শিক্ষা ঋণ কি উচ্চশিক্ষায় বৈষম্য দূর করতে পারবে?

ইসমাইল হোসেন নাইম সবসময়ই কোনো স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন দেখতেন। গত বছর ভোলার একটি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি।
কিন্তু কোভিড-১৯ মহামারির কারণে দেশজুড়ে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যহত হয়েছে, তার স্বপ্ন পূরণের পথে আর্থিক সংকট প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে।
"ভালো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির জন্য আমার প্রয়োজনীয় স্কোর আছে। কিন্তু আমার পরিবার শিক্ষার খরচ বহন করতে না পারায় আমার পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না," দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলছিলেন তিনি।
উচ্চশিক্ষা অর্জনের আশা বাদ দিয়ে তার পরিবারকে আর্থিকভাবে সহায়তা করার জন্য কাজ শুরু করেছেন তিনি।
সবসময়ই গ্রামাঞ্চল ও শহুরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভাজন ছিল, কোভিড-১৯ তা আরও প্রকট করে তুলেছে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এই ব্যবধান আরও বেশি।
এর অন্যতম প্রধান কারণগুলো হল অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণের জন্য ডিভাইস সংকট, অনেক শ্রমজীবী মানুষ মহামারির সময় কাজ হারানোয় আর্থ-সামাজিক অবস্থারও অবনতি হয়েছে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, মহামারির সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনলাইন ক্লাসে দরিদ্র ও গ্রামীণ শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করতে না পারায় ইতোমধ্যে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক ধরনের ডিজিটাল বৈষম্য তৈরি হয়েছে।
বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি জরিপেও এমন তথ্য উঠে এসেছে।
সানেমের সাম্প্রতিক এক জরিপের তথ্য অনুযায়ী, করোনাভাইরাসের কারণে গত বছরের ডিসেম্বরে দেশে চরম দারিদ্র্যের হার বেড়ে ৪২ শতাংশ হয়েছে, যা ২০১৮ সালেও ২১ দশমিক ৬ শতাংশ ছিল।
জরিপে অংশগ্রহণকারী অন্তত ৮ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষ মহামারির সময় চাকরি হারিয়েছেন এবং নতুন চাকরি খুঁজে পাননি। এছাড়া, ৫৫ দশমিক ৯ শতাংশ অংশগ্রহণকারীর আয় কমেছে একই সময়ে। ১৭ দশমিক ৩ শতাংশের পরিস্থিতি অপরিবর্তিত ছিল।
প্রায় ৮২ দশমিক ১ শতাংশ পরিবার জানিয়েছে তারা মহামারির আগে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স পেতেন, মহামারির সময় তারচেয়ে কম পেয়েছেন।
"জীবিকা নির্বাহের জন্য কাজ শুরু করায় অনেক শিক্ষার্থীই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবেন না এর বড় সম্ভাবনা আছে। শিক্ষা তাদের অগ্রাধিকার তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে থাকবে। ভবিষ্যতে দেশের অর্থনীতিতেও এর প্রভাব পড়বে," বলেন অধ্যাপক সেলিম।
"আমরা এক্ষেত্রে সুস্পষ্ট সামাজিক বিভাজন দেখতে পাচ্ছি। ধনী পরিবারের শিক্ষার্থীরা নামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবেন, অন্যদিকে দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীরা ঝড়ে পড়তে পারেন," যোগ করেন তিনি।
তবে মহামারির আগেও সামগ্রিক পরিস্থিতি সন্তোষজনক ছিল না। অনেক বছর ধরেই বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের পরিবারের আয়ের বৈষম্য প্রকট। ২০১৯ সালের বিশ্বব্যাংকের একটি জরিপের তথ্য অনুযায়ী, উচ্চশিক্ষায় ধনী পরিবারের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণই বেশি, নামী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ চিত্র আরও প্রকট।
'বাংলাদেশ টারশিয়ারি এডুকেশন সেক্টর রিভিউ স্কিলস অ্যান্ড ইনোভেশন ফর গ্রোথ' শীর্ষক জরিপে উঠে এসেছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৭ শতাংশ শিক্ষার্থীই ধনী পরিবারের। সরকারি কলেজগুলোতে ভর্তির ক্ষেত্রেও শিক্ষার্থীদের ধনী অংশ এগিয়ে আছে।
