো ভিরমি খান সরকারি নিয়ন্ত্রক সংস্থার কর্তাব্যক্তিরা। তাই তারা বলতে শুরু করেন, সম্ভাব্য অর্থনৈতিক ঝুঁকি এড়ানোর জন্য যত দ্রুত সম্ভব ব্যবস্থা নিতে হবে। যেসব কোটিপতি অ্যান্টে বিনিয়োগ করেছিলেন, তাদের সম্পদবৃদ্ধি থামানোর উপায় খুঁজতে থাকেন তারা।
গত বছরের অক্টোবরে সরকারি নিয়ন্ত্রক সংস্থার সমালোচনা করে বক্তব্য দেন জ্যাক মা। এ বক্তব্যের কয়েক ঘন্টার মধ্যেই রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা মা'র প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে রিপোর্ট জোর করতে আরম্ভ করে। কিছু রিপোর্টে বলা হয়েছিল, ডিজিটাল অর্থনৈতিক পণ্য ব্যবহার করে মাত্রাতিরিক্ত ঋণ নেওয়া এবং খরচ করাকে উৎসাহিত করছে অ্যান্ট, যা চিনা অর্থনীতিকে ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে।
এরপরই অ্যান্টের আইপিও বাতিল করেন শি জিনপিং। এখানেই ইতি ঘটে জ্যাক মা'র সাফল্যের গল্পের।
কয়েক সপ্তাহ বাদেই আইপিও বাতিলের দায় নিজেদের কাঁধে নেন আলিবাবার সিনিয়র নির্বাহীরা। যদিও জ্যাক মা বলেছেন, আইপিও বাতিল হয়েছে তার দোষেই।
সূত্র: দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল