বাড়তি চাহিদা মেটাতে ৪০,০০০ টন সক্ষমতার এলপিজি প্ল্যান্ট স্থাপনের পরিকল্পনা বিপিসির
দেশের বেসরকারি তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) শিল্প যখন টিকে থাকার লড়াইয়ে, তখন রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) চট্টগ্রামে আমদানিনির্ভর একটি নতুন এলপিজি প্ল্যান্ট স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। প্রায় তিন দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো এমন উদ্যোগ নিলো বিপিসি।
এলপিজি সিলিন্ডারের চাহিদা দ্রুত বাড়ার কথা উল্লেখ করে বিপিসি চট্টগ্রাম শহরের দক্ষিণ কাট্টলি এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) মালিকানাধীন অব্যবহৃত ৫০ একর জমি চেয়েছে। সেখানে বছরে ৪০ হাজার টন সক্ষমতার একটি এলপিজি প্ল্যান্ট স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে সংস্থাটির।
প্রস্তাবিত ওই জায়গা চট্টগ্রাম বন্দরের কাছাকাছি হওয়ায় কৌশলগতভাবে সুবিধাজনক বলে মনে করা হচ্ছে। এ লক্ষ্যে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ সম্প্রতি পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে বাজারমূল্য বা মৌজা দরে জমি বরাদ্দ চেয়ে চিঠি দিয়েছে।
উপসচিব শাহাদাত হোসেন স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, দক্ষিণ কাট্টলি এলাকায় পাউবোর মালিকানাধীন দুটি অব্যবহৃত জমি রয়েছে—একটি ২৫ একর এবং আরেকটি ৩৩ দশমিক ৫১ একর। জমিগুলো আগে অধিগ্রহণ করা হলেও নির্ধারিত কাজে ব্যবহার করা হয়নি।
চিঠিতে বলা হয়েছে, জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব ও সাশ্রয়ী জ্বালানি সরবরাহের লক্ষ্যে বিপিসির অনুকূলে এই জমির ৫০ একর বরাদ্দ বিবেচনার জন্য অনুরোধ জানানো হচ্ছে।
এতে আরও বলা হয়, বন্দরসংশ্লিষ্ট এলাকায় প্ল্যান্ট স্থাপন করা হলে রেফ্রিজারেটেড ও প্রেশারাইজড এলপিজি আমদানির ক্ষেত্রে পরিবহন ব্যয় কমবে। পাশাপাশি সংরক্ষণ, বোতলজাতকরণ ও বিতরণ প্রক্রিয়া আরও দক্ষ ও সাশ্রয়ী হবে।
এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এ বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
পাউবোর উপবিভাগীয় প্রকৌশলী বর্ণ হক বলেন, "বিপিসি যে জমির জন্য আবেদন করেছে, সে বিষয়ে এক মাস আগে আমরা মন্ত্রণালয়ে একটি প্রতিবেদন পাঠিয়েছি। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেবে।"
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বর্তমানে প্রায় পুরোপুরি বেসরকারি খাতনির্ভর এলপিজি বাজারে সরকারের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে। প্রস্তাবটি জ্বালানি নিরাপত্তা জোরদার এবং তুলনামূলক সাশ্রয়ী দামে এলপিজি সরবরাহের নীতিগত উদ্যোগের প্রতিফলন।
তবে শিল্প সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, এ উদ্যোগের সময় নির্বাচন যথাযথ না হলে তা বেসরকারি উদ্যোক্তাদের ওপর আরও চাপ সৃষ্টি করতে পারে। তাদের মতে, দীর্ঘদিন ধরে তীব্র মূল্য প্রতিযোগিতা, আর্থিক ক্ষতি এবং একাধিক প্রতিষ্ঠানের বাজার থেকে সরে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে নতুন এ প্রকল্প বেসরকারি খাতের সংকট আরও গভীর করতে পারে।
বিপিসির উদ্যাগ নিয়ে কী বলছেন খাত সংশ্লিষ্টরা?