যদিও সরকার এবং কিছু বেসরকারি সংস্থা মেধার ভিত্তিতে নিম্ন আয়ের পরিবারের শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকে, তা একেবারেই অপ্রতুল।
বিদ্যমান শিক্ষা পদ্ধতিতে বেশ বড় সংখ্যক শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হন। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে জাতীয় শিক্ষা ঋণ পরিকল্পনার অভাবের বিষয়টি তুলে ধরা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে বর্তমানে কোনো জাতীয় শিক্ষা ঋণ প্রকল্প চালু নেই।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য অধ্যাপক ড. মো. আলমগীর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী শিক্ষার্থীদের জন্য জাতীয় শিক্ষা ঋণ প্রকল্প শুরুর পরিকল্পনা আছে তাদের, তবে এখন পর্যন্ত এনিয়ে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
তিনি জানান, এধরনের প্রকল্প অবধারিতভাবেই নিম্ন-মধ্যবিত্ত আয়ের পরিবারের শিক্ষার্থীদের জন্য সহায়ক হবে।
বিদ্যমান উচ্চশিক্ষার প্রেক্ষাপট আমূলে বদলে দিতে পারে জাতীয় শিক্ষা ঋণ প্রকল্প। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ঘানা, দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া ও সুইডেনের মতো দেশগুলোতে বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা ঋণ চালু আছে, এসব প্রকল্প ব্যাপক সফলতার স্বাক্ষর রেখেছে।
বাংলাদেশে মার্চেন্টাইল ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, আইএসআইসি ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক, উত্তরা ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাংক, এইচএসবিসি ও অগ্রণী ব্যাংক শিক্ষা ঋণ দিয়ে থাকে। কিন্তু ঋণ পাওয়ার জন্য মাসিক আয়ের প্রমাণ ও নির্দিষ্ট পরিমাণ ব্যাংক ডিপোজিটের প্রয়োজন হওয়ায় নিম্ন আয়ের পরিবারের শিক্ষার্থীরা এক্ষেত্রেও বঞ্চিত হন।
বিশ্বব্যাংকের জরিপে উঠে আসা ফলাফলে এর প্রভাবও আছে। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সমাজের ধনী অংশের শিক্ষার্থীরাই এগিয়ে থাকে। মাধ্যমিক শিক্ষার চেয়েও বেশি অসমতা বিদ্যমান এক্ষেত্রে। এমনকি অনেক সময় নিম্ন আয়ের পরিবারের শিক্ষার্থীরা মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার ক্ষেত্রেও বাধার সম্মুখীন হয়।
"বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের দুই-তৃতীয়াংশই শহুরে পরিবারের, তাদের মা-বাবার উচ্চতর শিক্ষাগত যোগ্যতা আছে। তাদের মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থীর বাবার স্নাতক ডিগ্রী বা আরও উচ্চতর ডিগ্রী আছে," বলা হয় প্রতিবেদনে।
জাতীয় শিক্ষা ঋণ দেশজুড়ে সমাজের সকল স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চ শিক্ষার সমান অধিকার নিশ্চিত করতে ভূমিকা রাখবে, এমনটাই মত বিশেষজ্ঞদের।
দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রেখে অন্যান্য দেশের জাতীয় শিক্ষা ঋণ পদ্ধতি বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রকল্পের নকশা প্রণয়নের পরামর্শ দেওয়া হয় বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে। এভাবে কার্যকর প্রণোদনা ব্যবস্থা ও কার্যকর ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, যতো দ্রুত সম্ভব সরকারের জাতীয় শিক্ষা ঋণ পরিকল্পনা হাতে নেওয়া উচিৎ।
"আর্থিক সমস্যার কারণে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে না পারায় আমরা অনেক প্রতিভাবান শিক্ষার্থী হারাচ্ছি। শিক্ষা ঋণ তাদের সুরক্ষা দেবে এবং দেশের উন্নয়নের জন্য তারা তাদের মেধা কাজে লাগাতে পারবে," বলেন তিনি।
শুধু দরিদ্র এবং মেধাবী শিক্ষার্থীদের ঋণ পাওয়া উচিৎ জানিয়ে ঋণের অর্থ বিতরণে যথাযথ নজরদারির ওপর জোর দেন তিনি।