বিপিসির এই উদ্যোগের সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে এলপিজি খাতের সংশ্লিষ্টরা মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ এলপিজি অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আমিরুল হক বলেন, পুঁজি সংকট না থাকায় বিপিসি এ খাতে ভালো করতে পারবে। তবে নতুন প্ল্যান্ট স্থাপনের পরিবর্তে চট্টগ্রাম বা মোংলায় বন্ধ থাকা দুই–তিনটি বেসরকারি প্ল্যান্ট অধিগ্রহণের পরামর্শ দেন তিনি।
আমিরুল হক বলেন, "সরকার আমাদের বিরুদ্ধে প্রায়ই দাম কারসাজি ও সিন্ডিকেটের অভিযোগ তোলে। বিপিসি যদি আরও বিনিয়োগ নিয়ে এই ব্যবসায় নামে, তাহলে আমরা যেসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হই, সেগুলো তারা বাস্তবভাবে বুঝতে পারবে।"
এ বিষয়ে জানতে বিপিসির চেয়ারম্যান আমিন উল আহসান এবং পরিচালক (অপারেশনস অ্যান্ড প্ল্যানিং) একেএম আজাদুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তা সম্ভব হয়নি।
রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগে দীর্ঘ বিরতি
বর্তমানে দেশে রাষ্ট্রায়ত্ত এলপিজি সংরক্ষণ ও বোতলজাতকরণ প্ল্যান্ট রয়েছে মাত্র দুটি। একটি চট্টগ্রামের পতেঙ্গায়, যা ১৯৭৭–৭৮ অর্থবছরে স্থাপিত হয়; আরেকটি সিলেটের কৈলাশটিলায়, যা স্থাপন করা হয় ১৯৯৫ সালে। তুলনামূলক সস্তা সরকারি এলপিজির চাহিদা থাকলেও এরপর আর কোনো নতুন রাষ্ট্রায়ত্ত প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়নি।
বিপিসির কর্মকর্তাদের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে বোতলজাত এলপিজির বার্ষিক চাহিদা প্রায় ১৭ লাখ টন—যা ২০৩০ সালের মধ্যে বেড়ে ৩০ লাখ টনে পৌঁছাতে পারে। নতুন বাসাবাড়ির গ্যাস সংযোগ বন্ধ থাকা এবং শিল্প ও পরিবহন খাতে পাইপলাইনের সুবিধা সীমিত হওয়ায় এলপিজির চাহিদা দ্রুত বাড়ছে।
তবে সরকারি সরবরাহ এখনও খুবই সীমিত। রাষ্ট্রায়ত্ত এলপি গ্যাস লিমিটেড বছরে সর্বোচ্চ প্রায় ৩৩ হাজার টন এলপিজি সরবরাহ করতে পারে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম থেকে ২৫ হাজার টন এবং কৈলাশটিলা থেকে ৮ হাজার টন আসে। ফলে দেশের মোট এলপিজি চাহিদার প্রায় ৯৯ শতাংশই পূরণ করছে বেসরকারি খাত।
বেসরকারি খাতে লোকসান
২০১০ সাল পর্যন্ত দেশে এলপিজি বাজারে অপারেটরের সংখ্যা ছিল মাত্র ৬টি। ২০০৯ সালে নতুন বাসাবাড়ির গ্যাস সংযোগ বন্ধ হওয়ার পর এলপিজি ব্যবহারে উৎসাহ দিতে ব্যাপক হারে লাইসেন্স দেওয়া শুরু হয়।
২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত মোট ৫৮টি লাইসেন্স ইস্যু করা হয়েছে, এতে বড় বড় শিল্পগোষ্ঠী এ খাতে প্রবেশ করে। ২০১৪–১৫ অর্থবছর পর্যন্ত বাজার মোটামুটি স্থিতিশীল থাকলেও এরপর ঘন ঘন লাইসেন্স দেওয়ার ফলে তীব্র প্রতিযোগিতা তৈরি হয় এবং দাম কমতে থাকে।
এর মধ্যে কিছু প্রতিষ্ঠান বাজার ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। বেঙ্গল গ্রুপ তাদের এলপিজি ইউনিট সিটি গ্রুপের কাছে বিক্রি করেছে। আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ক্রেতা খুঁজছে, তবে দীর্ঘদিন ভর্তুকি দিয়ে ব্যবসা চালানোর কারণে সৃষ্ট দায় তাদের জন্য বড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জেএমআই গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবদুর রাজ্জাক ২০২০ সালে এলপিজি ব্যবসায় প্রবেশ করেন এবং ৩২ লাখ সিলিন্ডার বাজারে আনেন। তিনি জানান, প্রতিটি ইউনিটে প্রায় ৩ হাজার টাকা খরচের বিপরীতে আয় ছিল মাত্র ৬০০ টাকা। এতে ভর্তুকি বাবদ লোকসান প্রায় এক হাজার কোটি টাকায় পৌঁছায়।
রাজ্জাক বলেন, মহামারির সময় বিলম্ব এবং ভর্তুকির কারণে তার প্রকল্পের বাজেট ৭০০–৮০০ কোটি টাকা থেকে বেড়ে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে ব্যাংকঋণই রয়েছে ২ হাজার কোটির বেশি।
তিনি বলেন, "সবচেয়ে বড় ধাক্কা এসেছে সিলিন্ডার খাতে। শুধু সিলিন্ডার বাবদই প্রায় এক হাজার কোটি টাকার লোকসান হয়েছে।"
ওমেরা পেট্রোলিয়ামের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তানজীম চৌধুরী বলেন, ২০১৭ সালে একসঙ্গে একাধিক প্রতিষ্ঠান বাজারে প্রবেশ করায় প্রতিযোগিতা হঠাৎ করেই তীব্র হয়ে ওঠে।
তিনি বলেন, "প্রতি সিলিন্ডারে ভর্তুকি ১০০ টাকা থেকে বেড়ে এখন প্রায় ২ হাজার ৫০০ টাকায় পৌঁছেছে। এ পরিস্থিতি দীর্ঘমেয়াদে টেকসই নয়।"
দেশের প্রথম বেসরকারি এলপিজি অপারেটর বসুন্ধরা গ্রুপও চাপের মুখে রয়েছে। এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, ২০১৪–১৫ অর্থবছরে প্রতি সিলিন্ডারে যেখানে ৩০–৪০ টাকা মুনাফা ছিল, এখন সেখানে উৎপাদন খরচের পাঁচ ভাগের এক ভাগ দামে সিলিন্ডার বিক্রি করতে হচ্ছে। বাজারে ৭০ লাখের বেশি সিলিন্ডার চলাচল করলেও ব্যবসা এখনো লাভজনক হয়ে ওঠেনি।
